শেরপুর ও ময়মনসিংহের ৫টি উপজেলা প্লাবিত: পানিবন্দি লক্ষাধিক আদিবাসী ও বাঙালি
আদিবাসী অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগৃহীত তথ্য সাপেক্ষে বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে আইপিনিউজ বিডির রিপোরর্টার অনুপম ঘাগ্রা।
হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া এলাকার বন্যা পরিস্থিতি
টানা ২২ ঘণ্টার ভারী বর্ষণে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলা প্লাবিত, তলিয়ে গেছে আমন ধানের জমি, ভেঙে গেছে শতাধিক মাটির বাড়িঘর। হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত।
“প্রকৃতির কাছে আমরা বড় অসহায়। নিজের চোখের সামনে ঘর ভেঙে যাইতাছে, তাও কিছু করতে পারতাছি না”
— মান্নাম মার্টিন স্কু, মনিকুড়া গ্রামের বাসিন্দা।
তিনি আরও জানান, মনিকুড়া সহ আসে পাশের গ্রামে তার সামনেই ৫-১০ টি ঘর ভেঙে যেতে দেখেছেন। কিছু কিছু জায়গায় বুক সমান পানি। প্রকৃতির কাছে যে মানুষ কত অসহায় তা তিনি এভাবে কখনও উপলব্ধি করেন নাই।
রাংরাপাড়ার স্থানীয়রা বলেন, তাদের জীবদ্দশায় কখনই এমন পানি কেউ দেখে নাই। তাদের অঞ্চল উঁচু এলাকা। এখানে এইভাবে পানি প্রবেশ করবে তা কল্পনা করা যায় না।
আদিবাসী অধ্যুষিত গারো গ্রামগুলোতে বেশিরভাগ বাড়িই মাটির। মাটির বাড়ি গুলো টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানির কারণে ভেঙে পড়ছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। আশেপাশের পাকা বাড়ি বা দুইতলা-তিনতলা বাড়িগুলোতে গিয়ে লোকজন আশ্রয় নিচ্ছ।
“আনুমানিক ৫০ বছর পুরনো বহু যত্নে রাখা আমাদের এই মাটির ঘরটা আর নেই , আজ আনুমানিক রাত ৯ টার দিকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এর সলিলসমাধি হয়েছে।”
— সুবর্ণ চিসিম, হালুয়াঘাটের চরবাঙ্গালিয়া গ্রামের বাসিন্দা।
ময়মনসিংহে গত ২৪ ঘন্টায় ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভারী বর্ষন ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ধোবাউড়ায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। আজ শুক্রবার বিকাল ৪টায় কিছুটা কমে আসলেও আবার বৃষ্টি শুরু হয়।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, হালুয়াঘাট উপজেলার ভুবনকুড়া, জুগলী, গাজিরভিটা, হালুয়াঘাট সদর, নড়াইল, বিলডোরা, ধারা, ধুরাইল,শাকুয়াই ইউনিয়নসহ ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে।
ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া, গামারীতলা, ঘোঁষগাও, পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের অন্তত ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে।
পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ। আশ্রয় নিচ্ছে উপজেলার স্কুলগুলোতে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, তলিয়ে গেছে আমন ধানের ক্ষেত। ক্ষতির মুখোমুখি দুই এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। এখনও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাতে আরও বৃদ্ধি পাবার আশংকা।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী-নালিতাবাড়ি এলাকার বন্যা পরিস্থিতি
ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের মহারশি নদীর চারটি বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত শেরপুরের ঝিনাইগাতীসহ আরও অনেক অঞ্চল। গত ২৪ ঘণ্টায় শেরপুরে ২২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দের বয়ান অনুযায়ী, টানা বৃষ্টির ফলে গতকাল থেকেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল মহারশি নদীর পানি আজ (শুক্রবার) ভোরের দিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের চারটি স্থান ভেঙ্গে যায় ও লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে।
ঝিনাইগাতী উপজেলার সন্ধ্যাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জীব স্কু জানান, “আমি আজ ঢাকা থেকে নাইট কোচে ঝিনাইগাতী পৌঁছায়। এসে দেখি পাহাড়ি ঢলে ঝিনাইগাতী সদর তলিয়ে গেছে। খুব কষ্ট করে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছায়। পথে রাস্তায় এত পানির স্রোত ছিল যে হাঁটা খুবই মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। আমার বাড়ির রান্নাঘরে ও গোয়ালঘরে পানি ঢুকেছে, আমার থাকার ঘরটায় কখন পানি ঢুকে ঠিক নাই। আমি এখন পাশের পাড়ায় এসে রাতের খাবার খাচ্ছি। আমার ফোনে মাত্র ১৫% চার্য আছে। বিদ্যুৎ ও নেই, পরিস্থিতি যদি রাতে আরও খারাপ হয় কি করবো জানিনা।”
স্থানীয়রা বলেন, খুবই অল্পসময়ের মধ্যেই (৩-৪ ঘণ্টা) বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হতে থাকে। ঝিনাইগাতী সদরসহ এলাকার শতাধিক গ্রাম ইতিমধ্যে প্লাবিত। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার।
উপজেলা পরিষদ কার্যালয়, কৃষি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও বাড়ি ঘরে পানি ঢুকেছে, রাস্তাঘাট পানির নিচে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।
চেল্লাখালি ও ভোগাই নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান আজ শুক্রবার দুপুরে জানান, নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই নদীর পানি আজ সকালে নাকুগাঁও পয়েন্টে ১৭২ সেন্টিমিটার, নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার এবং চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া, ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি নদীর পানিও বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে বাঁধ। (সূত্রঃ দ্য ডেইলি স্টার)
শনিবার রাতে ভারতের মেঘালয়ে ভারি বৃষ্টিপাত হবে এবং তা আরও কয়েকদিন পর্যন্ত চলতে পারে। মহারশি, ভোগাই ও নিতাই নদী গুলোর উজান মেঘালয়ের দিকে। ফলতঃ পাহাড়ি ঢলের ও নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।