সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৭তম দিবস; ভূমির উপর আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক!
খোকন সুইটেন মুরমুঃ
১.
“ভগনাডিরেন চনু মৗঞ্জহি হোপন সিধু-কানু গৗরি কিন কুল কাদা। তেহেঞ খন অকয় হো মহারাণী (মহারানী ভিক্টোরিয়া) ঞুতুমতে জমিদার আর মহাজন কো খাজনা আলোবন এমাও কো মা। নোওয়া দিশৗম দো আবোয়াঃ কানা, আবোগে নেতঃ খনাক বো রাজ আ।” বাংলা মর্মাথ: “ভগনাডি’র চনু মাঝির ছেলে সিধু ও কানু সকলকে গৗরি (বার্তা) পাঠিয়েছেন- আজ থেকে কেউ মহারানীর (ভিক্টোরিয়ার) নামে জমিদার/মহাজনকে খাজনা প্রদান করবেন না। কারন এ দেশ আমাদের। আমরা’ই এখানে রাজত্ব করব।”
সাঁওতালদের দেওয়া উপরের বার্তাটি সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু মৗঝির। আজ থেকে ১৬৭বছর আগে, পরাধীন ভারতবর্ষের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণার দুমকা জেলার অর্ন্তগত সাহেবগঞ্জ থানার ভগনাডিহি গ্রামে ৩০হাজারেরও অধিক সাঁওতালদের উপস্থিতিতে সিধু মৗঝি উপরের বার্তাটি দেন। সমবেত জনতা সিধু মৗঝিকে সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ঘোষণা করলেও তিনি নিজেকে দেবতা ঠাকুর জৗউ-এর সেনাপতি বা সুবা-ঠাকুর হিসেবে উল্লেখ করেন। ৩০ জুন ১৮৫৫ সালে শুরু হওয়া এ বিদ্রোহ স্থায়ী হয়েছিল পরবর্তী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ঐতিহ্যবাহী তীর-ধনুক নিয়ে সাঁওতালরা আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর উপর গেরিলা কায়দায় আক্রমন পরিচালনা করত। আক্রমনের পর ক্ষনিকের মধ্যে আবার জঙ্গলে হারিয়ে যেত। একতাবদ্ধ হয়ে- নিজেদের জল-জঙ্গল-জমিনের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাঁওতালরা মরনপণ লড়েছিল। ১০হাজারেরও অধিক সাঁওতাল এ বিদ্রোহে শহীদ হন। দেশান্তরিত হন হাজার হাজার সাঁওতাল। গ্রামের পর গ্রাম ব্রিটিশ সৈন্যরা আগুন লাগিয়ে ও হাতি দিয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন করেছিল। অত্যন্ত কঠোরভাবে ব্রিটিশরা এ বিদ্রোহ দমন করেছিল। সিধু মৗঝি ও তাঁর অনুরাগীদের প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আপাত দৃষ্টিতে বৃটিশরা হয়তো বিদ্রোহ দমন করতে পেরেছিল। কিন্তু অন্তরে দেদীপ্যমান মুক্তির জ¦লন্ত লেলীহান শিখার কিরণকে রোধ করতে পারেনি। সাঁওতাল বিদ্রোহের পরেই সিপাহী বিদ্রোহের ঝাঁঝে ব্রিটিশরা চোখে সর্ষেফুল দেখেন। টালমাটাল হয় মহারানীর রাজত্বের ভীত।
২.
