শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নারী নেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থকে স্মরণ করলেন সুহৃদরা
বিশিষ্ট নারী নেত্রী, সমাজ প্রগতির লড়াইয়ের আগ্রসৈনিক এডভোকেট রাখী দাশ পুরকায়স্থকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করলেন তাঁর সুহৃদ ও সহযোদ্ধারা। এই নারী নেত্রীর প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘রাখী দাশ পুরকায়স্থের সুহৃদবৃন্দে’র আয়োজনে আজ (১০ এপ্রিল) শনিবার, এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। স্মরণ আয়োজনটি আইপিনিউজ এর ফেসবুক পেইজে সরাসরি সম্প্রসার করা হয়। বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শহনাজ সুমি’র সঞ্চালনায় উক্ত স্মরণ আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী জান্নাত-এ-ফেরদৌসী লাকী’র পরিবেশিত একটি গানের মধ্য দিয়ে উক্ত স্মরণ আলোচনায় অংশ নেন উক্ত নারী নেত্রীর দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সাম্পাদক সীমা মোসলেম, রাখী দাশ পুরকায়স্থের জীবনসঙ্গী ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, বাংলাদেশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদার, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারন সম্পাদক সালেহ আহমদ। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া থেকে সংযুক্ত হয়ে আলোচনায় অংশ নেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সভানেত্রী চৈতালী ত্রিপুরা। আলোচনার শুরুতেই আবৃত্তিকার ও সংস্কৃতি কর্মী রূপশ্রী চক্রবর্তী নারী নেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থের জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে নারী নেত্রী সীমা মোসলেম বলেন, তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করাটা একটা বিরাট বেপার। ছাত্র জীবনে ছাত্র ই্উনিয়ন এর রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া, মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নেওয়া সহ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাথে যুক্ত হওয়া। এইসব নানা বর্ণাঢ্য স্মৃতি তাঁর সাথে রয়েছে। জীবন ব্যাপী তাঁর সাধনার মূলে ছিল প্রগতিশীলতা এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা।
সমাজের জন্য মানুষের জন্য তাঁর ছিল সীমাহীন অঙ্গীকার ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, দক্ষ সংগঠক । কাজের প্রতি তাঁর ছিলেন প্রবল ঝোঁক। টেকসই নারী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে তিনি ছিলেন আপোসহীন।ঝর-ঝঞ্চাতময় জীবনের কোনো অংশ থেকেই তিনি মুখ ফিরিয়ে নেননি বলে মনে করেন তিনি। নিজের প্রতি চরম অবহেলায় তিনি কেবল সংগঠন ও অন্যের প্রতি ছিল দায়বদ্ধ। সামাজিক অঙ্গীকার, দায়বদ্ধতা ও আদর্শের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর জীবনকে অতিবাহিত করেছেন যা তরুণ প্রজন্মের জানা বাঞ্চনীয় বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, সমাজের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা’র বাইরেও আমি রাখি দিকে দেখি পঙ্কজ দা’র মত সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগ্রামীর স্ত্রী হিসাবে। দেশের কোনো অংশে কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটে তখন পঙ্কজ দা’ ছুটে যেতেন। তখন তিনি সবসময় পঙ্কজ দা’কে খেয়ালে রাখতেন সঙ্গী হিসাবে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি চৈতালী ত্রিপুরা বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকেই রাখি দি’র সাথে দেখা। পাহাড় তথা গোটা বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদেরকে সংগঠতিত করা এবং মূল স্রোতধারার নারী আন্দোলন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাথে যুক্ত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। আমাদেরকে খুব যত্ম সহকারে মূল স্রোতধারার নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করা এবং আদিবাসী নারীদের দাবী ও আন্দোলনকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা ও সরকারের কাছে দাবী তুলে ধরার পেছনে তাঁর অবদান অনেক। মূল স্রোত ধারার নারী আন্দোলনের সাথে আদিবাসী নারীদের মধ্যেকার ভুল বোঝাবুঝির ও মতনৈক্য দেখা দিলে তিনিই মধ্যস্থতা করতেন এবং কারেকশন করে দিতেন। পাহাড় তথা গোটা বাংলাদেশের আদিবাসী নারী আন্দোলন তাঁর ন্যয়নিষ্ঠা এবং অবদানকে চিরকাল স্মরণে রাখবে বলে মনে করেন সাবেক এই নারী নেত্রী।