সাংবিধানিক স্বীকৃতির জিজ্ঞাসা ও আদিবাসী “সাঁওতাল” – জন হেম্ব্রম
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের দেশ। বৈচিত্রময় জাতিসত্তার বসবাস রয়েছে এদেশে। ১২ এপ্রিল ২০১০, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত গেজেটে ২৭ টি বৈচিত্রপূর্ণ জাতির কথা উল্লেখ থাকলেও পরবর্তীতে পূর্বের তফসিলে সংশোধন করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয় ২৩ মার্চ ২০১৯ এ প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে ৫০ টি জাতিগোষ্টীরে নাম উল্লেখ করা হয়। যারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্রময় করে তোলেছে। এদের রয়েছে বৈচিত্রপূর্ণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। নিজস্ব ভাষা, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব, গান, নাচ, গাম-কুদুম প্রত্যেক জাতিকে অনন্য করে তোলেছে। রাষ্ট্র সংবিধানিক নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশে বসবাসরতঃ সকল মানুষের আধিকার নিশ্চিতে বদ্ধ পরিকর। দেশের নাগরিক হিসেবে আদিবাসীদের এই বৈচিত্রপূর্ন ঐতিহ্যবাহী সংষ্কৃতি লালন, পালন এবং সংরক্ষেন সহ সকল নৈতিক অধিকার সংরক্ষনের দ্বায়িত্ব হল রাষ্ট্রের। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত নয়। তাই আদিবাসীদের ন্যায্যতা ও অধিকার নিশ্চিতে সংশয় থেকে যায়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হলেও ন্যায্যতার দাবি আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানে আদিবাসীরা এখনো রাজপথে আন্দোলনরতঃ। গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওমালীগ সরকারের পতন ঘটে। সকল বৈষম্য মুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ তথা রাষ্ট্র সংষ্কারের যে স্বপ্ন দেখে ছাত্র-জনতা, আমি বিশ্বাস করি উক্ত নতুন বাংলাদেশে আদিবাসীরা যথযথ মূল্যায়ন পাবে।
বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র তৈরির প্রথম থেকেই এসকল বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে অস্বীকার করে আসছে। সেইসাথে বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে অনেক আইনে ও সরকারী দলিলে এসব জাতিগোষ্ঠী সমূহকে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার রয়েছে বা ব্যবহার হয়ে আসলেও বর্তমানে তাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬-এর ২ ধারায় উল্লেখ করা হয়- জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি বলে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া বাঙালি ব্যতীত অন্য যারা আছে তারা উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে পরিচিত হবে। এছাড়া ২৩ ক। তে- “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ঠপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষন, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহন করিবে”।পরবর্তীতে সংবিধান-এ আদিবাসী শব্দটি না থাকায় বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কাছে স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উদ্যাপনে সরকারের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া ৯ আগস্ট ২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়। এছাড়া সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি ২০১১ সালে ঢাকায় বিদেশী কূটনীতিকদের আহবান জানিয়েছিলেন যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ”ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর” জনগণকে যাতে ”আদিবাসী” বলা না হয়।
অথচ, দেশের আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ১৯৫৭ সালে প্রবর্তিত আইএলও কনভেনশন-১০৭ (Convention concerning the Protection and Integration of Indigenous and Other Tribal and Semi-Tribal Populations in Independent Countries) বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২ জুন অনুমোদন (ratify) করে। এই কনভেনশনের মূল প্রতিপাদ্য অনুযায়ী বৈচিত্রময় জাতিসত্তাকে দেশের মূলধারার সমকক্ষ হতে সহায়তা প্রদানের ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। এই কনভেনশনটিকে বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়ন আনয়নে একটি কাঠামো এবং আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে কনভেনশন-১০৭ রিভাইস করে আইএলও কনভেনশন ১৬৯ প্রবর্তন করা হলে বাংলাদেশ তা অনুস্বাক্ষর করেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এদেশে যে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠীর সম্মান এবং তাদের মর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত এর জন্য কনভেনশন ১৬৯ অনুস্বাক্ষরের এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারন আই এল ও কনভেনশন নং ১০৭ এবং ১৬৯ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক আইনী দলিল, যা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকরী করা সহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে বাংলাদেশ বর্তমানে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তার প্রয়োজনীয় রূপরেখা প্রদানে সহায়তা করে।
অন্যদিকে, ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক যে ঘোষণাপত্র (United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples) গৃহীত হয়, সেখানে প্রস্তাবের পক্ষে ১৪৩টি দেশ ভোট দিলেও, বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। স্মরণযোগ্য যে, ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং ৩৪টি দেশ ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থাকে। ৪টি দেশ যথা- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়।
আইএলও কনভেনশন-১৬৯-এর মূল প্রতিপাদ্য অনুযায়ী কোনো অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীই ঐ অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী (Indigenous Population) । সব ক্ষেত্রেই এই জনগোষ্ঠীকে দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে। এ ছাড়া আত্মপরিচয় নিরূপণের ক্ষেত্রে তারা ভিন্নতর বলে বিবেচিত হবে এবং নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে তাদের বিবেচনা করতে হবে।
Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169) – এর আর্টিকল ১ এর (a)-তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘tribal peoples in independent countries whose social, cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulations’’. অর্থাৎ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়।
এখন আমরা ইনডিজিন্যাসের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করব। Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)– এর আর্টিকল ১-এর (b)তে ইনডিডজিন্যাস বা আদিবাসীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, `peoples in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization or the establishment of present state boundaries and who, irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions’. অর্থাৎ “আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া ও উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে। এবং যারা তাদের কিছু বা সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে “। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদিবাসী জনসংখ্যাকে নিম্নরূপ সংজ্ঞায়িত করে: “যে সম্প্রদায়গুলো ভৌগলিকভাবে স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাহী বাসস্থান বা পূর্বপুরুষের অঞ্চলগুলির মধ্যে বসবাস করে বা সংযুক্ত থাকে ও যারা নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অংশ হিসাবে চিহ্নিত করে, এই অঞ্চলে উপস্থিত গোষ্ঠীগুলো থেকে বংশোদ্ভূত।
উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষন কররে দেখা যায়, আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে এবং দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত। অথাৎ দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে এবং তারা বংশপরম্পরায় তাদের ঐতিহ্য সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে লালন ও পালন করে আসছে।
