বৈকুন্ঠপুর চা বাগানে কী হচ্ছে?
পাভেল পার্থ
বৈকুন্ঠপুর চা বাগানে কী আবার হচ্ছে? কিছুই হচ্ছে না, যা হবার তাই হচ্ছে। চা বাগানে কী হয়? চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় ফুলের টবে নানা জাতের গোলাপ আর ফুটে নাইটকুইন। সাহেব-বাবুদের সন্তানেরা গাড়ি হাঁকিয়ে পড়তে যায় হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সিলেটের মতো শহরে। শহর থেকে ক্যামেরা বগলদাবা করে ধনীর দুলালেরা মৌজ করতে যায় আর কখনোবা কোনো গল্প-সিনেমার শ্যুটিং। নায়িকা চা পাতা ধরে খলখল করে হাসে আর নায়ক টিলা বেয়ে দৌড়ে নামে। আর সকলে ক্লান্ত হয়ে বাংলোয় ফিরলে বারান্দায় জমে চা পানের আসর। চা বাগান বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে এমনি ‘রোমান্টিক’ আর ‘রহস্যময়’। শৌখিন লেখকেরা এখানে মাঝেসাঝে লিখতে আসেন। বড়লোকেরা একটুখানি হাওয়াবদলের জন্য চা বাগানে আসে হরদম। এসব ছাপিয়ে চাবাগানে আরো কিছু মানুষ থাকে, বলা ভাল ‘কুলিমজুর’। কাগজপত্রের ভাষায় চাশ্রমিক। সংখ্যায় এরা বেশি হলেও এদের কোনো হদিশ কোথাও রাখে না চাবাগান। পোকামাকড়ের মতো বাঁচে এরা। সারাজীবন চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব বুকের পাঁজরে বেঁধে চলে। মানে যোগ্যতমের টিকে থাকার সংগ্রাম। চাবাগানের মালিক আর প্রশাসক সকলেই এদের উপর জারি রাখে অদ্ভুতসব অন্যায় নিপীড়ন। হালের জঙ্গী হামলা এর কাছে যেন কিছুই না। একটু জোরে কথা বল্লেই মুখ সেলাই করে দেয়া হয়। বাচ্চারা যেন পড়তে না পারে বাগানের চৌহদ্দিতেই তাই কোনো স্কুল নেই। বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে যেন সবাই মরতে পারে তাই কোনো হাসপাতাল নেই। একটু বাজার বা সিনেমা দেখতে বাইরে যেতে চাইলে একটা রাস্তা পর্যন্ত বাগানে করতে দেয় না মালিক। আর হরদম মজুরি বন্ধ, রেশন বন্ধ কী বাগান বন্ধ এসবতো একেবারেই মালিকের মর্জির উপর নির্ভর। চাপাতা তোলা থেকে মেশিনঘর সবই যেন এক একটা বাইরের জগত থেকে সিলগালা করে দেয়া নির্যাতনের কামরা। সংসদ ভবন কী আর্মি ক্যাম্প থেকেও চাবাগানে আমজনগণের প্রবেশ কঠিন। কারণ চাবাগানের প্রবেশমুখেই লাগানো থাকে বিশাল নির্দেশ ’বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’। চাবাগানে কী হচ্ছে মূলত তা বাইরের মানুষের জানবার সাধ্য কই? যেমন ধরা যাক বৈকুন্ঠপুর চাবাগান, কী হচ্ছে এখানে? ২০১৬ সনের এপ্রিল মাস থেকে চাশ্রমিকদের মজুরি দিচ্ছে না বাগান। বাগান কর্তৃপক্ষ চার মাস ধরে ৪১৫ জন শ্রমিক ও ৮ জন স্টাফের মজুরি, রেশন ও ঔষধ সবকিছু বন্ধ রেখেছে। ৪ মাসের শ্রমিক মজুরি ৩৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, হাজিরা বোনাস ২০ লাখ টাকা, স্টাফদের বেতন ৩ লাখ ৫৯ হাজার ১৫ টাকা না দিয়ে বাগানের ম্যানেজার শাহজাহান ভুইয়া ও মালিক মুখার্জী কোম্পানি সকলেই গা ঢাকা দিয়েছে। কেবল সাপ্তাহিক তলবের মজুরিই নয়, ২৪ মাসের শ্রমিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের ২৫ লাখ ৫৬ হাজার ২৯ টাকাও বকেয়া রেখেছে বাগান কর্তৃপক্ষ।
২.
এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে এই চাবাগান কী বাংলাদেশে অবস্থিত? এই পৃথিবীতেই? নিদারুণ হলেও বৈকুন্ঠপুরের মতো চাবাগান গুলো এই পৃথিবীর। যে পৃথিবীতে মানুষ মর্যাদা আর মানবিকতার জন্য লড়ছে। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে ৯৫৫ একর ভূমি নিয়ে এই চাবাগান। কিন্তু একটা প্রশ্ন ওঠতে পারে, স্বাধীন দেশে এমন অজাচার আর অন্যায় কীভাবে চলছে? এখানে কী কোনো প্রশাসন নেই, আইনের বিচার নেই? আছে এখানে ইউনিয়ন পরিষদ আছে, উপজেলা প্রশাসন আছে, জেলা প্রশাসন আছে। এছাড়াও আছে শ্রম অধিদপ্তর, চাবোর্ড এবং চাশ্রমিক ইউনিয়ন। তাহলে চাবাগানে এরকম হচ্ছে কেন? হচ্ছে এটি মালিকপক্ষের মর্জি। কিংবা হয়তো ফিনলে, ডানকান কী ইউনিলিভারের মতো কর্পোরেট যে কোম্পানিরা চাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বৈশ্বিক ক্ষমতা বাহাদুরি বেশি। তারা হয়তো বাংলাদেশকে ‘থোড়াই কেয়ার করে’! কারণ এমন অনাচার বৈকুন্ঠপুর চাবাগানে আজই নতুনভাবে হচ্ছে না, গত ৬৬ বছর ধরেই এই বিচারহীন জুলুম চলছে। এর ভেতর ব্রিটিশ আমল, ভারতবর্ষ, পাকিস্তান, স্বাধীন বাংলাদেশ কত কিছু হয়েছে। কত সরকারের অদলবদল ঘটেছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রতিটি দেশে প্রতি সরকারের আমলেই চাবাগানগুলো বৈকুন্ঠপুর চাবাগান হয়েই টিকে আছে। চাবাগানে শ্রমিক বস্তি গুলি ঘুরলে আর যেকোনো বয়সের নারী কী পুরুষ চাবাগানি মানুষের সাথে কথা বল্লে যে কারো গায়ের পশম খাড়া হয়ে ওঠবেই। গরিব নিম্নবর্গের মুখের কথা অনেকের কাছে বিশ্বাস না হতেই পারে। তাহলে কষ্ট করে ১৯৫৭ সনের ১০ জুলাই তারিখের জনশক্তি পত্রিকার সংখ্যাটি আমাদের ঘাঁটতে হয়। পত্রিকা বের করেছিলেন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী। সংখ্যাটিতে ‘বৈকুন্ঠপুর বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা’ শিরোনামে পত্রিকাটিতে একটি খবর বের হয়। সেখানে লেখা আছে, ‘…মাধবপুর থানার অর্ন্তগত বৈকুন্ঠপুর বাগানের শ্রমিকের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হইতেছে। শ্রমিক পুরুষকে ১ টাকা এবং স্ত্রীলোককে মাত্র চৌদ্দ আনা দৈনিক হাজিরা দেওয়া হয়, কাজের সময় হাতিয়ার যথারীতি দেওয়া হয় না। গত সপ্তাহে কোদালী কাজ করার জন্য কতক মেয়েকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সকলকে কোদাল না দেওয়ায় ৩০/৪০ জন মেয়ে এদিন কোন কাজ করিতে পারে নাই। অন্য কোন কাজও মিলে নাই।’ এখন আমরা যদি ২০১৬ সনের জুলাই-আগষ্ট মাসের বাংলাদেশের পত্রিকা, অনলাইন ও টেলিভিশন গুলো দেখি তবে সেখানেও বৈকুন্ঠপুর চাবাগান নিয়ে এমনি অন্যায় অরাজকতা আর দু:সহ অবিচারের কথাই প্রচারিত হচ্ছে। তারপরও কিন্তু এসব গণমাধ্যমে সব অবিচার আর রক্তপাত ওঠে আসে না।
৩.
