লামায় প্রাকৃতিক বন পুড়িয়ে দেয়া এবং পটিয়ায় জিতেন গুহকে নির্যাতনের ঘটনায় নাগরিক সমাজের নিন্দা
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): বান্দরবানের লামা উপজেলায় লাংকমপাড়া, রেংয়েনপাড়া ও জয়চন্দ্রপাড়ার প্রায় ৩৫০ একর জুমচাষের প্রাকৃতিক বন পুড়িয়ে দেয়া এবং চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি জিতেন কান্তি গুহকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ১৬ জন নাগরিক যৌথ বিবৃতি প্রদান করেছেন। আজ শনিবার সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো উক্ত বিবৃতিতে তারা একই সাথে ঘটনা দুটির সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।
বিবৃতিদাতাদের অন্যতম এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা স্বাক্ষরিত উক্ত বিবৃতিতে বলা হয় যে, গত ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় জিতেন কান্তি গুহ নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যাবার পর অভিযুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বি কে জসিম ও তার ছেলেকে পরদিন পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর দুদিন আগে গত ২৭ এপ্রিল বান্দরবানের লামা উপজেলার লাংকম পাড়া, জয় চন্দ্র কারবারী পাড়া ও রেংয়েন কারবারী পাড়ার আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরাদের জুম চাষের প্রাকৃতিক বন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই আগুনে প্রায় সাড়ে তিনশ একর জুমের ধান, বাঁশ, আম, কলা, আনারসসহ বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত পাড়াগুলোর আদিবাসীদের অভিযোগ, জমি দখলের জন্য লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানীর লোকজন বাগানে পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগিয়েছে। উচ্ছেদ আতঙ্কে ভুগছেন তারা।
এই দুই ঘটনাই সারা দেশে প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট একশ্রেণীর সামাজিক অপরাধী, ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত এবং ভূমিদস্যু একের পর এক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক অবস্থানে থাকা অন্যান্য নারী-পুরুষদের উপর দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যে নিপীড়ণ, উচ্ছেদ, অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তারই সাম্প্রতিক ধারাবাহিকতার সাক্ষ্য বহন করে বলেও মনে করেন বিবৃতিদাতারা।
এদিকে প্রথম ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, একাত্তরের চেতনা- সাম্য আর অসাম্প্রদায়িকতাকে কেবল বুলি হিসেবেই যে কিছু কিছু লোক আওড়ায়, আর বাস্তবে চরম সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড চালাতেও দ্বিধা করে না সেটা স্পষ্ট উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরো বলা হয়, গত দুই দশক ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর ঘটে যাওয়া হামলা-নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার না হওয়ায় এবং ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের একাংশের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে একটির পর একটি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। পূর্বের ঘটনাগুলোর বিচারহীনতা বজায় থাকলে এরকম ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটতেই থাকবে। এছাড়া জিতেন কান্তি গুহের ওপর নির্যাতনের ঘটনার নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়ে বিবৃতিদাতারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।
একইসাথে লামার তিনটি পাড়ার জুমের জমির বাগান পুড়িয়ে দেবার সাথে জড়িতদের একটি স্বাধীন, দ্রুত ও কার্যকর তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ৪০টি পরিবারকে পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং জনগণকে সে তথ্য জানানোর দাবি জানান বিশিষ্টজনরা।
পত্রপত্রিকার সংবাদের বরাত দিয়ে বিবৃতিদাতারা বলেন, অধিকাংশ পাড়াবাসী খাবার সংকটে ভুগছেন, আগুনে তাদের বাগান পুড়ে যাওয়ায় তাদের ঘরে খাবার নেই। পানীয় জলের সঙ্কটেও আছেন তারা। জঙ্গলের বিভিন্ন লতাপাতা সেদ্ধ করে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। তাই তাঁরা প্রশাসনের কাছে ভুক্তভোগীদের খাবার ও পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবিও জানান। একই সাথে সচেতন নাগরিক সমাজকেও তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান নাগরিকরা। এছাড়া উচ্ছেদ আতঙ্ক ও খাদ্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা এই জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা প্রদানে সর্বোচ্চ প্রশাসনকে এগিয়ে আসার জোর দাবি জানায় উক্ত নাগরিকবৃন্দ।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এড. সুলতানা কামাল, নারী নেত্রী ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জমান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য এড. জেড আই খান পান্না, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এড. রাণা দাশগুপ্ত, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এড. সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ পরিষদের উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ, সামাজিক আন্দোলনের সাবেক সহ-সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এড. তবারক হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগ-এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এবং তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা এবং এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা প্রমুখ।