শান্তির জন্য লড়ছেন সন্তু লারমা: আশি’তে বিশিষ্টজনদের শুভেচ্ছা

বিশেষ প্রতিবেদক: জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। সন্তু লারমা নামেই সমাধিক পরিচিত। এক সময়কার গেরিলা নেতা, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আজ (১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২) সোমবার। তিনি আশি বছরে পা দিলেন। তাঁর জন্মদিনে দেশের বিশিষ্টজনরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেশের প্রগতিশীল ভাবনার মানুষ, কবি, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, লেখক, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীসহ আপামর মানুষ এই নেতাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
আশিতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, তিনি (সন্তু লারমা) আশি বছরে পদার্পণ করেছেন এ কথা জেনে আন্তরিক অভিনন্দন, অভিবাদন ও শুভকামনা জানাচ্ছি। জুম্ম জাতিগোষ্ঠীদের অস্তিত্ব,আত্মপরিচয়,সমানাধিকার,সাংবিধানিক স্বীকৃতি সহ ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের সংগ্রাম, সমতলের জাতিগোষ্ঠী সমূহের নিরাপত্তাসহ পৃথক ভূমি কমিশন এবং শোষিত বঞ্চিত বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামে তাঁর অব্যাহত অবদান সফল হোক, এ প্রত্যাশা করি। তাঁর সক্রিয় শতাব্দী জোড়া সুস্বাস্থ্যের জীবনও কামনা করেন বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, এদেশের গণমানুষের নেতা সন্তু লারমা’র আজকে আশিতম জন্মদিন। আমরা তাঁকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। তিনি যে সারাটা জীবন এদেশের আদিবাসী মানুষের জন্য এবং সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন সেজন্য তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি মনে করি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র তথা গোটা পৃথিবীর যে বাস্তবতা তাতে দেখা যায়, প্রতিটি রাষ্ট্রেই বহু জাতির ও বহু সংস্কৃতির মানুষ বাস করে।সেখানে বহু সংস্কৃতি ও জাতিস্বত্তার লালন করাটা আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের মত রাষ্ট্র সে বেপারে পিছিয়ে আছে। এই সংগ্রামে অনেক সময় রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রের এই অসচেতনতা এবং অপারগতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল হতে হয়। সেই কাজটাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা এবং সন্তু লারমা। তাঁদের প্রতি আমাদের অনন্ত শুভেচ্ছা রইল। আজীবন সন্তু লারমা এই সংগ্রামের পতাকাকে ঊর্দ্ধে তুলে রাখবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন ঢাবি’র এই শিক্ষক।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই। আমি তাঁকে দুই যুগ ধরে দেখছি। সারা দেশের আদিবাসীদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শুভেচ্ছা। তিনি শুধু আদিবাসী-পাহাড়ী মানুষের জন্য না। তিনি সকল শ্রমজীবি, খেটে-খাওয়া ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একজন মূর্ত প্রতীক। এই কঠিন সময়েও তরুণরা তাঁর সংগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। তাঁর দীর্ঘ সুস্বাস্থ এবং দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করেন এই আদিবাসী নেতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, তিনি (সন্তু লারমা) আমারও নেতা। জাতীয় পর্যায়ের একজন নেতা।কীভাবে আদিবাসী, প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় তা তাঁর কাছ থেকে শেখা। কেবল আদিবাসী নয়, প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষের পাশে কীভাবে দাঁড়াতে হয়, যেখানে জুলুম হয় সেখানে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও কীভাবে দাঁড়াতে হয় সে সংগ্রামে তিনি আমাদের সাহসের অফুরন্ত অনুপ্রেরণা হিসাবে আছেন। আগামী বহু বছর তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস হিসাবে থাকবেন বলেও আশা প্রকাশ করেনে এই শিক্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ আইপিনিউজকে বলেন, বাংলাদেশে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম এবং তাদের অধিকার আদায়ের যে রাজনীতি সেখানে নিশ্চিতভাবে সন্তু লারমা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি শুধুমাত্র আদিবাসী জনগণের জন্য না, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সন্তু লারমা মানুষের কাছে একজন নেতা হিসাবে আছেন এবং থাকবেন। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম আরো বেগবান হবে বলেও মনে করেন ঢাবি’র এই অধ্যাপক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী আইপিনিউজকে বলেন, সন্তু লারমা’র জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাই। এটা আমাদের সবার জন্য আনন্দের বিষয় যে, এরকম একটা সংকটময় সময়েও তিনি এখনো সুস্থ আছেন। আমার দেখা মতে, বাংলাদেশে যতজন জন-মানুষের নেতা আছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি নেতা হিসাবে যুদ্ধ এবং শান্তি দু’টোই করেছেন। এরকম নেতা পৃথিবীতে বিরল। যিনি শান্তি ও অধিকারের জন্যই যুদ্ধ করেছেন। তিনি কেবল রাষ্ট্রের সাথে না, নিজেদের মধ্যেকার বুদ্ধিবৃ্ত্তিক লড়াইও করেছেন। আসাধারণ একজন ব্যক্তিত্ব, অমায়িক ও দেশপ্রেমিক মানুষ তিনি। বাংলাদেশের অপরাপর সাধারণ মানুষের জন্য তিনি যা ভাবেন তা আমাকে অভিভূত করেছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এবং রাষ্ট্রও তার সংগ্রামকে ভালোভাবে বুঝতে পারেনি বলেও মত দেন ঢাবি’র এই শিক্ষক।