১৮৫৫ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা ভূমির উপর সাঁওতালদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাঁওতাল পরগণা নামে আলাদা জেলা প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমান ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের ছয়টি জেলা; সাহেবগঞ্জ, গড্ডা, পাকুড়, দেওঘর, ডুমকা ও জামতাড়া নিয়ে সাঁওতাল পরগণা অঞ্চল হিসেবে আজও পরিগণিত। সুবিধাবাদী জমিদার, মহাজন, সুদখোর, বনিক ও ঠকবাজদের কাছ থেকে নিরীহ সাঁওতালদের ভূমির অধিকার রক্ষার ব্রিটিশ সরকার পরবর্তীতে ১৮৭৬ সালে আইন প্রণয়ন করেন। যার পরিমার্জিত রুপ Santal Pargana Tenancy Act ( Supplementary Provision), 1949 নামে সুপরিচিত। এই আইন সাওঁতালদের ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, রীতি-রেওয়াজ ও আদর্শকে সম্মান জানিয়েছে। উপরুন্তু, সাঁওতাল পরগনায় বসবাসরত আদিবাসী সাঁওতালদের জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রেও আদিবাসী সাঁওতালদের প্রাধ্যান্যতার কথা বলা হয়েছে। সাঁওতাল আদিবাসী ব্যতীত অন্য কেউ জমি কিনতে চাইলে সেখানকার জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেবার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এ আইনকে পাশ কাটিয়ে, বর্তমানে সেখানকার গরীব সাঁওতাল আদিবাসীদের জমি বেহাত হচ্ছে হর হামেশা। এছাড়াও আইনটির সংশোধন ও পরিমার্জনের কারনেও আদিবাসীরা সমস্যায় পড়ছে। আদিবাসীরা যেহেতু সর্বদাই ভূমিকে মাতৃসম দেখে এসেছেন সেহেতু ১৯৩২ এর ভূমি জরিপকে সেখানকার আদিবাসীরা তেমন প্রাধ্যান্য দেননি। এর ফলে আদিবাসীদের বংশ পরম্পরায় ব্যবহৃত অনেক জমিই সেখানে আদিবাসীদের নামে রেকর্ডকৃত হয়নি। আদিবাসী সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও সংস্কৃতিকে যে আইন প্রাধ্যান্য দিল, সে আইনের ফাঁকেই আজকে সেখানকার আদিবাসীদের জমি সরকার দখল করছে রেকর্ডহীন বলে। তাহলে আদৌ কি সরকার আদিবাসী দর্শন বা চেতনাকে উপলব্ধি করতে পারছে। উন্নয়নের নামে সরকার আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জমিগুলো- পাথরের খনি, খাদান ও ভারী শিল্পের কাছে লিজ দিচ্ছে। যা সাঁওতাল অধ্যুষিত এ অঞ্চলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপরে ফেলছে মারাত্বক প্রভাব, এবং আদিবাসী সমাজ দর্শণকে পদতলে পিষ্ঠ করছে।
৩.
“এ দেশের দেশ ভাল নয় রে, এ দেশের বিচার ভাল নয়
এ দেশের মুসলা ঠাকুর বেজায় ঠকের ঠক রে।।
এ দেশের মান ভাল নয়।।”
সাঁওতালি গানটি বাংলাদেশে রচিত। রচয়িতাগণ সাঁওতাল নারী যারা ৬ নভেম্বর ২০১৬ সালে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক মদদকৃত সন্ত্রাসী বাহিনীর আগ্রাসনে হারিয়েছেন- নিজেদের স্বামী, ভাই ও নিকটতম স্বজনদের। বাংলা মিশ্রিত আধুনিক সাঁওতালি হোমর (বিলাপ) এর গভীরতা যর্থাথই। গানের তিন কলি- দেশের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কারন গত ৬ই নভেম্বর ২০২৬ রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে (কোর্টের আদেশ ব্যতীত) ৫০০শ’র অধিক পুলিশ, র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা উচ্ছেদের নামে আদিবাসীদের উপর হামলা, বসতবাড়ি ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং বর্বরোচিতভাবে গুলিবর্ষণ করে। হামলায় শহীদ হন শ্যামল হেমরম (৩৫), মঙ্গল মার্ডি (৫০) ও রমেশ টুডু (৪০) এই তিন সাঁওতাল কৃষক। দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কতটা নাজুক তা লক্ষ্যণীয়, তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঘটেছিল এ হামলা।
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিভিন্ন ফুটেজে দেখা যায়, ডিবি পুলিশের সদস্যরা প্রথমে সাঁওতালদের কুঁড়ে ঘরে আগুন লাগাচ্ছে। আইনের রক্ষক যখন নিরীহ নাগরিকদের উপর বিনা দোষে এমন নির্যাতন করে, গানের কলি যর্থাথ। তাছাড়াও ঘটনার প্রায় ছয় বছর অতিবাহিত হতে চলেছে, আদিবাসী সাঁওতালরা আজও হত্যা মামলার সঠিক বিচার পায়নি। দু’দফায় মহামান্য আদালত রাষ্ট্রীয় দু’টি নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা; পুলিশ ব্যূরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডির্পাটমেন্ট (সিআইডি) কে তদন্তভার দেন। দু’সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের বিপরীতে সাঁওতালরা নারাজি পিটিশন দাখিল করেছেন। সাঁওতালদের দাবি, তদন্ত দু’বারই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। কারণ দু’টি তদন্ত রির্পোটের মধ্যেই মামলার প্রধান আসামী সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ, অগ্নিসংযোগকারী পুলিশ সদস্য সহ গুরুত্বপূর্ণ আসামীদের নাম বাদ পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই আদিবাসী সাঁওতাল নারীদের এই চ্যালেঞ্জ যর্থার্থ। আদিবাসী সাঁওতালদের কাছে বেআইনিভাবে জমি কেড়ে নিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। ঠিক একই কায়দায় বর্তমান বাংলাদেশ সরকারও আদিবাসী সাঁওতালদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ণ চালাচ্ছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
৪.
