আন্তর্জাতিক

সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০-এর চলমান রিভিউ নিয়ে আন্তর্জাতিক তিন সংগঠনের উদ্বেগ

আইপিনিউজ, আন্তর্জাতিক ডেক্স: আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ (এমআরজি), দি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইন্ডিজেনাস অ্যাফেয়ার্স (ইবগিয়া) ও ফিয়ান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) রেগুলেশন ১৯০০-এর চলমান জুডিশিয়াল রিভিউ (বিচারিক পর্যালোচনা), যা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সংগঠনগুলো বাংলাদেশ সরকারকে আদিবাসীদের অধিকারের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

“পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করুন” শিরোনামে এই আহ্বানটি প্রকাশিত হয় গত মঙ্গলবার (৯ জুলাই) এমআরজি’র ওয়েবসাইটে। এই আহ্বানের মূল অংশ নিম্নে দেওয়া হল-
মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ (এমআরজি), দি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইন্ডিজেনাস অ্যাফেয়ার্স (ইবগিয়া) ও ফিয়ান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) রেগুলেশন ১৯০০-এর চলমান জুডিশিয়াল রিভিউ (বিচারিক পর্যালোচনা), যার লক্ষ্য ইহার শব্দ বিন্যাসকে দুর্বল করা, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে, সে বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ (এছাড়াও রেগুলেশন) হল এই অঞ্চলের স্ব-শাসন ব্যবস্থার একটি স্তম্ভ, যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ আদিবাসীরা বাস করে এবং যেখানে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (সিএইচটি অ্যাকর্ড) স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও সহিংস সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের আদিবাসীরা কয়েক দশক ধরে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে, মনো-প্লান্টেশন (যেমন রাবার), রাস্তা নির্মাণ, পর্যটন, বাঙালি বসতি কর্মসূচি, জলাধার এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য তাদের পৈতৃক জমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে । এই ধরনের উচ্ছেদের সাথে জড়িয়ে রয়েছে গণহত্যা ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বেআইনি গ্রেপ্তার এবং আটক, এর পাশাপাশি রয়েছে ভূমি, খাদ্য, জল, বাসস্থান এবং একটি নিরাপদ পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর ও টেকসই পরিবেশ এর অধিকারসহ অন্যান্য মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি ঐতিহ্যগত আদিবাসী প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতায়ন করে, এবং জমি, সম্পদ ও পরিবার সম্পর্কিত প্রথাগত আইন ও অনুশীলনগুলিকে সমর্থন করে এই আদিবাসীদের এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে।

এটিই প্রথম নয় যে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ বিচার বিভাগীয় যাচাই-বাছাইয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৬ সালে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওয়াগাছড়া টি এস্টেট লিমিটেড বনাম মুহাম্মদ আবু তাহের ও অন্যান্য, ১৬ বিএলডি (এডি), ৩৬ (২০১৬) এর ক্ষেত্রে রেগুলেশনের বৈধতা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। পরবর্তীকালে, ২০১৭ সালে, একই বিভাগ বাংলাদেশ সরকার বনাম রাঙ্গামাটি ফুড প্রোডাক্টস এবং অন্যান্য ৬৯ ডিএলআর (এডি) (২০১৭) এর ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের রায়কে বাতিল করে, যা ২০০৩ সালে ১৯০০ রেগুলেশনকে একটি ‘মৃত আইন’ ঘোষণা করেছিল।

তবে, উল্লিখিত ঘোষণাগুলি বিধানটিকে আরও চ্যালেঞ্জ থেকে রক্ষা করেনি: ২০১৮ সালে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলা থেকে দুই জাতিগত বাঙালি সেটেলার, রেগুলেশন বহাল রাখার মামলা-আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন (সিভিল পিটিশন নং ৫৪/২০১৮ এবং ১৯২/২০১৮) দাখিল করেন।