শামীম আরা বুলবুল (প্রধান শিক্ষক- মেলাগাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বোচাগঞ্জ, দিনাজপুর) শিক্ষক বাতায়নে উল্লেখ করেন- সাধারণত কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অণুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তারাই আদিবাসী। এছাড়া এক সময় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইলিরা দেওয়ান বিবিসি নিউজ বাংলাকে বলেন- সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের চেয়ে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও রীতি-নীতি আলাদা। “সেদিক থেকে অবশ্যই আমরা আদিবাসী। “আদিবাসী মানে হচ্ছে – মূলধারা থেকে যাদের ভাষা ভিন্ন এবং সংস্কৃতি ভিন্ন তাদেরকে আদিবাসী বলে। সে হিসেবে আমরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করছি।” কিন্তু ০৯ আগস্ট ২০২২ইং তারিখ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন, সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ উল্লেখ করেন- সমতলের উপজাতীয় সম্প্রদায় যেমন, সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিসত্তার বাংলাদেশে আগমনের ইতিহাস তিন-চারশত বছরের বেশি নয়। তার এই দাবির মাধ্যমে সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা, কোল সহ বৈচিত্রময় জাতিসমূহের প্রাক ঐতিহাসিক ইতিহাসকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে।
সাঁওতাল জাতিসত্তার একজন মানুষ হিসেবে আজকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির স্বপক্ষে কিছু বিষয়ভিত্তিক তথ্যসহ সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম-
বাংলাদেশে আদিবাসী স্বীকৃতির ক্ষেত্রে প্রথমেই বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ ১৯৪৭ পূর্ব ভারতবর্ষ। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে- সাঁওতাল হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষী জাতিগোষ্ঠী । সাঁওতালরা জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বৃহত্তম আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের উপস্থিতি আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও ওড়িশা রাজ্যেও রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগ ও রংপুর বিভাগের বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু। নেপালে বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে। সাঁওতালরা সাধারনত সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে, এটি অস্ট্রো-এশীয় পরিবারের তৃতীয় বৃহত্তম ভাষা। সাঁওতালদেরকে বিশুদ্ধ প্রাক-দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে মনে করা হয়।
সূফি বর্ষণ তার ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ সালের লেখাতে উল্লেখ করেন- অষ্ট্রিক জাতির সমসাময়িক বা কিছু পরে আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে এবং দ্রাবিড় সভ্যতা উন্নত বলে অষ্ট্রিক জাতি এদের মধ্যে মিলে যায় ॥ অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রনেই সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী। এদের রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহমান। ভারত উপমহাদেশে আর্যকরণ শুরু হয় প্রায় ১৫০০ খ্রি. পূর্বাব্দ থেকে। ইউরোপ থেকে আগত আর্যরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত পারস্য পেরিয়ে ভারতে আগমন করে। এ ব্যাপারে শ্রী অমিত কুমার বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘খৃস্টের জন্মের দেড় বা দুই হাজার বৎসর পূর্বে অর্থাৎ আজ হইতে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে ভারত বর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কাছে আর্য জাতির এক শাখা পশ্চিম পাঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয়। তাহাদের পূর্বে এদেশে কোল, ভিল, সাঁওতাল প্রভৃতি অসভ্য জাতি এবং দ্রাবিড় নামক প্রধান সুসভ্য জাতি বাস করতো। এছাড়া ৩/৪ হাজার বছর পূর্বে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে বাইরে থেকে একদল লোক আমাদের ভারতকে আক্রমণ করে গোটা ভারত দখল করে নিয়েছিল ৷ তারা নিজেদেরকে আর্য বলে পরিচয় দিয়েছিল ৷ ঐ আর্যরা হল বিদেশী ৷ ঐ বিদেশী আর্যরা ভারতে এসে ভারতীয়দেরকে আক্রমণ করে ভারতবাসীকে পরাজিত করে সম্পূর্ণ ভারতে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল ৷ তারা তাদের নিজেদের ‘আর্য ‘ নামে পরিচিত করেছিল আর, তাদের বিপরীত হিসাবে মূলনিবাসী ভারতবাসীদেরকে অনার্য নামে পরিচিত করেছিল ৷ অনার্যরাই হল শূদ্র ৷
