জাতীয়

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় নিয়ে উত্তপ্ত সংসদ

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় নিয়ে রবিবার সংসদ উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। রায়ের প্রসঙ্গ তুলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ সরকার দলের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা আদালতের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সিনিয়র মন্ত্রীরাও আলোচনায় অংশ নেন। তারা বলেন, সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এই রায় অনভিপ্রেত। মামলার শুনানিতে এমিকাস কিউরিদের বক্তব্য নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন সংসদ সদস্য তাদের সুবিধাভোগী আখ্যা দিয়েছেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা আলোচনার পর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে একই ইস্যুতে পরবর্তী সময়ে আলোচনার কথা জানান।

সংসদে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর জাসদের সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। সরকারের ৪জন মন্ত্রীসহ সরকারি দল, বিরোধী দলের ১০ জন সদস্য বিষয়টি নিয়ে দুই ঘণ্টা ২৫ মিনিট বক্তব্য রাখেন। তবে, ব্যক্তি জীবনে আইন পেশায় যুক্ত কোনও সংসদ সদস্য এই ইস্যুতে সংসদের আলোচনায় অংশ নেননি। আলোচনার মাঝপথে অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের পাঁচ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর চলতি বছরের ৮ মে শুনানি শুরু হয়, যা ১ জুন শেষ হয়। হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে ৩ জুলাই আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হয়।

এর আগে গত ৭ মার্চ আপিল বিভাগ শুনানিতে সিনিয়র ১২ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন আদালত। যাদের মধ্যে ১০ জন আদালতে অভিমত উপস্থাপন করেন। তাদের মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এ এফ হাসান আরিফ, এ জে মোহাম্মদ আলী ও এম আই ফারুকী ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন। অন্য অ্যামিকাস কিউরি আজমালুল হোসেন কিউসি সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অন্য দু’জন মত উপস্থাপন করেননি।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধান উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সংবিধান। সেই সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদকে আমরা পুনঃস্থাপন করেছিলাম। আদালতের রায় নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। আমার বক্তব্য সংসদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে। আদালতের শুনানিতে অংশ নিয়ে অ্যামিকাস কিউরিরা অসত্য বলেছেন। ভুল তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, বাহাত্তরে ভারতকে অনুসরণ করে আমরা সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা দিয়েছিলাম। এখন ভারতে এটা নেই। তার মতো লোক এই ধরনের অসত্য কথা বলছেন।’ তিনি বলেন, ‘আরেক অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, এই ব্যবস্থা কোথাও নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদ্ধতি সংসদের হাতে রয়েছে। তিনি সাউথ আফ্রিকা, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সংবিধানেরও কথা উল্লেখ করে বলেন, একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তান। সেখানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আইয়ুব খান চালু করেছেন। এই আইয়ুব খানের পদ্ধতি আমাদের দেশের অ্যামিকাস কিউরিদের পছন্দ। জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানকে অনুসরণ করে এই পদ্ধতি আমদানি করেছেন। এই দুই অ্যামিকাস কিউরিকে সুবিধাবাদী।’

বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘সংবিধানের সঙ্গে কোথায় সাংঘর্ষিক, তা পরিষ্কার করা হয়নি। এর পেছনে উদ্দেশ্য সংসদকে তাদের ইচ্ছার অধীনে নিয়ে আসা। বিচারক নিজেরাই নিজেদের বিচার করবেন। এখানে তারা নিজেদের স্বার্থকে দেখেছেন।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আদালত এই সংশোধনী বাতিল করে বললেন, এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোথায় সাংঘর্ষিক, সেটা বলেননি।’

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার গুরুতর অসদাচারণের কথাই বলতে হয়। কয়েকমাস আগে প্রধান বিচারপতির আদেশে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার দুর্নীতি দমন কমিশনে আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত না করার জন্য বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা তাদের দায়িত্ব পালনকালে অনেক কষ্ট করে মৃত্যুদণ্ডসহ অনেক বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। রায় দিয়েছেন। তদন্ত যদি ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে করা হয়, সে বিচারের বিষয়ও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’’ মতিয়া চৌধুরী আরও বলেন, ‘এর মাধ্যমে বিচারপতি সিনহা ন্যায়বিচারের বাধা দেওয়ার অপরাধ করেছেন। যা দণ্ডবিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি সুপ্রিম কোর্টের নাম শুধু ব্যবহার করেননি, সুপ্রিম কোর্টের প্যাডও ব্যবহার করেছেন। যদিও এটা ছিল তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।’

আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘৯৬ ধারা সংবিধানের মূলভিত্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিচারবিভাগই সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধ রায় দিয়েছেন।’ বিচারকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে বক্তব্য দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আপনারা কি আপনাদের উত্তরসূরিদের মতো অশুভ শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে চান? সেই ইচ্ছা আর পূরণ হবে না। বাংলাদেশে সেই সুযোগ আর আসবে না। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার সংসদের কাছে জবাবদিহি করেন, অথচ বিচারকদের করা যাবে না? তাহলে কি তারা জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। এই ধরনের জাজমেন্ট দিয়ে আপনারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।’

ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তারা সুবিধাবাদী। সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগের সংঘর্ষ বাধিয়ে তারা ফল পেতে চান।’ বিচার বিভাগের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সংসদের হাতে দায়িত্ব থাকবে। রায় নিয়ে আপানারা বসে থাকুন। সংসদ কার্যকর না করলে হবে না। আপনারা রায় দিতে থাকুন। সংসদ বিচার বিভাগের ন্যায্য বিচার করবে। বহু বিচারপতি এসেছেন, গেছেন।’

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘সংসদ যদি সংবিধানের বাইরে যায়, সেটা দেখার দায়িত্ব বিচার বিভাগের রয়েছে। তারপরও তারা ভুল করতে পারেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি আমার আনুগত্য প্রকাশ করছি। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা একমত। আবার বিচার বিভাগের দায়বদ্ধতা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটা নিয়েও আলোচনা করতে চাই। বাংলাদেশের বিচারকরা যখন রায় দেন, তখন সেটা ভুলও হতে পারে, অজ্ঞতাপ্রসূতও হতে পারে। কিন্তু এ জন্য আমরা কোনও ব্যবস্থা নেব না? শুধু ব্যক্তিগত অসদাচরণ করলেই তার বিরুদ্দে তদন্ত সাপেক্ষে সংসদ রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠানো হবে।’

জাতীয় পার্টির সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘ড. কামাল কালো টাকা সাদা করেছিলেন। যিনি কালো টাকা সাদা করেন, তিনি কিভাবে অ্যামিকাস কিউরি হতে পারেন। আদালত তাকে কিভাবে ডাকেন? এই সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারলে বিচারকদের কেন পারবে না?’ তিনি বলেন, ‘এই আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। পঞ্চম সংশোধনীতেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।এই সংসদ নতুন কিছু করেনি। আমরা তো কোনও অপরাধ করিনি। আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করতে চাই না। তাদের রায়ের পর কথা থাকে না। কিন্তু এরপরও কথা আছে। কারণ এই সংসদ সার্বভৌম। জনগণ আমাদের ম্যান্ডেট দিয়েছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য।’ তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘রিভিউয়ের মাধ্যমে ৯৬ ধারা বহাল রেখে বিচার বিভাগ সংসদের প্রতি সম্মান দেখাবে। জনগণের প্রতি সম্মান দেখাবে।’

জাসদের মইনউদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘সারাজীবন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে নির্যাতিত হয়েছি। কিন্তু সম্প্রতি কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যা অনভিপ্রেত। ৯৬ ধারা সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারকে কোথায় ধাক্কা দিয়েছে, সেটা বিচার বিভাগকে পরিষ্কার জবাব দিতে হবে। সংবিধানের রক্ষক সেটা ঠিক, মানছি। কিন্তু যেকোনও আইন বাতিল করতে তারা পারেন না। যেটা সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের পরিপন্থী, সেটাই বাতিল করার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। আমরা বিচার বিভাগের বন্ধু। আশা করি বিষয়টি তারা যথাযথ গুরুত্ব দেবেন। এই রায় জনগণের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, তা ইতিহাসের কাছে ছেড়ে দিলাম।’

আলোচনায় আরও অংশ নেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক আলী আশরাফ, স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তুম আলী ফরাজী ও বিএনএফ-এর আবুল কালাম আজাদ।

সংসদ সদস্যদের আলোচনার পরে স্পিকার শিরীন শারমিন বলেন, ‘আজকের আলোচনায় বিষয় সম্পর্কে জাতীয় সংসদে পরবর্তী সময়ে আলোচনার সুযোগ দিতে সংসদ সদস্যরা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ক যে রায় সুপ্রিমকোর্ট গত ৩ ‍জুলাই ২০১৭ ঘোষণা করেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয় সম্পর্কিত। বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা বা জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি অঙ্গ স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করেন সংবিধান অনুসারে। এই তিনটি অঙ্গের দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়, মানবাধিকার সমুন্নত থাকে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত হয় ও সুশাসন নিশ্চিত হয়। যা গণতন্ত্রকে সুসংহত করে। পয়েন্ট অব অর্ডারে উত্থাপিত আলোচনায় সাংবিধানিক বিষয় সম্পর্কিত হওয়ায় জাতীয় সংসদে এই বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে নির্ধারিত দিনে জাতীয় সংসদে আলোচনার সুযোগ থাকবে।’

Back to top button