মতামত ও বিশ্লেষণ

শৃগালবৃত্তির রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জাতীয় বাজেট বরাদ্দে আদিবাসীদের প্রতি প্রবঞ্চনার আখ্যান (১ম পর্ব)

লেখক: মিলিন্দ মারমা

কোন এক বনে এক শেয়াল -বাঘ, ইঁদুর, নেকড়ে ও বেজি -এই চার বন্ধুর সাথে একত্রে বসবাস করত। সে ছিল অতি স্বার্থ পরায়ন। একদিন তারা এক হরিণকে শিকার করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। তখন সে পরামর্শ দিলো, যখন হরিণ শুয়ে থাকবে ইঁদুর গিয়ে পা দুটো কামড়ে জখম করে দিক, তাহলে বাঘ তাকে অনায়াসে কাবু করে ফেলতে পারবে I শেয়ালের কথা মতো তারা হরিণকে ধরাশায়ী করে ফেললো । তখন সবাইকে সে বলল- অহে , তোমরা সকলে স্নান করে এসো, আমিই হরিনের মৃত দেহটি পাহারা দিচ্ছি I বন্ধুরা সকলে যার যার মতো নদীতীরে গেলোI সবার আগে বাঘ ফিরে এল I শেয়ালকে চিন্তিত দেখে বলল-হে শেয়াল !তুমি কি কারণে দুঃখ পাচ্ছ? শেয়াল উত্তর দিলো -হে মহাবাহো! ইঁদুর যা বলেছে শোন I সে বলল-আমিই আজ এই হরিণকে মেরেছি I বাঘের বল বিক্রমে ধিক! আমারই পেশীশক্তিতে আজ তোমাদের উদরপূর্তি হবে I বলতে কি সে গর্ব করে এমনভাবে তর্জন গর্জন করছিলো যে এই হরিনের মাংস খেতে আমার আর রুচি নাই । তখন বাঘ বলে উঠলো, তুমি সঠিক সময়ে আমাকে জানিয়েছ । আমি নিজের বাহুবলে শিকার ধরে খাব, চললাম! এই বলে বাঘ প্রস্থান করলো। এর মধ্যে ইঁদুর এসে হাজির হলো। তাকে শেয়াল বললো- ইঁদুর, তুমি ভালো আছ তো? তোমার ব্যাপারে নেকড়ে কি বলেছে শোন-সে বলল, এই হরিনের মাংস খেতে আমার আর অভিরুচি নাই। এই মাংস বিষ বলে মনে হচ্ছে I তোমার সন্মতি থাকলে আমি এখনই ইঁদুরকে গিয়ে খেয়ে ফেলি I এই কথা শোনা মাত্র ইঁদুর প্রাণভয়ে গর্তে ঢুকে গেলোI কিছুক্ষন পরে সেখানে নেকড়ে ফিরে এল। শেয়াল তাকে দেখে বলল- ভাই! বাঘ তোমার উপর খুবই রেগে আছেন। তোমার অনিষ্ট হবার সম্ভাবনা, তিনি সস্ত্রীক এদিকেই আসছেন । এক্ষণে যা কর্তব্য হয় কর। তখন নেকড়ে বাঘের ভয়ে চম্পট দিলো I এই অবসরে বেজি স্নান করে সেখানে উপস্থিত হলI তাকে দেখে শেয়াল বললো-এই যে বেজি, আমি নিজের বহুবলে সকলকে পরাজিত করেছি I তারা স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করেছে I এক্ষণে আমার সাথে যদি যুদ্ধে জয়ী হতে পার, তাহলে হরিনের মাংস খেতে পারো । বেজি উত্তর দিলো, হে শেয়াল ! অন্যরা যখন তোমার কাছে পরাজতি হয়েছে, তুমিই সবার চেয়ে শক্তিশালী।তোমার সাথে লড়াই করতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই, চললাম। এভাবে বেজিও পালিয়ে গেল। এভাবে কূটবুদ্ধি পরায়ন শেয়াল হরিণের মাংস একাই ভোগ করেছিল I (কনিক নীতি, কালী প্রসন্ন সিংহ, সারস্বত প্রকাশন, ২০২৩)I