এর সত্যতা পাওয়া যায় সাঁওতারদের দাঁসাই পরব এর ইতিহাস থেকে। কথিত আছে, খেরওয়াল গোষ্ঠীর মানুষরাই সর্ব প্রথম ভারত বর্ষের মাটিতে পা দিয়েছিল। ভারতবর্ষের মাটিতে তারা বহু লড়াই করেছে।কিন্তু ভারতবর্ষের মাটিতে সর্বপ্রথম যে লড়াই করেছিল, সেটা হচ্ছে কোন এক আর্য জাতির সঙ্গে। সেই সময় আর্যদের দলপতি ছিলেন ইন্দ্র নামে কোন বীরপুরুষ এবং খেরওয়াল দের দলপতি ছিলেন “হুদুড় দূর্গা”! এই লড়ইয়ে ইন্দ্র সম্পূণ রুপে পরাজিত হন এবং অবশিষ্ট সৈন্য–সামন্ত নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। তারপর এই যুদ্ধের গরম হাওয়া ঠান্ডা হলে পরে ইন্দ্র সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠালেন হুদুড় দুর্গার দরবারে। সেই সন্ধির প্রস্তাব ছিল লড়াই যুদ্ধ থেকে বিরত থেকে বিবাহের সম্পর্ক গড়ে সন্ধি স্থাপন করা।এই প্রস্তবে হুদুড় দুর্গা স্বীকৃতি দিলে পরে ইন্দ–আর্যদের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে উপহার হিসাবে হুদুড় দুর্গা কে দিয়ে ছিলেন। সেই মেয়েটির নাম ছিল দেবী। এই সন্ধি স্থাপন এরপরে আর্যরা যে কোনো সময় বিনা অনুমতিতে খেরওয়াল গড়ের অন্দরমহলে যাওয়া আসা করার সুযোগ পেল। এদিকে দেবীকে ইন্দ্রের নির্দেশ ছিল খেরওয়াল গাড়ের অন্দরমহলে খবর অর্থাৎ হুদুড় দুর্গা কখন খায়কখন ঘুমায় কোন সময় আনন্দ–ফুর্তিতে মেতে থাকে কোন সময় মদের নেশায় বিভোর থাকে ,কোন অবস্থায় পড়ে থাকে ইত্যাদি প্রতিদিন নিয়মিত পাচার করা। ইন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে দেবী তাই করতে লাগলো। দেবীকে তার স্বামী হুদুড় দুর্গার কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হতে হবে দেবী সেটা ভালভাবেই জানত। জেনেও তার কিন্তু কোন উপায় ছিল না কারণ এটা ইন্দ্রের নির্দেশ। এইভাবে বহুদিনের তথ্য মিলিয়ে ইন্দ্র দেখলেন যে ঠিক এই সমযয়ে প্রতিদিন এই রাত্রে হুদুড় দূর্গা নেশায় বিভোর হয়ে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকেন। ইন্দ্র আর্যদের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে উপহার হিসাবে ‘হুদুড় দুর্গা’কে দিয়েছিলেন সেই মেয়েটির নাম ছিল দেবী ।
সুযোগ বুঝে ইন্দ্র কয়েকজন বীর যোদ্ধাকে অতিথি হিসাবে পাঠালেন খেরওয়াল গাড়ের অন্দর মহলে। দেবী সমেত হুদুড় দুর্গা কে পেছনের দরজা দিয়ে অপহরণ করার জন্য। দেবী ও হুদুড় দুর্গা দুইজন নেই অপহৃত হলে পর, সমস্ত সৈন্য–সামন্ত নিয়ে সেই রাত্রে ইন্দ্র আবার খেরওয়াল গাড় আক্রমণ করলেন। ফলে খেরওয়াল গাড়ের বাহিওে প্রহরারত সৈন্যরা লড়াই শুরু করেছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্দরমহলে ছুটে গেল হুদুড় দুর্গাকে খবর দিতে। কিন্তু তারা গিয়ে দেখল অন্দরমহল ফাঁকা, দেবী ও হুদুড় দুর্গা কেউই নেই। ফলে তারা ঘাবড়ে গেল। খেরওয়াল সৈন্যরা যুদ্ধ করলেও কেউই সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারল না। ফলে তারা সম্পূর্ণ রুপে পরাজিত হলো এবং নারী পুরুষ ছেলে–মেয়ে সকলেই পালিয়ে গিয়ে পাহাড় জঙ্গলে আশ্রয় নিল। তারপর সকাল হলে সভা ডেকে আলোচনা করল খেরওয়াল সৈন্যরা। তারা আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিল, দেবী–দুর্গাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করে উদ্ধার করতে হবে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস দেবী–দুর্গাকে যেখানেই যাক কেউই তাদের কে মারতে পারবে না। কিন্তু তারা জানতো না যে দেবী বিশ্বাস ঘাতক করেছে এবং দুর্গা কে মেরে ফেলেছে। মহিষাসুর কোনও অশুভ শক্তির প্রতীক নন। তিনি শহিদ। আর্য সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে খুন হন “হুদুড় দুর্গা” নামে অনার্য বীর। উপরোক্ত ইতিহাস আলোচনার মাধ্যমে প্রতিয়মান হয়, সাঁওতালরা ভারতীয় উপমহাদেশে ভূমিপূত্র/আদিম অধিবাসী।
তানযান বোস গুরুচন্ডালী ডটকম-এ খেরোয়াল জাতির উপকথা শীর্ষক আর্টিকেলে বর্তমান যুগের অবিভক্ত ভারতবর্ষের আদিম আদিবাসীদের একটা বড় অংশ সাঁওতাল সৃষ্টিতত্বের ইতিহাস আলোকপাত করেন। সাধারনত মনসা জাগরনের গানে গানে সাঁওতালদের সৃষ্টিতত্ব এবং আদি ইতিহাসের কথা ফুটে ওঠে। মনসা (মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা) মূলগতভাবে অনার্য দেবী। এখনো আদিবাসী ও অন্ত্যজ সমাজে সর্পদেবী মনসার পূজা সুপ্রচলিত। মনসা জাগরন গানের মানুষ ভেদে ভিন্ন উপস্থাপন ভঙ্গি/পাঝেড়/চড়াং থাকলেও মোটামুটি সবক্ষেত্রেই যে তত্বটি তুলে ধরা হয়,তা নিম্নে আলোকপাত করলাম-
