সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে ঢাকায় আলোচনা সভা
"বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে সবারই একধরনের ঐকমত্য আছে যে, এই দেশে আদিবাসী নেই সেটি প্রচার করতে হবে”- ড. ইফতেখারুজ্জামান

আইপিনিউজ বিডি, ঢাকা: আজ ২০ জুন ২০২৫, শুক্রবার, ঢাকার ধানমন্ডির উইমেন্স ভলান্টারী এসোসিয়েশন মিলনায়তনে (ডব্লিউভিএ) ‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে করণীয় শীর্ষক” এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরন মিত্র চাকমার সঞ্চালনায় উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সভাপতি অজয় এ মৃ। আলোচনা সভায় নির্ধারিত বিষয়বস্তুর উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আদিবাসী অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা।
প্রধান আলোচক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্মতি ছিল তাই বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সকল পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে আমরা দেখি সামরিক ও বেসামরিক আমলা ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে পাওয়া চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে পাহাড়ের মানুষ প্রতারিত হয়েছে। এই সরকারও আদিবাসীদের প্রতি আগের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা জারি রেখেছে। সম্প্রতি চিংমা খিয়াং সহ এইদেশে আদিবাসী নারীদের উপর সংঘটিত সহিংসতার একটিরও সুষ্ঠু বিচার পায়নি আদিবাসী জনগণ। আইন, সমাজ থেকে শুরু করে নিজ ধর্ম পালনেও বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করা শুরু করেছে। বর্তমানে মায়ানমার সম্পর্কে সরকারের যে সিদ্ধান্ত তা ঠিক হচ্ছে না। যেখানে নিজের রাষ্ট্রের মধ্যেই এত মানবিক বিপর্যস্তটা বিরাজমান, তার দিকে সরকারের খেয়াল নেই। আমি বিশ্বাস করি যে এই দেশের অবস্থা বদলাবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন- এই দেশটি বদলাতে বদলাতে আদিবাসীরা এই দেশে থাকবে কিনা? এই রাষ্ট্র তাঁদেরকে থাকতে দিবে কিনা! সরকার দেখায় এখানে পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। আদিবাসীরা সুখে আছে। সমতলে কয়েকবার জরুরি অবস্থা জারি করার পর আপনারা এখানকার পরিস্থিতি দেখেছেন। কিন্তু সেই অনেক আগে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জরুরি অবস্থা চালু রয়েছে। এইদেশে একপ্রকার বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চলমান রয়েছে। পাহাড়ের ও সমতলের আদিবাসীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েই বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজ এই দেশে ভালোভাবে বসবাস করতে চায় কিন্তু আদিবাসীদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যাতে অন্য পথে ধাবিত হতে বাধ্য করা না হয় এই বক্তব্য রাখেন তিনি।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এইদেশে মিডিয়ার উপর হস্তক্ষেপ করার কর্তৃপক্ষ আছে। বাংলাদেশে আদিবাসী নেই এটি আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার করতে পারলেই প্রত্যেক সরকারের লাভ হয়। বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের ঐকমত্য আছে যে, এই দেশে আদিবাসী নেই সেটি প্রচার করতে হবে। আদিবাসীদেরকে নিম্নতর পর্যায়ে ফেলে দেওয়ার জন্য এখানে শাসনতন্ত্রে এক ধরনের ঐক্যমত্য রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকগুলো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন খাতে সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অন্তর্বতীকালীন সরকারের পিছনে যারা সবচেয়ে শক্তিশালী পিলার হিসেবে কাজ করছে তারা আদিবাসী বিষয়টি মানতে পারেন না। বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। সেটি হচ্ছে সেনাশাসনব্যবস্থা। আপনারা আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসনব্যবস্থা না চাইলেও এইটাই বাস্তব যে সেখানে সেনাশাসনব্যবস্থাই থাকবে। বাংলাদেশে সেনাবাহিনী জাতিসংঘের মিশনের মাধ্যমে অন্যদেশে যদি শান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে না! সেখানে কেন সেনাশাসন এখনও বিদ্যমান রেখেছে! তিনি আরও বলেন, আদিবাসীদেরকে আরও সচেতন হতে হবে এবং এইটা শুধু আদিবাসীদের অধিকারের বিষয় না, এইটা পুরো বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার হিসেবে ভাবতে হবে। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে পতন ঘটিয়ে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়াটা উচিত না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ২৪’র গণঅভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশ ও আগের বাংলাদেশ এক না। এখানে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আমি আশা করি, আদিবাসীদের জন্য আমাদের যে লড়াই তা বৃথা যাবে না। আমরা সবসময় একটি যুদ্ধের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমি গণঅভ্যুত্থানে যে আশাবাদগুলো দেখেছি তা এখন অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। আপাতত দৃষ্টিতে দেখলে এটিই মনে হবে যে আদিবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে, কিন্তু আসলে শাসকগোষ্ঠী প্রতারণাটি নিজেদের সাথেই করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে যদি সীমাবদ্ধতা থেকে থাকে, তাহলে আমরা সেগুলো নিয়ে পুনরায় আলোচনা করব। আমরা ভেবেছিলাম এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আদিবাসীদের সমস্যাগুলোকে আদিবাসীদের লেন্স দিয়ে দেখবেন। