মতামত ও বিশ্লেষণ

আমার বন্ধু কার্ল মার্ক্সঃ ইমতিয়াজ মাহমুদ

(১)
বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো আজকে ১৯৯ বছর। ১৮১৮ সনের ৫ই মে তারিখে কার্ল মার্ক্সের জন্ম। সেই সময়ে রাইনল্যান্ডে জন্ম নিবন্ধন ব্যাবস্থা সেরকম ভাল ছিল না। কিন্তু একটা ঘটনায় মার্ক্সদের পরিবারের অনেকের জন্মতারিখ ইত্যাদি মোটামুটি নিখুঁত ভাবেই তদন্ত করে নিশ্চিত করা হয়। কার্ল মার্ক্সের এক ফুপু বেশ ভাল রকমের সম্পদ রেখে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু বরন করেন। ওর উত্তরাধিকারী কারা হবে সেটা নির্ধারণ করার জন্যে একরকম জুডিশিয়াল ধরনেরই একটা তদন্ত হয়। ফলে নিশ্চিত করেই কার্ল মার্ক্সের জন্মদিনটা বলা যায়। নাইলে সেসময়ে জন্ম নেওয়া অনেক বিখ্যাত জার্মান ব্যক্তিত্বেরই জন্ম তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। বিখ্যাত জার্মান কবি হেনরিশ হাইনের (নাকি হেনরিখ হাইনে?) জন্মতারিখ নিয়েও এরকম বিভ্রান্তি আছে।

কার্ল মার্ক্স আমার জন্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। খুব আপন মানুষ। সরদার স্যার যেরকম রুশোকে লিখেছেন ‘আমার বন্ধু রুশো’, একইরকমভাবে আমারও বলতে ইচ্ছা করে ‘আমার বন্ধু কার্ল’। কেননা আমি এই অধম ইমতিয়াজ মাহমুদ পৃথিবীকে দেখার একটা দৃষ্টি ধারণ করি যেটা কার্ল মার্ক্স দিয়েছেন। এইটা একরকম অন্ধকে দৃষ্টি দেওয়ার মতো। কেবল আমিই নই, সারা দুনিয়ার মানুষকেই দৃষ্টি দিয়েছেন কার্ল মার্ক্স। আমরা সকলেই জানি, আপনি ওঁর মতামত সমর্থন করেন বা না করেন, মার্ক্স যদি আপনি না জানেন তাইলে আপনাকে প্রপারলি শিক্ষিত লোক বলা যাবেনা।

আপনি লোকজনের মুখে মাঝে মাঝেই শুনবেন যে যেহেতু এই পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র টিকে থাকতে পারছে না সুতরাং মার্ক্সবাদ ব্যাপারটা এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে বা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে মার্ক্সবাদ ব্যাপারটাও এখন বাতিল হয়ে গেছে ইত্যাদি। এইধরনের কথা বেশ জনপ্রিয় বটে কিন্তু নিতান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত। অজ্ঞতাপ্রসূত বলছি কারণ পৃথিবীতে আজকে সমাজতন্ত্র থাক বা না থাক, মার্ক্স সাহেব মানব সভ্যতার ইতিহাস ব্যাখ্যা করার জন্যে এবং বিশ্ব দেখার জন্যে যে দৃষ্টিভঙ্গিটি বা পদ্ধতিটি আমাদেরকে দিয়েছেন সেটি তাতে ভুল হয়ে যায়না।

(২)
কি করেছেন কার্ল মার্ক্স? দ্বান্দিক বস্তুবাদ বলে একটা পদ্ধতি দিয়েছেন। এটা কি? এটা হচ্ছে দর্শন ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের একটি পদ্ধতি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে দ্বান্দিক বস্তুবাদ কি করে ভুল হলো? দ্বান্দিক বস্তুবাদ তিনি মানুষের ইতিহাস ব্যাখ্যায় ব্যাবহার করেছেন- ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে যেটাকে। তিনি দেখিয়েছেন যে মানুষের সভ্যতার এই পর্যন্ত যতটুকু বিকাশ হয়েছে তাঁর মুলে রয়েছে শ্রেণী সংগ্রাম। সমাজতন্ত্র কোথাও থাকুক আর নাই থাকুক, তাতে সভ্যতার ইতিহাসের এই ব্যাখ্যা কি করে ভুল হলো? তিনি দেখালেন যে পুজিবাদের বিকাশ সেই সময়ের জন্যে একটি অনিবার্য ও ইতিবাচক পরিবর্তনই ছিল। এটা কি করে ভুল হলো?