পৃথিবী একসময় সমস্ত স্থান জলে ডুবে ছিলো। সেই সময় ঠাকুজিও ঈশ্বর প্রথমে সিরম গাছের শিকড় দিয়ে হাঁস আর হাঁসলি সৃষ্টি করেন। সিরম গাছের উপর ঈশ্বর ইচ্ছায় কারাম গাছ জন্মায়, তাতে পাখি দুটি বাসা বাঁধে আর ডিম পাড়ে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে এই বলে যে তাদের ঈশ্বর সৃষ্টি করলেও থাকার মতন মাটি নেই। শুধুই জল। তাদের যেন মাটি দেওয়া হয়। গানের কথায়-
“হাইমা তিন বুরু মা রগড়াই গিতিল টানডি দাঃ,হাসা বানুঃ অত বানুঃ একনে জালাধার”
কুড়ি বছর ধরে তারা এই ভাবে কেঁদে আর বিলাপ করলে, ঈশ্বর সব দেবতাদের জিজ্ঞাসা করেন যে কে এরকম কাঁদছে আর বিলাপ করছে। তখন ঠাকুজিও এসে সব ঘটনা জানায়। তখন ঈশ্বর এর ইচ্ছায় কচ্ছপরাজকে আনা হয়। এনে সোনার শিকল দিয়ে তার চার পা পূর্ব, পশ্চিম উত্তর দক্ষিনে বাঁধা হয়। গানের ভাষায়-
“দেব দেব ঠাকুরগো মাটি গো দেব, তুলিবো তুলিবো গো, হরদেয়া রাপ-রাপা হাসা রাখিবো হাই-হাই হাসা রাখিবো”
অর্ধেক পৃথিবী আর কন্যার লোভে কচ্ছপ এই কাজে রাজী হয়। তাকে ঠাকুজিও কথা দেন যে কুড়ি বছরে সে একবার নড়তে পারবে। এরপর ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঠাকুজিও কচ্ছপের পিঠের উপর সর্পরাজকে কুণ্ডলি পাকিয়ে রাখে। সর্পরাজও কুড়ি বছরে কচ্ছপের সাথে একবার নড়তে পারার প্রতিশ্রুতি পায়। এরপর ঠাকুজিও সাপের উপর সোনার থালা উপুর করে বসিয়ে তার উপর মঞ্চপুরি বা পৃথিবীকে তোলার ব্যবস্থা করেন। প্রথমে ঈশ্বর এর ইচ্ছায় বোয়াড় হাকু অর্থাৎ বোয়ল মাছকে। গানের কথায়-
“দেব দেব ঠাকুর পাঞ্চি-নারায়ন, জহার জহার ঠাকুর ধারতি বানাই দে হাই হাই ধারতি বানাই দে”
বোয়ার হাকু যখন সমুদ্রের নিচে থেকে মুখ দিয়ে মাটি তুলতে গেলে অর্ধেক রাস্তায় সেই মাটি গলে যায়। এরপর কাকড়া রাজা অর্ধেক পৃথিবী আর কন্যার লোভ দেখিয়ে আনে। গানের কথায়-
“যা রে কাকড়া রাজা পাতাল পুরি যা, পাতাল পুরির মাটি তুলে নিয়ে আই হাই হাই তুলে নিয় আই”
কাকড়া রাজা ডাটা দিয়ে পাতাল থেকে মাটি তোলার চেষ্টা করে, কিন্তু অর্ধেক পথেই তা জলে মিলিয়ে যায়। এ লজ্জআয় কাকড়ারাজা সেই মাটিতেই গর্ত করে ডুকে যান। তখন ঠাকুরজিও কেঁচোরাজকে একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে আসেন।
“জিলিং জিলিং লেন্ডেৎ রাজা পাঝের সারাৎ সারাৎ, যা রে লেন্ডেৎ রাজা পাতাল পুরি যা, পাতাল পুরির মাটি তুলে নিয়ে আই হাই হাই তুলে নিয়ে আউ”
কেঁচোরাজ পাতালে মাটি তুলতে গেলে বোয়াল মাছ তাকে ধাওয়া দেয়। তখন ঠাকুরজিও মহান ঈশ্বরকে চং তৈরি করে দেওয়ার কথা বলেন।
“কামারিনি কামার গো চং বানাইদে, ভালো করে চং বানাইদে”
অতঃপর সেই চং-এ করে কেঁচোরাজ পাতাল থেকে মাটি কামড়ে পেটে রাখে আর থালার উপর মলত্যাগের মাধ্যমে সেই মাটি ফেলে। এইভাবে সেই মল বুরু বা মাটির ঢিবিতে পরিণত হলে, ঠাকুরজিও তাতে বিভিন্ন শাক, শাল, বট, মহুয়া প্রভৃতি গাছের চারা পোঁতেন। মূহুর্তে সেগুলো বড় হয়ে আজকের সবুজ পৃথিবীতে পরিণত হয়। এরপর হাঁসের ডিম দুটো থেকে দুজন মানুষ সৃষ্টি করেন। এরা হলেন খেরোয়াল সমাজের আদি মানব আর মানবী, পিলচু হারাম আর পিলচু বুড়হি। এদের থেকেই পরে সমস্ত জগতের সৃষ্টি করেন।
আদি মানব ও মানবী পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান থেকেই তাদের সাতটি গোত্রের উদ্ভব।
পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে মোট বারটি গোত্র হয়। পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ি তাদের সন্তানদের দ্বায়িত্ব এবং বসবাসের গাড়/স্থান নির্ধারন করে দেন। নিম্নে ১২টি গোত্র হলোঃ
১. কিস্কু (রাজ/রাপাজ)-কয়ডাগাড়
২. হাঁসদাক বা হাঁসদা (পরধোল)-কুটামপুরীগাড়
৩. মুরমু বা মুর্মু (ঠাকুর)-চাম্পাগাড়
৪. হেমব্রম (কুঁয়াড়)-খাইরীগাড়
৫. মারনদী, মারাণ্ডি বা মার্ডি (কিপিসাঁড়)-বাদলীগাড়
৬. সরেন (সিপাহি/যোদ্ধা/লা-পাড়হাইকু)-চাইবাহেরগাড়
৭. টুডু (মান্দাড়িয়া)-সিমগাড়
৮. বাস্কে (আকিলমান)- হারবালোয়োংগাড়
৯. বেসরা (ব্যপারি)-বানসারিয়াগাড়
১০.পাঁওরিয়ার বা পাউরিয়া (তাম্তি/তাঁতি) – বামাগাড়
১১. বেদেয়া (শিকারিয়া)-হলংগাডাগাড়
১২. চোঁড়ে (মাহারা/ঘোষ) –জাংগেকদেগাড়
উল্লেখ্য সাঁওতাল সমাজে একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। উল্লেখ্য সাঁওতালদের বসবাসের উল্লেখিত এই সমস্ত স্থান/গাড় এর অবস্থান এই ভারতীয় উপ-মহাদেশে।