২০২২ সালে, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল সিভিল পিটিশন নং ৫৪/২০১৮ এবং ১৯২/২০১৮ সমর্থন করেন এবং ২০২৪ সালের মে মাসে এই অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করে, পূর্বোক্ত রায়গুলি থেকে কিছু শব্দ বাদ দেওয়া জন্য অনুরোধ করেন। চ্যালেঞ্জ করা অংশটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘রাজা’ (ঐতিহ্যগত প্রধান) ও ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দগুলি, সেইসাথে অন্যান্য অনুচ্ছেদগুলি, যেগুলো প্রথাগত আইনের বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত।

মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে রেগুলেশনের বক্তব্যকে দুর্বল করার বর্তমান প্রয়াস পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ইতিমধ্যে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। যদি করা হয়, তাহলে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লংঘন যেখানে সাধারণ ঘটনা সেখানে এমন একটা দেশে আদিবাসীদের অধিকার অধিকতর উপেক্ষা করার পথ প্রশস্ত করে, প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলি রেগুলেশনের বৈধতাকে গুরুতরভাবে হ্রাস করবে।

ঐতিহ্যবাহী ‘রাজা’ শব্দটির স্থলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শব্দ ‘চীফ’এর প্রতিস্থাপন, প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, এইসব ঐতিহ্যবাহী প্রধানদের অধিকারে থাকা কর্তৃত্বকে কেড়ে নেয়ার একটি প্রচেষ্টা বলে প্রতীয়মান।
‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দটি বাদ দেয়াতে বিগত কয়েক দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাংলাদেশি আদিবাসীদেরকে প্রদত্ত আইনি অঙ্গীকারসমূহকে মুছে ফেলার বা অন্তত দূর্বল করার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে।
প্রথাগত আইনের প্রস্তাবিত অনুচ্ছেদ মুছে ফেলার ফলে সিএইচটি রেগুলেশন, ১৯০০ এর মূল বিষয়বস্তু বাতিল হয়ে যাবে, এর ব্যাখ্যা পরিবর্তন হবে এবং ফলস্বরূপ বৈধতা নিশ্চিত করে রায়ের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করা হবে। চ্যালেঞ্জ করা শব্দগুলোর সংশোধন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পরিচালনা করে এমন জটিল প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর একটি পতনমূলক প্রভাব ফেলবে, কোনো দৃঢ় আইনি যুক্তি ছাড়াই এর আদিবাসী অধিবাসীদের অধিকার খর্ব করবে।

বাংলাদেশ সরকার বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন করেছে এবং এইভাবে বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকারকে সম্মান, সুরক্ষা এবং পূরণ করতে বাধ্য। তাই তাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে অন্তর্ভুক্ত আইনি বিধান, এর চুক্তি সংস্থাগুলির সুপারিশ, সার্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা (ইউনিভার্সাল পিরিউডিক রিভিউ) এবং বিশেষ পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতাগুলি মেনে চলতে হবে এবং এর আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার সাথে কোনো রাষ্ট্রীয় আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিদ্যমান বিশিষ্টতা এবং চূড়ান্ত শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে, যা ১১ জুলাই ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে, আমরা:
● আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইনি মানদন্ডের বিধান, যেমন আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র, নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়ে কনভেনশন (সিডও), অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিইএসসিআর), নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর), গ্রামীণ এলাকায় কর্মরত কৃষক এবং অন্যান্য মানুষের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র (ইউএনড্রপ), একই সময়ে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, মেনে চলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি;
● পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বহু-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান ও রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি;
● আইএলও আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর কনভেনশন (নং ১৬৯), ১৯৮৯ অনুসমর্থনের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি;
● সুপারিশ জানাচ্ছি যে, অ্যাটর্নি জেনারেল যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সার্কেল চীফসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম-নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে যথাযথ পরামর্শ পূর্বক তাঁর অবস্থান পর্যালোচনা করেন;
● সুপারিশ করছি যে, আদালত যেন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের থেকে সহ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে বিশেষজ্ঞদের মতামত (যেমন অ্যামিকাস কিউরি ব্রিফ আকারে) চেয়ে নেন।

Back to top button