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষ, যেমন, আদিবাসী, পারিবারিক কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষ, গ্রামীণ নারী, যুব জনগোষ্ঠী, কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার উদ্দিষ্ট মানুষ, নগর দরিদ্র প্রভৃতির দশা হচ্ছে গল্পে বর্ণিত সেই বাঘ, নেকড়ে, বেজি ও ইঁদুরের মত। এই জনসমষ্টি সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব এবং সম্পদের ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে গত ৫ দশক ধরে। এই সমস্ত জনসমষ্টির মধ্যে আদিবাসীদের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়, অনেকটা গল্পের সেই ইঁদুরের মতো, যাদেরকে অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে প্রতিনিয়ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আদিবাসীদের যথেষ্ট অবদান থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর তাদের হয়েছে করুণ দশা। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হবার সময় সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পাওয়ার জন্য আদিবাসীদের যে দাবি উত্থাপিত হয়, তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এভাবেই একক জাতিরাষ্ট্রের অলীক মতাদর্শ নাকচ করে দিয়েছিলো দেশের জাতিতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বাস্তবতাকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তীতে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তি দানের জন্য যারা দায়িত্ব নিয়েছেন, তারাও কি দেশের বহুত্ববাদী আদর্শ বা বৈশিষ্ট্যকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন? জুলাই বিপ্লবের পরে যখন সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে কমিশন গঠিত হয়, তখন দেশের সচেতন আদিবাসীদের একটা সুপ্ত আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা ছিল যে, আদিবাসীদের মধ্যে বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ চাকমা নরেশ রাজা দেবাশীষ রায় সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশনে অন্তর্ভুক্ত হবেন I কিন্তু আদিবাসীদের সেই আশালতা ফলবতী হয়নি এবং সুনির্দিষ্টভাবে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিও কমিশনের প্রতিবেদনে শেষ পর্যন্ত আর উচ্চারিত হয়নি I সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নাকচ করে দেয়ার আন্দোলনে সাফল্যের জেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেলো পাহাড়ের উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কি এক পৈশাচিক উল্লাস! তানভীর হোসেন ইমন নামের একজনকে ফেইসবুক এ পোস্ট করতে দেখলাম, “২৪ ঘন্টার যুদ্ধ শেষে সংবিধান সংশোধন কমিটি থেকে বাদ পড়লো কুখ্যাত ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় I তাকে সরানোর জন্য লবিং, নিউজ, লেখা লেখি বাদ যায়নি কিছুই, সর্ব শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম আমরা I কৃতজ্ঞ : পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ” I

বিগত ৫ দশক ধরে রাষ্ট্রের যে বাজেট তৈরি হয়েছে, সেই বাজেটে আদিবাসীরা থেকেছে উপেক্ষিত ও প্রবঞ্চিত। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত রাষ্ট্রের এই প্রবঞ্চনার প্রক্রিয়াকে নামকরণ করেছেন—মানুষের ‘অ-জনগণকরণ’ । ড. আবুল বারকাতের মতে, “এসব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা যে সমাজে বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে, সে সমাজে সংশ্লিষ্ট মানুষ ব্যক্তি হিসেবে এবং সমাজবদ্ধ গোষ্ঠী হিসেবে জনগণ নন। তারা অ-জনগণ। আর ‘অ-জনগণকরণ’ অথবা একই কথা ‘অ-জনগণীকরণ’ হলো সে প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মানুষেরা বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা বিধিবদ্ধ রূপে ভোগ করে এবং এসবের গতি হয় ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান যাই-ই বলুক না কেন, সেই সব মানুষ এবং গোষ্ঠী অ-জনগণ, যারা রাষ্ট্রের রেডারের বাইরে, ‘বহিঃস্থ’, ‘অন্যজন’—যারা হিসেবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত নন, যারা গণনার বাইরে, যারা নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন-উচ্ছেদিত, সমূলে উৎপাটিত, নির্বংশ …”(গ্রন্থঃ অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি—আবুল বারকাত, ২০২৩)