আজ মজুরি না পেয়ে, অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় বৈকুন্ঠপুর চাবাগানের ৬ জন মারা গেছে। চাশ্রমিক লক্ষীমণি ভূমিজ, নিতাই সাঁওতাল, বিষ্ণু কেওট, পবন সাঁওতাল, টিলা বাবু কাজী নজরুল ইসলাম শহীদ ও মরণ চক্রবর্ত্তী। চাবাগান কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অজাচারে এই মৃত্যু চাবাগানে নতুন কোনো ঘটনাই নয়। এটি চলমান। মৌলভীবাজার জেলার জুরী উপজেলার রতনা চা বাগান ২১/১২/২০০৪ সালে জোর করে বন্ধ করে দেয় বাগান কর্তৃপক্ষ। বাগান বন্ধকালিন দুই বছরে অনাহারে ও বিনাচিকিৎসায় মারা যান ত্রিশ জন চাশ্রমিক। গিধারি সূর্য্যবংশী(৭৫), জয়সিং নায়েক(৫৫), আসুলাল কল(৪০), মিটিকা নায়েক(৪০), শুকুরা গড়(৬৫), বাবনি রিকিয়াসন(৫৮), নেরেঙ্গিয়া রিকিয়াসন(৩৫), অভিমন্যু কর্মকার(৭৫), লবিন গঞ্জু(৫৭), কৃষ্ণ গঞ্জু(৫৬), নারায়ন শীল(৪৫), আরতী বুনারজি(১৮), ফাগু কর্মকার(৩৭), মণি নায়েক(২৬), নন্দ রাজগড়(৭০), ছটা উড়াং(৬০), ডিকা উড়াং(৬০), মদন উড়াং(৭০), বলুয়া উড়াং(৫৬), বেলা গঞ্জু(২৭), মজম্মিল মিয়া(৭০), রামধনী চাষা(৭৫), শিপুজন শীল(২৬), অতুল সাঁওতাল(৩৬), সজিতা বুনারজি(১৮), আলমতি বুনারজি(৩৫), রুনা পাত্রমুঢ়া(২৮), লাইলী বেগম(১৮), দিপতি নায়েক(২৮), প্রেমদাস সূর্য্যবংশী(৩০)। মজুরি ও বাগান বন্ধ করবার ভেতর দিয়ে চাবাগানে এই যে লাগাতার শ্রমিক হত্যার ঘটনা তা আমরা কতজন জানি। জানিনা রাষ্ট্রের আইনব্যবস্থা চাশ্রমিকদের এমনসব করুণ মৃত্যুকে কীভাবে আখ্যা দিবে? এগুলো কী ‘বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড’, ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ নাকি ‘জোরপূর্বক খুন’?
৪.
এমন অবস্থায় চাবাগান গুলোতে কী ঘটে? চাশ্রমিকেরা চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব নিয়েই ঘুরে দাঁড়ান। মর্যাদা আর মানবিকতার জন্য টিকে থাকবার সংগ্রাম করেন। বৈকুন্ঠপুর চাবাগানের মানুষেরাও অনাহারী অসুস্থ শরীর নিয়ে মরনপণ আন্দোলনে নেমেছেন। বাগানে বাগানে বৈঠক, মিছিল, আলোচনা, ঘেরাও, স্মারলিপি পেশ চলছে। ১০ জুলাই বাংলাদেশ চাশ্রমিক ইউনিয়ন, বাগান মালিক ও উপ-শ্রম অধিদপ্তরের এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে চাবাগান মালিক সকল সমস্যার সমাধান করবেন বলে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করলেও এখনও সংকট কাটেনি। ১৪ আগষ্ট হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় ঘেরাও ও মানববন্ধন করেছেন চাশ্রমিকেরা। ইতোমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক বাগান পরিদর্শন করেন এবং অবিলম্বে এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষকে আহবান জানান। কিন্তু মালিকপক্ষ কারো কথাই শুনছে না। শ্রমিক, প্রশাসন, মানবাধিকার কমিশন, শ্রমিক ইউনিয়ন কী শ্রম অধিদপ্তর। মালিকপক্ষ যাতে চাশ্রমিকদের বকেয়া মজুরি-ভাতা দ্রুত দিতে বাধ্য হয় এ ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। ছয়টি মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। কেবলমাত্র বকেয়া মজুরি মিটিয়ে দিলেই এ সংকট কাটবে না, রাষ্ট্রকে বৈকুন্ঠপুরসহ দেশের সব চাবাগানের কথা ভাবতে হবে। এখানে বিদ্যমান শোষণ, বঞ্চনা ও অজাচার সমূলে দূর করতে হবে। কারণ ১৬০টি চাবাগানের মালিক আর কিছু চা কোম্পানি তো বাংলাদেশ চালায় না, বাংলাদেশের মালিক চাবাগানের শ্রমিকসহ দেশের জনগণ।
লেখক ও গবেষক। [email protected]