জাতীয়
সারাদেশে অব্যাহত নারী ধর্ষণ ও নিপীড়নের প্রতিবাদে আদিবাসী ছাত্র সমাজের প্রতিবাদ সমাবেশ

”যে রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা অভ্যুত্থানে লাঠি দিয়ে হাসিনাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো তাকে হামলার শিকার হতে হয় ঢাকার বুকে। তার মাথা ফেটে দেওয়া হয়েছে ঢাকার বুকে। এটাই কি নতুন দেশের পরিবর্তন? এটাই কি নতুন দেশ?”- সারাদেশে অব্যাহত নারী ধর্ষণ ও নিপীড়নের প্রতিবাদে ঢাকাস্থ আদিবাসী ছাত্র সমাজের প্রতিবাদ সমাবেশে এই প্রশ্ন রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসার।
১২ মার্চ ২০২৫ তারিখে বিকাল ৩ ঘটিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠনপূর্বক পাহাড় ও সমতলের নারী নিপীড়নের বিচার নিশ্চিত কর ও সারাদেশে অব্যাহত নারী ধর্ষণ ও নিপীড়ন এবং বান্দরবানের রোওয়াংছড়িতে এক আদিবাসী নারী ধর্ষণের প্রতিবাদে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছে ঢাকাস্থ আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হ্লামংপ্রু মারমার সঞ্চালনায় উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা। সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক নুমংপ্রু মারমা,বাংলাদেশ মাহাতো আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের সভাপতি শুভ্রময় মাহাতো, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য কোলি চাকমা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি মিশাল ত্রিপুরা, পায়া ম্রো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুর্মি চাকমা ও স্নেহলাল তঞ্চঙ্গ্যা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, আজ সারাদেশে কি হয়েছে? ধর্ষণ বেড়েছে। কি হয়েছে? আদিবাসীদের উপর হামলা বেড়েছে। আমরা প্রতিবার প্রতিটি সমাবেশ থেকে নিপীড়নের কথা বলেছি। প্রতিবার হামলা নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে হয়েছে। এই জন্যই কি গণঅভ্যুথান হয়েছে? যে রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা অভ্যুথানে লাঠি দিয়ে হাসিনাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো তাকে হামলার শিকার হতে হয় ঢাকার বুকে। তার মাথা ফেটে দেওয়া হয়েছে ঢাকার বুকে। এটাই কি নতুন দেশের পরিবর্তন? এটাই কি নতুন দেশ? সংগ্রামী বন্ধুগন, দেশে যখন আদিবাসীরা নিরাপদ মনে করেন, নারী শিশুরা যখন নিরাপদ মনে করেন তখনই দেশে সুশাসন চলছে বলা যায়।
তিনিও আরও বলেন, কেউ কেউ গণঅভ্যুথানের মালিকানা দাবি করে। যখন এই রাজু থেকে শহীদ মিনারে হাসিনার পতন চাওয়া হয় ৭১ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে তখন আপনারা কই ছিলেন? এই মালিকানা রুপাইয়ারও, এই মালিকানা অং মারামারও । তাহলে তাদের উপর সরকার বাহিনী কেন হামলা করলো? আপনারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহুত্ববাদ চান আবার আপনারা প্রথমেই বলেন আমি মুসলমান, তারপর বলেন আমি পুরুষ। এরকম দাবি করে আপনারা কেমন বহুত্ববাদ স্থাপন করতে চান?