ছবিটি বান্দরবানের থানচি থেকে তোলা। ছবি- আইপিনিউজ

মূলত দেশের ৯৫% মানুষ, যারা প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে, তারাই হলো “অ-জনগণ”। এরা মূলত দেশের অর্থ-সামাজিক কাঠামোগতভাবে নিরন্তর বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতার শিকার। অন্যদিকে, হাতেগোনা কিছু লুটেরা-পরজীবী-রেন্ট সিকার ও তাদের সহযোগীরা এই “অ-জনগণ” ভুক্ত মানুষের অংশ নয়। শুরুতে বর্ণিত গল্পের কূটবুদ্ধি পরায়ণ শেয়াল হচ্ছে যেন দেশের এই ৫% মানুষের রূপক, যারা অন্যদের বঞ্চিত করে দেশের শাসনক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সিংহভাগ কুক্ষিগত করে রেখেছে বিগত ৫ দশক ধরে। তারা হচ্ছে সমাজের শ্রেণী মইয়ের সর্বোচ্চ স্তরের ৫% মানুষ। তারা মূলত দেশের গুটি কয়েক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা বিদ্যমান রয়েছে রাষ্ট্রের আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগে। তাছাড়া দেশের সব ধরনের লুটেরা-পরজীবী-রেন্ট সিকাররাও এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত।

রাষ্ট্রের নীতি বিভিন্ন প্রান্তিক মানুষসহ আদিবাসীদের অনুকূলে না থাকায় আদিবাসীরা দিন দিন আরো প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন । তারা ক্রমাগতভাবে ভূমি হারাচ্ছেন। আদিবাসীদের ভূমি হারানোর প্রক্রিয়াটাও প্রান্তিক বাঙালিদের ভূমি হারানোর প্রক্রিয়ার চেয়ে দ্রুততর ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, আদিবাসী সাঁওতালদের ৭২% এখন ভূমিহীন, আর পাহাড়ের আদিবাসীদের ভূমি হারানোর বেদনা আরো গভীর। ৫ দশক আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি আদিবাসীদের আনুপাতিক হার যেখানে ছিল ৭৫%, এখন তা দাঁড়িয়েছে ৪৭%-এ। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে আদিবাসীদের বেহাত হয়ে যাওয়া ভূমি ফেরত দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বিধিবাম ! তা কখনোই কার্যকর করা হয়নি। পাহাড়িরা নিজেদের এলাকায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছেন, অন্যদিকে পুনর্বাসিত বাঙালি সেটলাররা হয়ে উঠছেন সংখ্যাগুরু। আদিবাসীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে হারাচ্ছেন তাদের ভূমি ও বনাঞ্চল।