সাঁওতালদের বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আরো একটি বিষয় আলাদা ভাবে উল্লেখ করতে হয়- সাঁওতাল জাতিসত্বার মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রয়েছে সামাজিক উৎসব বা পর্ব এবং প্রত্যেক উৎসব বা পর্র্ব কেন্দ্রিক রয়েছে ভিন্ন সূরের গানের বৈচিত্রতা। উৎসব সমূহের মধ্যে বাহা, সরহায়, কারাম ,দাঁসায় উল্লেখযোগ্য। যার একটি উৎসবের গান অন্য উৎসবে গাওয়া হয় না। অর্থাৎ সহরায় উৎসব ভিত্তিক যে গান রয়েছে তা বাহা উৎসবে গাওয়া হয় না। বিভিন্ন উৎসের তথ্য মতে সাঁওতাল জাতিসত্বার প্রায় ৫০ টির অধিক ভিন্ন সূরের গান পাওয়া যায়। এগুলি হল -(১)সহরায় (২)বাহা (৩)লাগড়ে (৪) দারুমজাঃ (৫) ডানটা (৬) বিনসার (৭) গুনজার (৮) ছাটিয়ার (৯) নারতা (১০) দং (১১) ডাহার (১২) গুলয়ারি (১৩) বাপলা (১৪) আতাংদারাম (১৫) তুংদাম (১৬) বির (১৭) গাম (১৮) হমোর (১৯) গিদরা বুলাও (২০) হুড়– রহই (২১) রিনঝা (২২) মাতয়ার (২৩) কারাম (২৪) মরা কারাম (২৫) দাঁসায় (২৬) গাংজন (২৭) জাঁয়াঁই ধুতি (২৮) ঝিকা (২৯) বানধান (৩০) ওঁড়হেঁ (৩১) সিধু–কানহু (৩২) তুরিঘার পুখরি (৩৩) ঘার জাগাও (৩৪) পরচার (৩৫) কুবি গাওনা (৩৬) তাঁহাঁরেঁতা (৩৭) ঝুমুর (৩৮) বিদাঃ (৩৯) পেড়া নেওতা (৪০) তপা (৪১) দারাম দাঃ (৪২)জাগরন (৪৩) গাই চুমাউরা (৪৪) গানডদন (৪৫) ভাজান (৪৬) গাদই (৪৭) ল্যাটিন রাড় (৪৮) ইংরেজ রাড় (৪৯) বাংলা রাড় (৫০) বিনতি অড়াঃ রাড় (৫১) দিনাজপুরি রাড় (৫২) মর্ডান রাড় (৫৩) বালায়া (৫৪) গইঠা হালাং। সকল গানই হল সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসব কেন্দ্রিক। উৎসব কেন্দ্রিক ভিন্ন গানে, নাচের ধাঁচও আলাদা এবং নারী পুরুষের নাচেরও ভিন্নতা আছে, যেমন দাঁসায়, ডানটা, কারাম ইত্যাদি এগুলি হল পুরুষ কেন্দ্রিক নাচ অর্থাৎ উৎসবের সময় এই সকল নাচ সমূহ শুধুমাত্র পুরুষরাই নাচতে পারবে। এটির সুনির্দ্দিষ্ট ব্যখ্যা রয়েছে। গুণিজনদের মতে লুগুবুরু দাঁসনা নামক স্থান থেকে এই নাচের প্রচলন শুরু হওয়ার এর নামকরণ করা হয় দাঁসায়। কিন্তু এই লুগুবুরু পর্বতটি কোথায় অবস্থিত তা এখন চিহ্নিত হয়নি, এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কোলকাতা সাহিত্য একাডেমির যুব পুরষ্কার প্রাপ্ত লেখক অভিমান্যু মাহাতো দাঁসায় শব্দের অর্থ “অসহায়” বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দং শব্দের উৎপত্তি হল অং(ফু), সহরায় শব্দ এসেছে সারহাও (প্রসংশা), লাগড়ে শব্দের এসেছে লাঙগা মারাও (ক্লান্তি দুর করা) থেকে।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বলে আগিলহাপড়াম কু দ লেলহা গেকু তাহেকানা অথাৎ পূর্বপুরুষেরা একটু স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী ছিল। আমার মনে হয়, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তারা প্রাকৃতিক ভাবেই জ্ঞানী ছিলো এবং সাঁওতাল জাতিকে সাংস্কৃতিক ভাবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। সাঁওতালদের আগিলহাপড়াম বা পূর্বপুরুষের জ্ঞানের গভিরতা সম্পর্কে এই ছোট্ট বিশ্লেষন থেকেই অনুধাবন করতে পারি। সাঁওতালদের প্রতিটি সাগাই বা সমন্ধ রয়েছে ভিন্ন বর্ননা বা নিখুত বিশ্লেষন। যেমন সাঁওতাল সমাজের সাগাই বা সম্বোধন – কুমাং(ফুপা), তেয়াং(দুলাভাই), হিলি(ভাবি/বৌউদি),হাড়ামবা(নানা/দাদু) এদের সাথে কেন হাসি ঠাট্টা করতে পারবেন। উদাহরণ সরুপ একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, তেঙাং বা দুলাভাই অর্থাৎ বড় বোন জামাই এক্ষেত্রে, কোন কারনে যদি বড় বোন মারা যায়, তাহলে সেই পুরুষ তার বউ এর ছোট বোন কে পারিবারিক সম্মতিক্রমে বিয়ে করতে পারে যা সমাজ মেনে নেবে অন্যদিকে বা-হয়হারিং বা কোন নারীর বরের বড় ভাই অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি এবং ঐ নারীর বর মারা গেলেও স্বামীর বড় ভাই কে কখনো বিয়ে করতে পারবে না এবং তা সমাজ মেনে নিবে না। আবার এক টাইটেল বা পদবীর সাঁওতাল নর ও নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না, যা উপরে উল্লেখ করেছি। এতেই আমরা বুঝতে পারি সাঁওতালদের পূর্ব-পুরুষেরা কতোটা গভীর চিন্তা ধারার মাধ্যমে সাঁওতাল সমাজ ব্যবস্থা কে গড়ে তুলেছিলেন।