তিনি দেখালেন যে অর্থনীতি হচ্ছে সমাজের মৌল ভিত্তি এবং সংস্কৃতি হচ্ছে তার উপরি কাঠামো। এর নানারকম ব্যাতিক্রম সীমাবদ্ধতা অনেকে বলেছেন বটে, কিন্তু মোটা দাগে এই কথা তো সকলেই মানছেন। তিনি দেখালেন উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা প্রশ্নটিতেই শোষণের সূত্র।
স্পষ্ট করে দেখালেন উদ্বৃত্ত মূল্য কাকে বলে, আর কিভাবে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থায় পুঁজির মালিক উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ করে বা শ্রম শোষণ করে। এখানে ভুল কি আছে না আছে এটা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা তর্ক করুক, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে এর কি সম্পর্ক।

এবং মার্ক্স দেখালেন যে পুঁজিবাদের গর্ভেই এর বিনাশ করার শক্তি লালিত হয়। এবং তিনি বললেন যে মানুষের সভ্যতার চূড়ান্ত পর্যায় হবে সাম্যবাদ বা কমিউনিজম। মার্ক্সের মতে কমিউনিস্ট সমাজে রাষ্ট্র আইন এইসব কিছু থাকবে না, সব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই জায়গাটিতেই সকলে মার্ক্সের বক্তব্য মানতে চান না। মানতে চান না আর এটাকে ইউটোপিয় ধারনা বলেন। যারা এটাকে ইউটোপিয়া বলেন, ওরা সভ্যতার সেই পর্যায়টা নিজেদের চিন্তায় ধারণ করতে পারেন না বলে এরকম বলেন।

কিন্তু এইসব কোন কিছুর সাথে তো সেই অর্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের বা তার ব্যাখ্যার কোন যোগ নেই।

(৩)
না, এটা সত্যি যে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভিত্তি মার্ক্সবাদ এবং এর দর্শনও ছিল মার্ক্সবাদ। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট সমাজ বা সাম্যবাদী ব্যবস্থা ছিল না। কেননা পৃথিবীর একটি বা দুইটি দেশে আলাদা করে সাম্যবাদী সমাজ থাকতে পারে না। সম্যবাদে তো রাষ্ট্রই নেই। তাইলে সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণচীন, কিউবা, ভিয়েতনাম এরা কি ছিল? এইসব দেশে সমাজতন্ত্র ছিল। সমাজতন্ত্র কি? সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ নয়- সাম্যবাদে উত্থানের পথে একটা ধাপ হতে পারে মাত্র।

যেসব দেশকে আপনারা সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে ছিল বলে জানেন, সেসব দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল শ্রমিক শ্রেণীর দল- কমিউনিস্ট পার্টি। ওরা উৎপাদন যন্ত্রের রাষ্ট্রয় বা সামস্টিক মালিকানা, কেন্দ্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি এইসব করে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও সামগ্রিক বিকাশ নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নে এইসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যেও ভিন্নমত ছিল, একেক দেশে ওরা একেকরকম পদক্ষেপ নিত। এইসব দেশের মধ্যে অনেকখানেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতা হারিয়েছে, নানান কারণে হারিয়েছে।

কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে তো আর পুঁজিবাদ উত্তম ব্যবস্থা হয়ে যায়নি। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানার বলে পুঁজি তো এখনো উদ্বৃত্ত মূল্য বা শ্রম শোষণ বন্ধ হয়ে যায়নি। মার্ক্সের ব্যাখ্যা তো ঠিকই। পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদের বিকাশের মাঝখানে সমাজতন্ত্র একটা ব্যাবস্থা হিসাবে কার্যকর হয়তো এখন নেই, কিন্তু শ্রেণী সংগ্রাম তো রয়েই গেল। বরং সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেও এখন শোষণটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাইলে তো আমাকে আবার মার্ক্সের কাছেই ফিরে যেতে হচ্ছে, নাকি? মার্ক্সবাদ তাইলে অপ্রাসঙ্গিক কি করে হলো?

ভ্রান্তিটা ওরা কোথায় করে? ভ্রান্তিটা হচ্ছে মার্ক্সবাদকে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা আলাদা আলদা শাখায় বিভক্ত করে পাঠ করতে চায়। মার্ক্সবাদী অর্থনীতি, মার্ক্সবাদী সমাজবিজ্ঞান, মার্ক্সবাদী ইতিহাস এইভাবে। কিন্তু মার্ক্সের পাঠ তো এইভাবে হবে না। মার্ক্সবাদ হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞান বা একটি সম্পূর্ণ দর্শন যেটাকে আপনি খণ্ডিত আকারে বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টে ভাগ করে দেখতে গেলে হিসাব মিলবে না। এটা বিশ্বকে দেখার একটি সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি প্রাণময় বিজ্ঞান। সমাজকে পড়তে গিয়ে আপনি যখন মার্ক্সবাদ প্রয়োগ করবেন, তখন এটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ব-দৃস্টিভঙ্গি হিসাবেই প্রয়োগ করতে হবে। এইটা করেন না বলেই এই ভ্রান্তিটা হয়।