আদিবাসীদের দারিদ্র্যের হার পর্যালোচনা করে দেখলে বোঝা যায় তারা কী পরিমাণ বৈষম্যের শিকার হয়ে এসেছেন। সারাদেশে যখন নিরংকুশ দারিদ্র্যের হার ৪৪% (সরাসরি ক্যালোরি পরিভোগ অনুসারে), তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে সেটা ৬৫% আর সমতলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ৬০%। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের লুসাই, চাক, খিয়াং, পাংখোয়া, বম এবং সমতলের সাঁওতাল, ওরাও ও পাহান আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এই হার ৭০% বা তার চেয়ে বেশি । অন্যদিকে, চরম দারিদ্র্যের হার সমগ্র বাংলাদেশে যখন ২২%, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল ৩৫% এবং সমতলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ছিল ২৫%। আবার পাহান ও পাত্র আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এই হার ২৮%। এটি শুধুমাত্র খাদ্য পরিভোগের মাপকাঠির ভিত্তিতে মাপা দারিদ্র্য—দারিদ্র্যের অন্যান্য রূপ বিবেচনায় নিলে আরো বিপর্যয়কর চিত্র ফুটে উঠবে।(গ্রন্থঃ অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি—আবুল বারাকাত, ২০২৩)I আরো জানা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬৭% খানা হচ্ছে ভূমিহীন (জমির রেজিস্ট্রিকৃত ব্যক্তি মালিকানার অর্থে) আর সমতলের আদিবাসীদের ৬৯% খানা কার্যত ভূমিহীন (কার্যত ভূমিহীন খানা হলো সেই খানা যার ভিটের জমির বাইরে নিজস্ব মালিকানায় কোনো জমি নেই অথবা সর্বোচ্চ ৫০ ডেসিমেল পর্যন্ত জমি আছে)। তাছাড়া সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে ৯২% পাত্র , ৮৫% পাহান, ৭৫% সাঁওতাল কার্যত ভূমিহীন। (গ্রন্থঃ অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি—আবুল বারকাত, ২০২৩)I

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ সরেন একদিন ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরই মূলত সাঁওতালসহ সমতলের আদিবাসীরা ভূমি হারাতে শুরু করে ব্যাপক আকারে। স্বাধীনতার আগে ভূমি হারানোর বেদনা তাদের কম ভোগ করতে হয়েছিল । তার কথা শুনে মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানেই হয়তোবা আদিবাসীদের কাছে ভূমি হারানো আর দেশান্তরী হবার স্বাধীনতা। খাগড়াছড়ির মং সার্কেলের রাজা মংপ্রুসাইন ছিলেন একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি তার রাজবাড়ী ও ব্যক্তিগত অস্ত্রাগার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। পরিণামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার রাজবাড়ী তছনছ করে তাণ্ডবলীলা চালায় এবং তার সম্পত্তির ক্ষতি করে । কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই তার জায়গা জমি বেদখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সামাজিক সূত্রে শুনেছি, বহিরাগত অ-পাহাড়িদের দ্বারা তার জায়গা জমি বেদখল হতে থাকলে, তিনি নিরুপায় হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন প্রতিকার পাওয়ার আশায়। বঙ্গবন্ধু অভিযোগ শুনে তার ধানমন্ডি-৩২ নম্বর রোডের বাড়ির ছাদে মং রাজাকে ডেকে নিয়ে যানI আর চারপাশের ঘরবাড়ি ও লোকজনদের দেখিয়ে তিনি যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম নাকি ছিল এরকম–দেখো, রাজা মশাই, এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে আমি দু’বেলা দুমুঠো ভাতও ঠিকমতো খাওয়াতে পারি না, অথচ আমি কিন্তু এখনো তাদেরকে বলিনি, তোমাদের জায়গা জমি দখল করে নিতে। যদি তা করতে বলতাম, তাহলে তোমাদের কোন জায়গা জমি আর আস্ত থাকতো না। সুতরাং, যা ঘটছে তা রিয়ালিটি হিসেবে মেনে নাও।

মং রাজা বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ মতো রিয়ালিটি মেনে নিয়েছিলেন কিনা জানি না। তবে স্বাধীনতার পরপর আদিবাসীদের ভূমি হারানোর চিত্রটি ছিল সারা দেশে একই রকম। সমতলের ১০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী গত ৩ দশকে (১৯৭৮–২০০৯) জোরপূর্বক উচ্ছেদ হয়ে ভূমি হারিয়েছে মোট ৬,০৭,০০০ বিঘা , যার বাজার মূল্য বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে গত ৫ দশক ধরে আদিবাসীদের মোট জনসংখ্যা বরাবরই কম দেখানো হয়ে আসছে, যাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ন্যায্য হিস্যা দিতে না হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ২০০১ সালের আদম শুমারীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ৪ হাজার ৪২৬ টি গ্রামের মধ্যে ৩১.৩% গ্রামে জনসংখ্যা গণনায় করা হয়নি। বাদপড়া গ্রামগুলোর জনসংখ্যা যদি গণনা করা হতো তা হলে প্রকৃত জনসংখ্যা আরো অনেক বেশি হতো। এভাবে আদিবাসীদের জনসংখ্যা প্রকৃত জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম দেখানো হয়ে আসছে, যাতে ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা যায়।