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে ভারসাম্যহীন এক জুম্ম কিশোরীকে এক সেটেলার কর্তৃক ধর্ষণ ঘটনা সেনাবাহিনী ৫টি গ্রামের কার্বারিকে ডেকে জোরপূর্বক সই নিয়ে ৪০০০০ টাকা জরিমানার বিনিময়ে মীমাংসা করে দেয় । এ খবর কোন জাতীয় পত্রিকায় আসে নাই। তিনি সেনাবাহিনীর এহেন আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।
তিনি আরও বলেন, গত ১৫ জানুয়ারি স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামে মৌলবাদী সংগঠন কর্তৃক আদিবাসীদের উপর ঢাকার বুকে হামলার ঘটনায় মূল হোতাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় নি এবং যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এইসব বিচারহীনতার সংস্কৃতি ২৪ অভ্যুথানের স্পিরিটকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা জন্য আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি করে আসছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি তুলে আসছে। কিন্তু কোন সরকার সেটিকে আমলে নেই নাই। সরকার, রাষ্ট্রের এই দ্বিচারিতা আচরণ কারোর জন্য ভালো হবে না।
বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক নুমংপ্রু মারমা বলেন, গণঅভ্যুথাণের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছে। যত্রতত্র নারী ওপর সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্চে। শিশুরাও ছাড় পাচ্ছে না। এক সেটেলার কর্তৃক এক জুম্ম প্রতিবন্দী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর চেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হলো সরকার বা দেশের দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তাদের নিরব ভূমিকা পালন করেছে, যেটি এই ধর্ষকদের সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছে এইসব অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ মাহাতো আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের সভাপতি শুভ্র মাহাতো তার বক্তব্যে বলেন, আমরা বর্তমানে সবসময় আতংকে বাস করছি। প্রতিনিয়ত শিশু ,নারীসহ ছেলে-পুরুষ সকলে প্রতিনিয়ত হয়রানি, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমরা এর সুষ্ঠ তদন্তপূর্বক শাস্তি কামনা করছি।
হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগরের সদস্য কলি চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অসংখ্য নারী ও ছাত্রী অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তুু আজ অভ্যুত্থান পরেও নারীদেরকেই আগের মতোই হেনস্তা,নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। আমরা মনে করি বিচারহীনতার সংস্কৃতিই নারী নিপীড়ন, ধর্ষণের মতো ঘটনার অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কারণে নারী সহিংসতা, ধর্ষণ, খুন, ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালী ও নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার জুম্ম নারীরা অন্যতম ভুক্তভোগী।
পাহাড়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বড় একটি উদাহরণ কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা। দীর্ঘ ২৮ বছর পর রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি অবশেষে খারিজের আদেশ দেয়। চলমান নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা, নিপীড়ন, ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা এবং সকল ঘটনার বন্ধের জন্যে এই অন্তর্বতীকালীন সরকারকে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে ও সকল অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং সমতল আদিবাসীদের পৃথক মন্ত্রণালয় ও পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করার দাবি জানান।
ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মিশাল ত্রিপুরা তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, আমরা এমন একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করছি যেটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এবং সরকার প্রধান নোবেল প্রাপ্ত শান্তির জন্য। কিন্তু দেশে কোন শাান্তির সুবাতাস নাই। দেশ একটি মালবাদীদের দখলে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী স্নেহলাল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, দেশে যে ধর্ষণ ঘটনা চলমান সেটি প্রতিরোধ করতে গেলে শুধুমাত্র আইন প্রনয়ন করলে হবে না। আইনের দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ করতে হবে যাতে ভবিষৎতে কোন মানুষ ধর্ষণ করার সাহস না পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সুর্মি চাকমা বলেন, সমগ্র দেশে নারী এবং শিশুদের উপর যে সহিসংতা চলছে তার প্রতিবাদে আমরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে। গতকাল রোওয়াংছড়িতে একজন জুম্ম প্রতিবন্দী নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্যি যে সমতলে যেরকম নিউজে ফোকাস পাই নাই। কোন গোষ্ঠীকে ভয় না পেয়ে সত্য ঘটনাকে তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকদের আহবান জানান।
সমাবেশের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, রোয়াংছড়ির ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর যে অপচেষ্টা তার মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট হলাম দেশে ২ রকমের শাসন ব্যবস্থা চলমান। সারা দেশে চলছে গণতান্ত্রিক সরকাররে শাসন ব্যবস্থা আর পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে সেনাশাসন। যেটি একটি দেশের ভালোর জন্য কখনোই কাম্য নই। আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের একটি মোলবাদী গোষ্ঠী এবং এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলার চেষ্টা করে ধর্ষণের একমাত্র কারণ তাদের পরিধান করা পোষাক। কিন্তু যে মেয়েটি বোরকা পড়া অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হলো, যে বাচ্চাটি ধর্ষণের শিকার হলো সেটি কিভাবে ব্যাখা করবেন? আমরা মনে করি কাপড় নই আপনাদের মন মানসিকতা পরির্তন জরুরী। তিনি নারী নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে আহবান জানান।
সমাবেশ শেষে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি অপরাজেয় বাংলা ও শাহবাগ ঘুরে এসে আবার রাজু ভাস্কর্যে পাদদেশে শেষ হয়।