জাতীয়শিক্ষা

সাঁওতাল হত্যার বিচার, পৈতৃক সম্পত্তি ফেরত ও ইপিজেড নির্মাণ বন্ধ করার দাবি

আজ ২৪ জুন, ২০২৫ রোজ: মঙ্গলবার বিকাল ৩.৩০ টায় ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনেগাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের পৈতৃক সম্পত্তি ফেরত, তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার ও সরকার কর্তৃক ঘোষিত ইপিজেড নির্মাণ বন্ধকরার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে আদিবাসী ছাত্র ও যুবসংগঠনসমূহ। 

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যার সঞ্চালনায় সমাবেশটির সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ  আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্তনী রেমা। উক্ত সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদ সৈসানু মারমা মারমা। 

প্রতিবাদী মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। আরো বক্তব্য রাখেন সমতল আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক উজ্জল আজিম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য রিপন চন্দ্র বানাই, কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি ত্রিজিনাদ চাকমা, সাহেবগঞ্জবাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি ফিলিমিন বাস্কে, আদিবাসী জাতীয় পরিষদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পদক খোকন সুইটেন মুরমু, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ সভাপতি টনি চিরান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক অংশৈসিং মারমা।

সমাবেশে বক্তারা অনতিবিলম্বে সাঁওতালদের পৈতৃক সম্পত্তি ফেরত, তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার ও সরকার কর্তৃক ঘোষিত ইপিজেড নির্মাণ বন্ধ করা সহ ছয়টি দাবি তুলে ধরেন

. গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মের দখলিকৃত জমি চুক্তি মোতাবেক খেসারতসহ প্রকৃত মালিক সাঁওতাল আদিবাসীদের কাছে ফেরত দিতে হবে।

. তিন সাঁওতাল– (শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু) হত্যা মামলা ও সাঁওতালদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত, দোষীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

. ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় আহত সাঁওতালদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

. সাঁওতালদের পৈতৃক সম্পত্তিতে ইপিজেড নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে। 

. উক্ত ঘটনায় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলাগুলোর প্রত্যাহার, হয়রানি বন্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সমতল আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক উজ্জল আজিম তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ সরকার আই এল ও কনভেনশন ১০৭ এর অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হলেও প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আদিবাসীরা দীর্ঘদিন লড়াই সংগ্রাম করলেও তা আজ অধরা থেকে গেছে। সমতলের মত পাহাড়ের আদিবাসীদের অবস্থাও খুবই শোষণীয়। 

সাহেবগঞ্জবাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে তার বক্তব্যে বলেন, বিগত সরকারগুলোর আদিবাসীদের প্রতি যে বিমাতাসুলভ আচরণ এই অভ্যুথানের সরকারও সেই ফ্যাসিবাদী আচরণ জারি রেখেছে। রাষ্ট্র যে আদিবাসীদেরকে গ্রহণ করতে চায় নাতারই প্রতিফলন তিন সাঁওতাল ভাইকে হত্যা। 

বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহসভাপতি টনি চিরান তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, আমার জায়গা থেকে আমাকে উচ্ছেদ করা হবে, আবার আমাকে রাজপথে নামতে হবে কেন? তাইলে রাষ্ট্রের ভূমিকা  কি হবে? আপনারা হুংকার দিচ্ছেন ইপিজেড নির্মাণে বাধা দিলে প্রতিহত করবেন। আমরা আদিবাসীরাও আপনাদের স্পষ্ট করে বলতে চাই, যদি ইপিজেড নির্মাণের প্রকল্প বাতিল না করেন তাহলে এই আদিবাসীরাই আপনাদের প্রতিহত করবে। 

কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি ত্রিজিনাদ চাকমা বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও রাষ্ট্র সেটাতে কর্ণপাত করে নি। পাহাড়ের আদিবাসীরা উন্নয়নের বয়ান শুনতে শুনতে আজ অস্তিত্ব হারানোর পথে এসে বসেছে। সেখানে পর্যটনের নামে লুসাই ম্রোদের উচ্ছেদ করা হয়। অধিকারের কথা বলতে গেলে নিপীড়নের যাঁতাকল নেমে আসে। 

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আদিবাসীরা কখনো উন্নয়নের বিরোধী নয়। কিন্তু যে উন্নয়ন প্রকল্প আদিবাসীদের প্রথাপদ্ধতিকে বিনষ্ট করে প্রণয়ন করা হবে, তা আদিবাসীরা শক্ত হাতে প্রতিহত করবে। 

সৈসানু মারমা বলেন, বাংলাদেশ সরকার কখনো আদিবাসীদের দাবিকে কখনো গুরুত্ব দেয় নি। পূর্বে চিনিকল নিয়ে সাঁওতালদের সাথে চুক্তি করলেও সেই চুক্তির বরখেলাপ করেছে। শুধু সমতলেই নয়, পাহাড়েও তারা জুম্মদের জমি বেদখল করেই চলেছে। সরকার এবং রাষ্ট্রকে হুশিয়ার দিয়ে বলেন, পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীদের লড়াইয়ের ইতিহাস যাতে স্মরণ করিয়ে দিতে না হয় এই আদিবাসীরা ব্রিটিশ আমল থেকে নিজেদের বাপ দাদার জমি রক্ষার জন্য সসস্ত্র সংগ্রাম পযন্ত করে আসছে। 

বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক অংশৈসিং মারমা তার বক্তব্যে বলেন, আপনারা যখনই উন্নয়নের কথা বলেন, তখন আমরা আদিবাসীরা ভয় পাই। কেননা আপনাদের উন্নয়নের মধ্যে আদিবাসীদের উচ্ছেদের গন্ধ থাকে। ১৯৭৬ থেকে ৯৭ পযন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগটিত হওয়া সসস্ত্র সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে বলতে চাই, আমরা আত্মমযার্দা নিয়ে বাচতে চাই। আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে বাচতে চাই। এর ব্যতিক্রম হলে কিন্তু ভালো হবে না।

সভাপতির বক্তব্যে অ্যান্তনী রেমা বলেন, উন্নয়ন মানে শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়ন নয়।যেখানে উন্নয়ন করা হবে, সেখানকার মানুষের যদি উপকারের বদলে অপকার হয় তাহলে সেটা আগ্রাসনে পরিণত হয়।  দেশ স্বাধীনের পরের আদিবাসীদের ইতিহাস শোষণবঞ্চনার ইতিহাস। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আদিবাসীরা যে স্বপ্ন দেখেছে তা আজ ফিকে। 

এছাড়া বিক্ষোভ মানববন্ধনে সংহতি বক্তব্য রাখেন হাজং স্টুডেন্টস কাউন্সিল (হাসুক) কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক তপন হাজং, আদিবাসী ছাত্র পরিষদের প্রতিনিধি হৃদয় খালকো।

উক্ত মানববন্ধনে সংহতি জানিয়েছেন, গারো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (গাসু), বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস), গারো স্টুডেন্টস ফেডারেশন (জিএসএফ), মাহাতো ছাত্র সংগঠন (মিসাফ), সাঁওতাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (সাসু), হাজং স্টুডেন্টস কাউন্সিল (হাসুক), ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম।

সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিলটি শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সম্মুখ থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে শেষ হয়। 

Back to top button