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। আমরা যদি তাঁদের লেন্স দিয়ে দেখি তাহলে তারা এই সরকারের আমলেও কিছুই পায়নি বরঞ্চ তাঁরা নিপীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ কমিউনিস্টি পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ৩৩ বছর আগে লোগাং গণহত্যার প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশে তরুণদের যে টগবগের চোখ আমি দেখেছি, সেই দ্রোহভরা চোখ আমি এখনকার সকল আদিবাসী তরুণদের চোখে দেখি। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সমস্যাকে লাঘব করার জন্য আমরা মনে করি তা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা সেটা মনে করে কিনা এইটাই আসল কথা। তিনি আরও বলেন, ড. ইউনূস পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে আগামীর শাসকদের জন্য রাখতে চান, কিন্তু রাখাইনের মানবিক করিডোর করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পুরাপুরি বাস্তবায়ন করতে না পারেন, অন্তত সেই বিষয়ে একটি পদক্ষেপ নেন। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন ভূরাজনীতির জায়গায় একটি বিশেষ অঞ্চল। সেখানকার অবস্থা ভালো না থাকলে, পুরো বাংলাদেশও ভালো থাকবে না।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমি যখন প্রথম আলোতে কলাম লেখতাম তাতে আমি লিখতাম, ”একটা দেশ কতটা মানবিক, গণতান্ত্রিক সেটা বুঝতে হলে একজন আদিবাসী মানুষকে , চা বাগানের শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করতে হবে। একটি দেশে পিছিয়ে পড়া মানুষরা যদি ভালো থাকে, তাহলেই বুঝবেন দেশের সকল মানুষ ভালো আছে।” ছয়টি সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের কথাগুলো অন্তত এসেছে। আমি আশা রাখব আগামীতে যে সরকার আসবে তারাও যাতে আদিবাসীদেরকে মনে রাখে। রাষ্ট্র এখন অনেক শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র যখন দানবের মত আচরণ করে তখন সেখানকার নাগরিকদের যাওয়ার মতো কোনো জায়গা থাকেনা। বাংলাদেশও আদিবাসীদের জন্য ঠিক তাই। বর্তমানে যারা নতুন স্বপ্নের কথা বলেন, তাদেরকে অবশ্যই এইদেশের আদিবাসী সহ সকল প্রান্তিক মানুষদের মানবাধিকারের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি হচ্ছে শাসন প্রণালীর সমস্যা। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কমিশনের রিপোর্টের মাধ্যমে যে বিষয়টা উঠে এসেছে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে স্বৈরতন্ত্রের উপস্থিতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ইনার লাইন রেগুলেশন ছিল সেটা ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বন্ধ করে দেয়। তারপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধ স্থাপনের মাধ্যমে সেখানকার জুম্ম আদিবাসীদের সুখকে হরণ করার মধ্য দিয়ে এখনও পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে এখন একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চালু রেখেছে এই রাষ্ট্র। চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না তার অন্যতম একটি কারণ হল বাঙালীদের মন-মানসিকতা। বাংলাদেশে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া অনেক দলই পার্বত্য চুক্তি ও আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে সচেতন না।
স্বাগত বক্তব্যে ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, ১৯৭৬-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। কিন্তু বর্তমানে সেই চুক্তিকে ভুলিয়ে দিতে চায় এই রাষ্ট্র। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনা শাসনের হাতে না রেখে সিভিল প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। আমাদেরকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদেরকে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বর্তমানে গুম, খুন সম্পর্কীয় যে কমিশন করা হয়েছে সেই কমিশনের কোনো কাজ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকারও জনগণের সরকার হিসেবে হয়ে উঠতে পারছে না। পরিশেষে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সভাপতি অজয় এ মৃ বলেন, আদিবাসী অধিকারের আন্দোলনের সাথে আদিবাসীবান্ধব অনেক মেইনস্ট্রিমের মানুষ আছে বিধায় আমাদের অধিকারের আন্দোলনগুলো এখনও অনেক জোরালো হয়। তিনি তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে আন্দোলনে আরও জোরালোভাবে সাথে থাকার জন্য প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আদিবাসীদের বিষয়ে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আলোচনা সভাটি সমাপ্ত করেন।