পাহাড়ে শান্তি এখনো অধরা
বিপ্লব রহমানঃ
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূলে রয়েছে ভূমি। আর পাহাড়ের ভূমির সমস্যার সমাধানে শান্তিচুক্তির আলোকে প্রায় এক যুগ আগে গঠিত হয়েছিল ভূমি কমিশন। কথা ছিলো, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এ কমিশন পাহাড়ে ভূমির সমস্যার সমাধান করবে, স্থাপন করবে শান্তি। কিন্তু খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, এখনো এ কমিশন রয়েছে কাগুজে। ফলে পাহাড়ি-বাঙালির ভূমির বিরোধ বাড়ছেই। শান্তিচুক্তির এই মৌলিক শর্তসহ আরো কয়েকটি শর্ত পূরণ না হওয়ায় পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা রয়েছে এখনো অধরাই।
এমনই নির্মম বাস্তবতায় ২ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি। ১৯৯৭ সালের এই দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারেরর সঙ্গে পাহাড়িদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির আওতায় অস্ত্র সমর্পন করে সমিতির সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর প্রায় দুহাজার সদস্য। এক যুগের গ্লানিময় জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফেরেন প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়ি শরণার্থী। অবসান ঘটে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সেনা বাহিনীর প্রায় আড়াই দশকের সশস্ত্র সংঘাতের।
চুক্তির ফলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সৃষ্টি হয় ব্যাপক আশাবাদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় শান্তিচুক্তির কারণে ইউনেস্কোর শান্তি পুরস্কারও লাভ করেন। কিন্তু দৃশ্যতঃই পাহাড়ে ভূমি সমস্যাসহ চুক্তিতে বলা আরো নানা সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে পার্বত্য সমস্যাও হচ্ছে জটিল থেকে জটিলতর।
সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের বদলে চুক্তি বিরোধী ভুমিকা নিয়ে জুম্ম (পাহাড়ি) জাতিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে।’
শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা এ কথা বলেন। শান্তিচুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাঙামাটি থেকে ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সাবেক এই গেরিলা নেতা।
‘শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে পাহাড়ে চলমান অসহযোগ কর্মসূচি’র কথা উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে সরকার যদি রাষ্ট্রযন্ত্র ও অস্ত্র শক্তি ব্যাবহার করে জুম্ম জনগণের গণত্রান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন-পীড়ন করতে থাকে, তাহলে জুম্ম জনগণের পেছনে ফেরার পথ থাকবে না। জুম্ম জনগণ আরো কঠোর ও কঠিন কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।’
আর সরকার পক্ষ বরাবরই বলছে, শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। চুক্তির অনেক শর্তই পূরণ করা হযেছে। বাদবাকীগুলোও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।
শুভংকরের ফাঁকিতে ভূমি কমিশন
সরেজমিনে খোঁজ-নিয়ে জানা যায়, শান্তিচুক্তির প্রধানতম শর্ত মেনে গঠন করা পার্বত্য ভূমি কমিশন পড়েছে শুভংকরের ফাঁকিতে। গঠনের পর থেকে পার্বত্য ভূমি কমিশন এ পর্যন্ত একটি ভূমির বিরোধও নিস্পত্তি করেনি! খাগড়াছড়িতে কমিশনের অফিস থাকলেও অন্য দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানে এর অফিসও নেই। নেই পর্যাপ্ত লোকবল, তহবিল। যথাযথ আইনের অভাবে কমিশনটি একেবারেই পরিনত হয়েছে কাগুজে দলিলে।
আর কমিশনকে আইনী ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে গত আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আবারো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দফায় দফায় হয়েছে অসংখ্য বৈঠক, আলোচনা, পত্র বিনিময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব উদ্যোগই হয়েছে নিস্ফল। আর এ সুযোগে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে পাহাড়ে বেড়েছে ভূমির বিরোধ। এ নিয়ে সেখানে একের পর এক সহিংসতাও হচ্ছে। ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি পাহাড়ি-বাঙালির।
ঢাকার সংবাদ সম্মেলনে সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা জানান, চুক্তির অন্যতম মৌলক শর্ত ভূমি কমিশন নিয়ে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিস্তর বৈঠক হয়েছে। কিন্তু একটি যথাযথ আইনের অভাবে কমিশন গঠনের প্রায় একযুগ পরেও তা কাজই শুরু করতে পারেনি। আর কার্যকরী কমিশন আইন তৈরি করতেই পেরিয়ে গেয়ে ১৪ বছর। এখনও এটি সংশোধিত আকারে পাশ হয়নি। সংশোধিত ভূমি কমিশন বিল, ২০১৩ এখনো রয়েছে খসড়া আকারেই।
সরকারের কঠোর সমালোচনা করে সন্তু লারমা বলেন, ‘তারা পার্বত্যবাসীর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে।’
সরকারের কাছে জনসংহতি সমিতি বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরে। এসব দাবির মধ্যে আছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে দ্রুত কর্ম পরিকল্পনা নেওয়া, আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করা, চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি কার্যকর করা, সংশোধিত আইন পাশ করে ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করা, পার্বত্য এলাকার জন্য নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ইত্যাদি।
সরেজমিনে জানা যায়, চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতি’ অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হলেও এ পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে প্রতিনিয়তই পাহাড়ি-বাঙালি জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতও বাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশনের হিসেবে, শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে অন্তত ১৩টি রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে। এসব সংঘাতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই নির্মম হিংসার বলি হয়েছেন পাহাড়ি গ্রামবাসী। হিংসার অনলে পুড়েছে খাগড়াছড়ি, বাঘাইহাট, মাটিরাঙা, গুইমারা, তাইনদংসহ অসংখ্য পাহাড়ি জনপদ।
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান– এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন প্রায় পাঁচ হাজার ৯৩ বর্গমাইল। সেখানে রয়েছে ১২টি ভিন্ন ভাষাভাষি পাহাড়ি জনগোষ্ঠির বাস। পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে পার্বত্যাঞ্চলে লোক সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। পাহাড়ি-বাঙালি জনসংখ্যার অনুপাত ১৯৮১ সালে ৫৮ দশমিক ছয় শতাংশ ও ৪১ দশমিক চার শতাংশ, ১৯৯১ সালে ৪৯ ও ৫১ শতাংশ এবং সবশেষ ২০০১ সালের হিসাবে ৪১ শতাংশ ও ৫৯ শতাংশ।
বিপ্লব রহমান; লেখক ও সাংবাদিক
ছবি: পাহাড়ের কান্না, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, প্রসঞ্জিৎ চাকমা।