জাতীয়শিক্ষা

সরস্বতী পূজোর থিমে আদিবাসী নিপীড়নের প্রতিবাদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এই বছরের সরস্বতী পূজোর জন্য বেছে নিয়েছে এক ব্যতিক্রমী থিম—“আদিবাসী নিপীড়ন”। দেবী সরস্বতীর আরাধনার মধ্য দিয়ে বিদ্যা ও জ্ঞানের পূজা করা হলেও, এবার শিক্ষার্থীরা পূজোমণ্ডপকে পরিণত করেছেন একটি শক্তিশালী প্রতিবাদমঞ্চে।

ছবি: জগন্নাথ হল মাঠে স্বরস্বতী পূজা (সংগৃহীত)

পূজোমণ্ডপের কাঠামোটি তৈরি করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে, যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জুমঘরের প্রতীক। বাঁশের পাটাতনটি ঢালু থেকে উঁচুতে উঠেছে, যা পাহাড়ের অস্তিত্ব ও তার ওপর ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনকে প্রতিফলিত করে। এটি প্রতীকীভাবে দেখিয়েছে কিভাবে পাহাড় ও তার পরিবেশকে উন্নয়নের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে ।
মণ্ডপের সবচেয়ে নজরকাড়া দিকগুলোর একটি হলো গলায় ফাঁস লাগানো এক পাহাড়ি ধনেশ পাখির প্রতিকৃতি। এটি শুধুমাত্র পাহাড়ের প্রাণীকূলের বিলুপ্তির ইঙ্গিতই দেয় না, বরং আদিবাসী সংস্কৃতির ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও নিপীড়নের এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপকথায় ধনেশ পাখির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকলেও, বাস্তবতার নিরিখে আজ তারা বিলুপ্তির পথে।
ধানেশ পাখিটির নিচে রাখা হয়েছে দুটি বস্তু—একটি পানির পাত্র এবং অপরটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। এগুলো প্রতীকীভাবে দেখিয়েছে কীভাবে ভূমিদস্যুতা, আধিপত্যবাদ এবং রাজনৈতিক-সামাজিক নিপীড়নের কারণে আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে। তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে আধুনিক সভ্যতার তথাকথিত উন্নয়নের চাপের কারণে।
দেবী সরস্বতীর প্রতিমার মুখ কিছুটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা হয়েছে, যা প্রকৃতির এই বিপন্নতা ও নিপীড়নকে তিনি অবলোকন করছেন, এমন এক শৈল্পিক বার্তা বহন করে। একইসঙ্গে এটি আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে আহ্বান জানায়, যেন আমরা অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চুপ না থেকে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াই।

ছবি: জগন্নাথ হল মাঠে স্বরস্বতী পূজা (সংগৃহীত)
পূজোর এই আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং আদিবাসীদের অধিকার, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এবং পরিবেশ রক্ষার বার্তা তুলে ধরেছেন।

এ প্রসঙ্গে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা চাই সকল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি টিকে থাকুক, নিপীড়ন ছাড়াই। পাহাড় হোক সমতল, বাঙালি ও আদিবাসী—সবাই যেন তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারে। প্রকৃতির সন্তানেরাও থাকুক আগ্রাসনমুক্ত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতী পূজোর এই প্রতীকী থিম নিছক ধর্মীয় আচার পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর সামাজিক বার্তা বহন করছে। এটি শুধুমাত্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে না, বরং সামগ্রিকভাবে নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গতকাল ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব সরস্বতীপূজা উদযাপিত হয়েছে । জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীর কৃপা লাভের আশায় জগন্নাথ হলের মাঠে মণ্ডপে মণ্ডপে বাণী অর্চনা, আরতি ও ভক্তদের পুষ্পাঞ্জলিতে আরাধনা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। হলের পুরো মাঠজুড়ে বিভিন্ন অনুষদ, বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ৭১টি এবং হলের উপাসনালয়ের পাশের পুকুরে একটি ও হলের কর্মচারীদের আরেকটি মণ্ডপে সকাল থেকেই উপাসনা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী–শিক্ষক ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পূণ্যার্থীদের ভীড় ছিল মণ্ডপে মণ্ডপে।

Back to top button