এছাড়া সাঁওতালদের রয়েছে নিজস্ব পোষাক পরিচ্ছেদের বৈচিত্রতা। পাঞ্চি (সাঁওতাল নারীর উপর অংশে ব্যবহৃত কাপড়), পাড়হাট (সাঁওতাল নারীর কোমরের নিচে ব্যবহৃত কাপড়), ধুতি ডেঙ্গা/মারখিন(সাঁওতাল পুরুষের ব্যবহৃত ধুতি বিশেষ/ মারখিন কাপড়), দাড়হি (সাঁওতাল পূরুষের মাথায় বাঁধার ব্যবহৃত কাপড়) ইত্যাদি। রয়েছে নিজস্ব সাজস্বজ্জার বিভিন্ন উপকরন ও অলংকারের সমাহার যেমন– ঠেকা পাগরা (কানের দুল–রূপার তৈরি মহিলাদের বিশেষ ধরণের কানের দুল), বাহা পাগরা (কানের দুল–রূপার তৈরি মহিলাদের বিশেষ ধরণের ফুল আকানো কানের দুল), কাঠি মালা (গলার মালা–রূপার তৈরি মহিলাদের বিশেষ ধরণের মালা), মান্দালী (সাঁওতাাল ছেলেদের বাহুতে বাঁধা থাকে ডোর ও রূপার তৈরি অলঙ্কার), মাকড়ি (রূপার নাকের অলংকার/ নোলক), কড়া বাজু (পুরুষের বাহুতে বাধা থাকে ডরা দিয়ে তৈরী অলঙকার), বাঁক (সাঁওতাল মহিলাদের এলুমিনিমের তৈরিপায়ের বাঁক/অলংঙ্কার), টডর (সাঁওতাল শিশু ও কিশোরদের হাতের অলংঙ্কার বিশেষ), টডর বাজু (পিতলের তৈরি বাজু, যা সাঁওতাল পুরুষের বাহূর অলংঙ্কার), হাসলি (দস্তার তৈরি সাঁওতাল মহিলাদের গলায় পরার বিশেষ অলংঙ্কার), খাগা (গলায় পরার সাঁওতাল মহিলাদের দস্তার অলংঙ্কার), তোয়া মালা (পুতির মালা–মহিলাদের গলার অলংঙ্কার), কাটা শালাক (রুপার তৈরি খোপার কাটা চেইন ও বলযুক্ত), শালাক (খোপার কাটা), ঝামপা শালাক (ঝোপা যুক্ত কাটা,রূপার অলংঙ্কার), ডুরিয়া শালাক (রূপার তৈরি মহিলাদের খোপার কাটা), ইলবাহা (পাখির পালক দ্বারা তৈরী, সাঁওতাল পুরুষ বাদকদের মাথার অলংকার ও পায়ের আঙ্গুলের অলংকার) ইত্যাদি।
আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত সাঁওতাল সমাজ নিজ ঐতিহ্যবাহী সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। ব্যবস্থায় মঁড়ে হড় বা পঞ্চজন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এই পাঁচজন হলেন – মানঝি (গ্রাম প্রধান), পারানিক (সহকারী গ্রাম প্রধান), জগ-মানঝি, জগ-পারানিক এবং গোডেৎ বা গডেৎ (বার্তা বাহক)। এরা গ্রামের সকলের মঙ্গল ও কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত থাকেন। ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে তথা সমাজে তাদের নির্দেশ ও আদেশ অনুসারে জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুতে শ্রাদ্ধাদি কার্য পরিচালিত ও সম্পাদিত হয়ে থাকে। যেমন সাঁওতাল সমাজের অন্যতম সামাজিক উৎসব হল- “বিবাহ”। আদি কাল থেকেই শহরে কিংবা গ্রামে এখনো সাঁওতাল বিবাহের জন্য বর-কনে উভয় বাড়িতেই ঐতিহ্যবাহী রীতি মেনে ছামডা অথবা মান্ডুয়া (ছামডা এর ক্ষেত্রে পেড়া/বর পক্ষ এর বিয়ে বাড়িতে খাবার ব্যবস্থা থাকবে না পক্ষান্তরে মান্ডুয়া এর ক্ষেত্রে পেড়া/বর পক্ষ এর খাবার ব্যবস্থা করে থাকে গিরহাত/কনের বাবা ) করা অবশ্যক বা পালন করে আসছে। এছাড়া ঙেপেল, অপল, ছামডা/মান্ডুয়া, দাঃবাপলা, পেড়া আতাং, ভোজ, দান গণনা, পেড়া বিদা, ছামডা/মান্ডুয়া রাপুত অর্থাৎ সাঁওতাল বিবাহ সুসম্পন্ন করার ক্ষেত্রে মঁড়ে হড় বা মানঝি পরিষদের বিকল্প নেই। সেইসাথে প্রশাসন ও বিচারসভার ক্ষেত্রে মঁড়ে হড় ব্যবস্থার (পঞ্চজন ব্যবস্থার) রূপায়ণ তথা বাস্তবায়ন করে এবং বিচারের ক্ষেত্রে সামাজিক সমস্যার বিচার ও মীমাংসা করে থাকেন। উল্লেখ্য- মানঝি পরিষদের সকলেই সর্বসাধারণের দ্বারা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে থাকে। এছাড়াও নায়কে (সাঁওতাল পুরোহিত) এবং কুডাম নায়কে (সহকারী সাঁওতাল পুরোহিত) নামে আরোও দু’জন উক্ত পঞ্চজন ব্যবস্থার অন্তর্গত থাকেন যাঁরা গ্রামের সকলের পক্ষ থেকে ধর্মীয় বিষয়বলী পরিচালনা করে থাকেন।
সাঁওতালরা যুগ-যুগ থেকেই এই উপমহাদেশের মাটিতে বসবাস, লড়াই-সংগ্রাম সহ তাদের সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি লালন ও পালন করে আসছে। আর্যদের আগমনের পর থেকেই তাদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস খুজে পাওয়া যায়। এছাড়া ১৭৭১ সালের ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম সশস্ত্র সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পর ১৭৮৪ সালে বাবা তিলকা মানঝির নেতৃত্বে সংঘটিত ভাগলপুরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমি লুঠ ও বলপূর্বক খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে যে ‘খেরওয়াড় বিদ্রোহ’, ১৮৫৫-৫৬ তে সংঘটিত “সাঁওতাল হুল” ১৯৪৬-১৯৪৮ সালে সংঘটিত তেভাগা আন্দোলন সহ মহান মুক্তিযুদ্ধে সাঁওতালরা বীরত্বের প্রমান দিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য মোয়াজ্জেম হোসেন( প্রধান নির্বাহী-গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র) এবং পাভেল পার্থ (লেখক ও গবেষক) ২০০৯ সালে “উত্তরবঙ্গের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা প্রথম ভাগ” শীর্ষক গবেষণা পুস্তকে শুধুমাত্র দিনাজপুর,রংপুর, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট অঞ্চলের ৬৯ জন আদিবাসী ( সাঁওতাল, ওরাওঁ ও মুন্ডা ) বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরেন। কিন্তু দেশ ও জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে, বৈষম্য এবং স্বাধীনতার আন্দোলনে সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহন থাকলেও ন্যায্যতার প্রশ্নে তারা বরাবরই উপেক্ষিত। এছাড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে “নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ” হিসেবে বিবেচনা করে তাদের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন বা ইতিবাচক পদক্ষেপ (সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে ১% কোটা সংরক্ষণ, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরী প্রতিষ্ঠানসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংরক্ষণ,সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিশেষ কার্যাদি বিভাগ স্থাপন করা ও ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনে জেলার রাজস্ব কর্মকর্তার অনুমোদন ব্যতীত আদিবাসীদের জমি আদিবাসীদের হস্তান্তর করার বাধানিষেধ, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় স্থাপন , পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ প্রণীত, ২০০৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংশোধিত আইন) গ্রহণ করে থাকলেও, বস্তুত: সংবিধানের উক্ত “নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ” প্রত্যয়টি স্পষ্ট নয়, সেইসাথে এর মাধ্যমে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি পরিপূরণ হয় না।
১৩ আগস্ট মঙ্গলবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সাংবিধানিক অধিকারগুলো নিশ্চিত এবং প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। সেই সাথে গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করার মাধ্যমে সকল প্রকার বৈষম্য মুক্ত (রাষ্ট্রের সংষ্কৃারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং তাদের ন্যায্য দাবি সমূহ বিবেচনা এবং প্রতিষ্ঠা) বাংলাদেশ নির্মাণ করায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বদ্ধ পরিকর হবেন, এটাই প্রত্যাশা। এছাড়া উপরোক্ত বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কতৃক প্রনীত আদিবাসীর সংঙ্গা অনুযায়ী সমতলের আদিবাসী তথা সাঁওতাল, ওরওঁ, মুন্ডা, কোল, প্রভৃতি খেড়য়াল জনোগোষ্ঠীর মানুষের ক্ষেত্রে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ তাদের নৈতিক দাবিসমূহ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে দেশের নীতি নির্ধারকসহ সকল বুদ্ধিজীবি ও সুশিল সমাজের মানুষ ঐক্যমত হবেন।
তথ্যসূত্রঃ
১. সারসাগুন পত্রিকা (সূর্য কুমার হাঁসদা,গবেষক,নৃ–তত্ত¡বিভাগ,বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন,বীরভূম)
২.গুরুচন্ডালী ডটকম-এ খেরোয়াল জাতির উপকথা (তানযান বোস)
৩. বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতি (২০০৮) -ড. মাযহারুল ইসলাম তরু
৪. বিবিসি বাংলা- https://www.bbc.com/bengali/news-62481231
৫.শিক্ষক বাতায়ন- https://www.teachers.gov.bd/blog/details/621929?page=4569&adibasee-sbdtir-prkrrit-sngjnga-oo-tader-odhikar-nize-jateez-oo-antrjatik-przaze-bitrk-prcur
৬.কাপেং ফাউন্ডেশন (আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি-প্রেক্ষাপট, প্রাসঙ্গিকতা ও সাংবিধানিক বিধানাবলীর সংশোধনী প্রস্তাব)
৭. অধ্যাপক যোগেন্দ্রনাথ সরেন, অধ্যাপক-প্রেমতলী ডিগ্রী কলেজ, রাজশাহী
৮.সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী সমাজ শাসন ব্যবস্থার গঠন- সুব্রত টুডু
৯. সূফি বরষণ তার ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ সালের ব্লগ
১০. অপিলাশ মুরমু-মানঝি হাড়াম কুটরাপাড়া, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা
১১. বাহা সান্দেস
১২. বাহা-২০২২
১৩. উত্তরবঙ্গের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা প্রথম ভাগ-২০০৯
১৪. Seren puthi
১৫. সাঁওতালি গান ও কবিতা
১৬. ইন্টারনেট
– জন হেম্ব্রম, সংষ্কৃতি কর্মী