বাংলাদেশে বিগত ৫ দশকে জাতীয় বাজেটে (১৯৭২–২০২২) মোট উন্নয়ন প্রকল্প/কার্যক্রমের সংখ্যা ছিল ১,০৬,৫৩৫ টি I এর মধ্যে ৫৭২৬ টি (৫.৩৭%) কোন না কোনভাবে আদিবাসীদের সামনে রেখে করা। আদিবাসীদের জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ ধরলে তারা দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৯৪% (যদিও সরকারি হিসেবে তা ১%)। এই হিসেবে আদিবাসীদের উন্নয়নে নিয়োজিত প্রকল্প সংখ্যা দেশের মোট উন্নয়ন প্রকল্প বা কার্যক্রমের ৫.৩৭%, যা আপাত দৃষ্টিতে ভালো মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিগত ৫ দশকে জাতীয় বাজেটে সরকারের মোট বরাদ্দ ছিল (২০২১–২২ অর্থ বছরের বাজার মূল্যে) ৬০ লক্ষ ৩৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, এর মধ্যে আদিবাসী মানুষ সংশ্লিষ্ট বরাদ্দের পরিমাণ ১ লক্ষ ৭৫৭ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো বিগত ৫ দশকে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত মোট অর্থের মাত্র ১.৬৭% বরাদ্দ হয়েছে আদিবাসী সংশ্লিষ্ট প্রকল্প ও কার্যক্রমে। অথচ আদিবাসীরা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ২.৯৪%।(গ্রন্থঃ অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি—আবুল বারকাত, ২০২৩, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার)I সেখানে আদিবাসীরা মোট জনসংখ্যার ২.৯৪%, সেখানে জাতীয় বাজেটে ১.৬৭% বরাদ্দ দেওয়া একটি প্রবঞ্চনা বলা যায়।

এই বরাদ্দ গড় গত ৫ দশকে প্রায় প্রতি বছরই জনসংখ্যার অনুপাতে বরাবরই ছিল অপ্রতুল। আবার আদিবাসীদেরকে সামনে রেখে করা এ বাজেট বরাদ্দে গড়ে উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল অনুন্নয়ন বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম। এক্ষেত্রে আদিবাসীদের স্বার্থকে কখনো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনা হয়নি। উপেক্ষা আর বঞ্চনা ছিল আদিবাসীদের জন্য একটি স্বাভাবিক প্রপঞ্চ। আবার জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের গড় হিস্যা গত ৫ দশকে ১.৬৭% হলেও ৫ দশকের মধ্যে ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে বরাদ্দ হয়েছিল এই গড় হিস্যার তুলনায় কম। তাছাড়া এই বরাদ্দ শুধু অপ্রতুলই নয়, কখনোই আদিবাসীদেরকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সেই বরাদ্দগুলো দেওয়া হয়নি। এই নগণ্য পরিমাণ বরাদ্দের মধ্যে আবার সিংহভাগ ছিল “অনুন্নয়ন” বরাদ্দ। আবার যখনই বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে তখনই বর্ধিত বরাদ্দের সিংহভাগ দিয়ে দেয়া হয়েছে “অনুন্নয়ন” খাতে।

চলবে ——–

মিলিন্দ মারমা: আদিবাসী লেখক ও অধিকারকর্মী I
Email: [email protected]

 

Back to top button