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারন সম্পাদক সালেহ আহমদ বলেন, চলে যাওয়ার আগমূহুর্ত পর্যন্ত তাঁর ধ্যান ধারণায় ছিল নারী জাগরণ, সমাজ ও দেশ মাতৃকাকে নিয়ে। নারী নেত্রী ছাড়াও তিনি একজন সমাজকর্মী, দায়িত্বশীল পরিবারের অভিবাবক, সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী পঙ্কজ দা’র তদারক ও সহকর্মী। তাঁর চাওয়া পাওয়া ও চাহিদা ছিল সীমিত। নিজের প্রতি তাঁর উদাসীনতা থাকলেও সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম দায়বদ্ধতা। বাংলাদেশের নারী জাগরনের লড়াই এবং প্রগতিশীল রাজনীতিতে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলেও মনে করেন তিনি।
এডভোকেট সুলাতানা কামাল বলেন, রাখী দাশ আমার কাছে একজন নারী আন্দোলনের কর্মী। আমার মা’ (কবি সুফিয়া কামাল) এর সাথে তাঁদের ছিল সাংগঠনিক যোগাযোগ। তাঁর মৃত্যুতে একজন বন্ধুতে যেমন হারিয়েছি তেমনি নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলন একজনকে হারিয়েছে। আমার মা’র মৃত্যুর পর মহিলা পরিষদের আন্দোলন ও অঙ্গীকারকে যারা এগিয়ে নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে স্তম্ব হিসাবে যারা কাজ করেছেন তার মধ্যে রাখি ছিলেন অন্যতম। তাঁর নীরব ভূমিকার মধ্য দিয়েই তিনি অবদান রেখে গেছেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, তিনি ছিলেন একজন প্রতিবাদী মুখ।ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার পাশে দাঁড়ানো ছিল তাঁর কাজ। বাংলাদেশের প্রগতির আন্দোলন একজন পরম বন্ধুকে হারিযেছে। যে কয়টি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন চলমান রয়েছে তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম বলেও মনে করেন তিনি।
রাখী দাশ পুরকায়স্থের জীবন সঙ্গী ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, আমার জীবনের যা কিছু অর্জন সব কিছুর পেছনে রাখি জড়িত। সার্বক্ষণিক ত্যাগী রাজনীতির সাথে নিবিড়ভাবে আমার জড়িত থাকার পেছনে রাখির অবদান অনেক। তাঁকে হারিয়ে আমি অভিভাবকহীন। মানব সংগ্রামের যে লড়াই তিনি করে গেছেন সে লড়াই পরবর্তী প্রজন্ম এগিয়ে নিবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সঞ্জীব দ্রং তাঁর সভাপতির বক্তব্যে বলেন, আদিবাসী মানুষের সংগ্রাম, আন্দোলন,সভা ও মিছিলে রাখি দি’ সবসময় ছিলেন। আমরা জানি ভালো মানুষরা কখনো চিরতরে চলে যাননা। তারা প্রতীক্ষণ আমাদের পাশে পাশে থাকেন তাঁদের জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মহনতী, পাহাড়ী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগণের সংগ্রামে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলেও মনে করেন এই আদিবাসী নেতা।
এছাড়া স্মরণ আয়োজনে অংশ নেন আসাম থেকে রাখি দাশ পুরকায়স্থের বোনের কন্যা দেবারতি ভৌমিক, ঢাবি শিক্ষক জোবাইদা নাসরীণ কণা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি এডভোকেট তবারক হোসেইন প্রমুখ।
উল্লেখ্য যে, গত বছর করোনা মহামারীর মধ্যে ৬৮ বছর বয়সে ভারতের গুয়াহাটির অ্যাপলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিশিষ্ট নারী নেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থ। ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ছিলেন ইডেন কলেচ ছাত্র সংসদের পরপর তিনবারের নির্বাচিত ভিপি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রিও নেন তিনি। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের নির্বাচিত সহ-সভাপতিও ছিলেন তিনি। চাকরি জীবনে ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের যুগ্ম সচিব। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন প্রগতিশীল নারী আন্দোলনে। সর্বশেষ বাংলাদেশ মহিলা পরিরষদের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এই নারী নেত্রী।
Video Link- https://www.facebook.com/ipnewsbd/videos/3498202323739034