(৪)
এইখানে আমি মার্ক্সবাদের পাঠ নিয়ে বসিনি। (আমার বিদ্যার দৌড়ে সেটা কুলাবে না।) আমি কার্ল মার্ক্স, সাহস করে বলেই ফেলি, আমার বন্ধু কার্লএর শুভ জন্মদিন উপলক্ষ্যে ওঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে বসেছি। কিন্তু কেন জানিনা, আজকে কার্লের কথা বলার চেয়ে কার্লের প্রিয়তমা স্ত্রী জেনির কথা বলতে ইচ্ছা করছে বেশী।

তরুণ কার্ল মার্ক্স বন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে গেছে। তখন ওঁর বয়স আঠারো কি উনিশ, কার্ল প্রেমে পড়লো। কার্ল যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে সেই মেয়েটির নাম জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেন, কার্লের বড় বোনের বান্ধবী। জেনি কার্লের চেয়ে চার বছরের বড়। বিত্তবান অভিজাত ঘরের রূপসী কন্যা- ছিপছিপে আর লম্বা। সেসময়ের প্রুশিয়ার অত্যন্ত প্রভাবশালী এই ওয়েস্টফ্যালেন পরিবার- এদের এক বা দুই জেনারেশন আগের একজন বীর ইয়োরোপের সাত বছরব্যাপী যে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের একজন বড় সেনাপতি ছিলেন। জেনিকে কামনা করতো সব বিত্তবান ক্ষমতাবান অভিজাত পরিবারের তরুণ।

সেই জেনি বেচারা প্রেমে পড়লো পড়ুয়া টাইপ বিষয়বুদ্ধি নাই এরকম একটা ছেলের যে কিনা ওর চেয়ে চার বছরের ছোট। সবাই কি এটা মেনে নিবে? এই ভয়ে কার্ল আর জেনি পরিবারের সম্মতি নেয়ার আগে নিজেরা এঙ্গেজমেন্টটা সেরে নিয়েছে। এরপর ওরা গেছে জেনির পরিবারের কাছে বিবাহের অনুমতি নিতে। পাত্র পাত্রী দুইজনের পরিবারই অবশ্য বিশেষ কোন বেগড়বাই না করেই ওদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিল।

এই বেচারা জেনি মার্ক্সকে বিয়ে করে সারাটা জীবন দুঃখে কষ্টে কাটিয়েছে। কার্ল মার্ক্স তো খালি পড়ে, আর লেখে আর বিপ্লবী রাজনীতি সংগঠিত করতে চেষ্টা করে। কিছুদিন জার্মানিতে তো কিছুদিন ফ্রান্সে আর শেষ বিলেতে। টাকা পয়সা বিশেষ নাই। জেনি বেচারার ঘরে খাবার জোটে না, অসুখে চিকিৎসা জোটে না, প্রচন্দ শীতে ঘর গরম করার মতো একটু জ্বালানিও জোগাড় করতে পারেনা। জেনির কত কত দিন যে কেটেছে না খেয়ে। ওদের বড় বাচ্চাটা অসুখে মারা গেল, বাচ্চাটার জন্যে ওরা একটা জুতসই কবরও জোগাড় করতে পারলো না।

(৫)
মার্ক্সকে সারা দুনিয়া চিনে। পছন্দ না করুক, ঠিক মনে না করুক, কিন্তু মার্ক্সবাদ ব্যাপারটাকে কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না। মার্ক্স আছেন, মার্ক্স থাকবেন। কিন্তু মার্ক্সকে যে মেয়েটি মার্ক্স বানিয়েছে, টিকিয়ে রেখেছে, ওঁর মতো করে কাজ করতে শক্তি যুগিয়েছে, কার্ল মার্ক্সের সেই প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা অনেকেই জানেন না।

আজকে মার্ক্সের এই ১৯৯তম জন্মদিনে আজকে সকাল থেকেই আমার কেন জানিনা এই মেয়েটির কথাই শুধু মনে পড়ছে। শীর্ণকায় মেয়েটি, লন্ডনের তীব্র শীতে ছোট্ট একটা ঘরে ধুকছে, না আছে ঠিকমত পোশাক আশাক, না আছে ঠিকমত খাবারদাবার- কি অপার ভালোবাসায়ই না আমার বন্ধু কার্লকে এই মেয়েটি আঁকড়ে রেখেছিল। তোমাকে সালাম জেনি, লাল সালাম।

ইমতিয়াজ মাহমুদঃ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

Back to top button