বাংলাদেশেও সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার জন্যে The East Bengal State Acquisition and Tenancy Act, 1950 (Section-97) রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু উপরের বর্ণিত ঘটনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার সাঁওতালদের ভূমি অধিগ্রহনের ক্ষেত্রে এই আইনের তোয়াক্কা করেননি। তাছাড়াও বর্তমানে সমতল অঞ্চলে আদিবাসীদের জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। এক শ্রেনীর টাউট, ভূমি মাফিয়া সহজ সরল আদিবাসীদের ফাঁদে ফেলে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আদিবাসীদের জমি বেহাত করছে। অনেক ক্ষেত্রে ভূমি অফিস, বন-বিভাগ আদিবাসীদের পারম্পরিকভাবে ব্যবহৃত জমিগুলোকে খাস জমি ও বনের জমি উল্লেখ করে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করছে। পার্বত্যাঞ্চলেও The Chittagong Hill-tracts Regulation, 1990 শাসনবিধিকে তোয়াক্কা না করেই চলছে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জুম ভূমি দখল। আদিবাসীরা সেখানে জুম চাষের কারনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চক্রাকারে চাষাবাদ করেন। বিভিন্ন সময়ের ভূমি জরিপের সময় সেখানে মানব-শূণ্য দেখিয়ে ভূমি অফিস হয়ত রেকর্ড করেছেন। কিন্তু সেটা আদৌ মালিকানানহীন ছিল না। কোন না কোন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জুমের ভূমি ছিল। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বংশ পরম্পরাগত শাসনবিধি সেকারনে আজ অনেকটাই ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে। সেই সাথে মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে চলে যাচ্ছে প্রাণ ও প্রকৃতির অভয়ারণ্য ও আদিবাসীদের বাসস্থল অবারিত এই সবুজ বনভূমি। এ সমস্যা লাঘবের জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্যে ভূমি কমিশন গঠন হয়েছে। ঠিক একইভাবে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীরাও চান, সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন। যার বদৌলতে হয়ত আদিবাসীরা ফিরে পাবে নিজেদের ভূমির অধিকার।
পূনশ্চ, আদিবাসী সাঁওতালদের এ বিদ্রোহ স্বাধীনতার পর ভারত বর্ষে হয়তোবা সেরকমভাবে স্বীকৃত পায়নি। কিন্তু সাঁওতাল সহ শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত ও দরিদ্র আদিবাসী সম্প্রায়ের কাছে এ বিদ্রোহের তাৎপর্য যথেষ্ঠ। তাইতো, ইংরেজরা দেশ ছাড়ার শত বর্ষ পরেও ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভূটানের সাওঁতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে সাঁওতাল বিদ্রোহ (হুল/সাঁওতালিতে বিদ্রোহ) দিবস মর্যাদা ভরেই পালন করেন সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা। কবির ভাষায়- “দেশ কাড়লি, জাত কাড়লি, ধর্ম নিলি কেড়ে। অন্তরে ওর স্বাধীন হড়, কাড়বি কেমন করে।”/ (দেশ কেড়ে নিলা, জাত ও ধর্ম কেড়ে নিলা কিন্ত অন্তরে তো আমি স্বাধীন। অন্তরের আমিকে তো কেড়ে নিতে পারবা না)। আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমিনের অধিকারের জন্য বিপ্লবী সিধু মৗঝির মত হুলের ডাক দেবার প্রত্যয়ে বেঁচে আছে হাজারও শোষিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত-লাঞ্চিত মানুষ ও তাদের পিছিয়ে থাকা সমাজ। তাদের টেনে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও সমাজের। সঠিক সময়ে টেনে না তুললে আবারও হয়তো হুল ফুটবে অসম এ সমাজব্যবস্থায়।
—————————————————————————————————————————-
খোকন সুইটেন মুরমু: আদিবাসী অধিকার কর্মী ও প্রকল্প সম্বন্বয়কারী, কাপেং ফাউন্ডেশন। কেন্দ্রীয় সদস্য বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। ই-মেইল:[email protected]