এদিকে আশি ছোঁয়া এই নেতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী জান্নাত-এ-ফেরদৌসী বলেন, তিনি এক বড় যোদ্ধা ও সংগ্রামী। নিপীড়িত মানুষ ও আদিবাসী মানুষের মুক্তির সংগ্রাম করছেন তিনি। আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে যেভাবে তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন তাঁকে সেজন্য স্যালুট জানাই। তাঁর সংগ্রাম সফল হওয়া মানে আমাদের স্বপ্ন সফল হওয়া বলেও মত দেন তিনি।
বিশিষ্ট কবি হাফিজ রশিদ খান এক মুঠোআলাপে আইপিনিউজকে বলেন, সন্তু লারমা আমাদের বৃহত্তর সমাজের অবিচ্ছেদ্য নেতৃত্বে আসীন।তিনি যে পাহাড়ে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতার কথা বলেছেন সেটি নতুন বা অদ্ভুত কিছু না। সেটা তাঁদের পূর্বপুরুষ এবং আমাদের পূর্বপুরুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত। তিনি পাহাড়ের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ছায়ায় এনে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথে গেছেন যেটিকে আমরা শান্তিচুক্তি বলি। সেটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সন্তু লারমা বস্তুত গণতান্ত্রিক মনোভাপান্ন বলেই পাহাড়ের মানুষকে জাতীয় স্বার্থেই এই সমঝোতার পথে সামিল করেছেন বলেও মনে করেন তিনি। পাহাড়ের এই নেতার জন্মদিনে শুভকামনাও জানান এই কবি।
স্বাক্ষর করছেন পাহাড়ের এক সময়কার গেরিলা নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। ২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ ইং। স্থান: রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, ঢাকা।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান আইপিনিউজকে বলেন, তিনি (সন্তু লারমা) যে আশি বছরে পদার্পন করলেন তা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। এখনো আমরা পাহাড়ের আদিবাসী মানুষের লড়াইয়ে তাঁর বিকল্প দেখি না। তিনি এখনো বলিষ্ট কন্ঠস্বর হিসাবে আমাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে আমরা পাহাড়ীরা যে কঠিন সময় অতিক্রম করছি তা থেকে উত্তোরণে তাঁর মত নেতার নেতৃত্বের বিকল্প দেখি না। পাহাড়ে যে সংকট চলছে তা সন্ত লারমার নেতৃত্বেই উত্তোরণ হবে বলেও মনে করেন এই বিশিষ্টজন।
উল্লেখ্য যে, জ্যোতিরিন্দ্রি বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ১৯৪২ সালের আজকের এই দিনে রাঙামাটির নান্যেচর উপজেলার বুড়িঘাট মৌজার মহাপুরম গ্রামে জন্ম নেন। বাবার নাম চিত্ত কিশোর চাকমা; মা সুভাষিণী দেওয়ান। চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা, তারপর দুই ভাই শুভেন্দু প্রবাস লারমা এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তাঁদের মধ্যে সবার ছোট সন্তু লারমা।
সন্তু লারমা মহাপুরম জুনিয়র হাইস্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৫৯ সালে। চট্টগ্রামের স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে তিনি ১৯৬১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ পাস করেন। শিক্ষাকতা দিয়ে শুরু করেন তাঁর পেশাগত জীবন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন মাইসছড়ি জুনিয়র হাইস্কুল, গুইমারা জুনিয়র হাইস্কুল ও দীঘিনালা হাইস্কুলে। চাকরি জীবনেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শিক্ষক সমিতি গঠন করেন এবং তিনি ছিলেন এর সভাপতি।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সন্তু লারমা। ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি গঠনে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমাজকল্যাণ সমিতি গঠন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ছিলেন। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় পার্বত চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এর মাধ্যমেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইয়ে সামিল হন। ১৯৭৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পান ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি। সে বছরই জেএসএসের নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব নেন। ১৯৮৩ সালে জেএসএসের সভাপতি হন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৯২ সাল থেকে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দেনে এই নেতা। পিসিজেএসএস তথা জুম্ম জনগণের পক্ষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৯৯ সালের ১২ মে চুক্তির ফলে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হন তিনি। এখনো সেই পদে আছেন। এর পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। সন্তু লারমা ১৯৬৪ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী শিপ্রা দেওয়ান অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। তাঁদের দুই মেয়ে আছে।