অন্যান্য

লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতা থাকলে সফলতা অবশ্যই ধরা দেবে; বিশাখা দেওয়ান

শ্যাম সাগর মানকিনঃ নবম শ্রেণীতে এক পরীক্ষায় বায়োলজিতে খারাপ করেছিলেন ক্লাসে প্রায় সময় প্রথম হওয়া বিশাখা দেওয়ান। সে কথা মাকে আর দিদিকে বলতে পারেননি ভয়ে। কিন্তু একদিন তার দিদি জেনে যায়, মাকে জানান সে কথা। সেদিন অনেক আশংকা আর ভয়ে বাসায় ফিরেন বিশাখা। তিনি একপ্রকার ধরেই নিয়েছিলেন ঐদিন তার জীবনে একটা ঝড় বয়ে যাবে। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন তার মা আর দিদি তাকে কিচ্ছুটি বলছেন না, উলটো কথা বলায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দিদি আর মা কষ্ট পেয়েছিলেন যে পরীক্ষায় খারাপ করার কথা বিশাখা নিজের মুখে বলেনি। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বিশাখার জন্য নতুন ক্লাসে বাড়তি যত্ন প্রয়োজন ছিলো। প্রাইভেট পড়ালে হয়তো মেয়েটা পরীক্ষায় খারাপ করতোনা। সে কারনে পরে তার প্রাইভেট শিক্ষকের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ঘটনাটা হয়তো খুবই ছোট কিন্তু এই ছোট ঘটনা বিশাখা দেওয়ানের জীবন পালটে দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা রেখেছিলো। মা আর দিদির নীরবতা তাকে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছিল। আজ শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে আসীন করতে পেরেছেন কিংবা জীবনের আর যা সফলতা, সেই শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তির কাজ করেছিলো।

বাবা সরকারি চাকরিজীবী রোহিতাশ্ব দেওয়ান যখন মারা যান তখন বিশাখা দেওয়ানের বয়স ১১ মাস, আর তার বড় বোনের বয়স ৬ বছরের কাছাকাছি। সে কারনেই বলা যায় বিশাখার বেড়ে ওঠা মায়ের নিবিড় অভিভাবকত্বে। মা সনজিতা চাকমা রাঙামাটি জেলা হিসাব রক্ষকের অফিসে চাকরি করতেন। কিন্তু অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যাবার পর সংসার চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাথে দুই ছোট মেয়েকে নিবিড় পর্যবেক্ষন রেখে যথাযথভাবে গড়ে তোলার কাজ কঠিন বটে। কিন্তু সে কঠিন কাজ দৃঢ়তার সাথে করে গেছেন সঞ্জিতা চাকমা। দুটো মেয়েকে তাদের নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের জীবনের সমস্ত উজার করে দিয়ে গেছেন। সনজিতা চাকমার সেই প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। তাই আজ তার বড় মেয়ে একজন ডেন্টিস্ট এবং ছোট মেয়ে বিশাখা দেওয়ান শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে কঠোর অধ্যয়নের ভেতরেই বেড়ে ওঠা বিশাখা দেওয়ানের। মায়ের কড়া শাসনের মধ্যেই দুই বোনের পড়াশুনা চলতো। শিক্ষার্থী হিসেবেও দুই বোন মেধাবী ছিলো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি পরীক্ষায় দুজনেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। বিশাখা দেওয়ান স্কুলে বরাবরই প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছেন। তার প্রাথমিক শিক্ষার শুরুটা হয়েছিলো বনরুপা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর ২০০৪ সালে এসএসসি পাশ করেন রাঙামাটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে। দেশের অন্যতম খ্যাতনামা হলিক্রশ কলেজ থেকে নিজের উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন এগ্রি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ফ্যাকাল্টি থেকে এবং এমএসসি করেছেন এগ্রি বিজনেস এন্ড মার্কেটিং বিভাগ থেকে।

বড়বোন ডাক্তারি পড়ছে তাই মায়ের ইচ্ছে ছিলো ছোট মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবেন। কলেজে পড়ার সময় কি যেনো ভেবে ডাক্তারি পড়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু দিদির ডাক্তারি পড়াশুনার বহর দেখে কিছুটা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। পড়ে পাড়ার এক বড়ভাই শ্যামল প্রসাদ চাকমার শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার কথা তাঁর মা জানতেন। সেই জন্যে তাকে সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার কথা বলেন। এখানে পরীক্ষা দিয়ে বিশাখা দেওয়ান আদিবাসী কোটায় প্রথম হয়ে উর্ত্তীন হন এবং এগ্রি বিজনেস ম্যানেজমেন্টের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে সেখানে ভর্তি হয়ে যান। সেখানেও তাঁর ভালো ফলাফল অব্যাহত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই এবং শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় পরীক্ষার ফলাফল ভালো করা অব্যাহত রাখেন বিশাখা দেওয়ান। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ভাল ফলাফলের কারনে তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার দরোজা খুলে যায়।

২০১৩ সালের মার্চে শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন বিশাখা দেওয়ান। এরপর ২০১৫ সালে পদোন্নতি হয়ে সহকারী অধ্যাপক হন। কদিন আগেই হয়েছেন এগ্রি বিজনেস এন্ড মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। দুই বছরের জন্য তিনি এই বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে থাকবেন। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ান এ্যাওয়ার্ড ফেলোশীপে আফ্রিকার কেনিয়াতে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির দুই বছরের কোর্স করছেন তিনি। তাছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের নানান উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী নারীদের নিয়ে তাদের ক্ষমতায়নের সমস্যা ও কারন চিহ্নিতকরনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে এক গবেষণায় লিপ্ত রয়েছেন তিনি।

বিশাখা দেওয়ান মনে করেন জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে যথাযথ সংকল্প নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেক কিছুই অর্জন করা সম্ভব। অনেকেই নিজের জীবনের জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেননা। আমরা আদিবাসীরা যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠি তাতে আমাদের ভেতর একটা ভয় কাজ করে আমি কি পারবো? কিন্তু এই ভয়টা অমূলক। নিজের লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতা থাকলে সফলতা অবশ্যই ধরা দেবে। আমরা আদিবাসীরাও অনেক কিছুই করতে পারি আসলে, আমাদের সে সম্ভবনা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

বিশাখা দেওয়ানের জীবনের এই পথচলায় মায়ের গুরুত্ব অপরীসীম। তাঁর ভাষায়, মা ছাড়া আসলে কোন কিছুই সম্ভব হতোনা। মা সবদিকেই খেয়াল রাখতেন। ২৫-২৬ বছরে বিধবা হয়ে যাওয়া এক নারী যার আবার সংসার করার সুযোগ ছিলো, পরিবারও চেয়েছিলেন কিন্তু আমাদের জন্য তিনি সেই সুযোগ ত্যাগ করেন। হয়তো মায়ের এই ত্যাগ না থাকলে গল্পটা অন্যরকম হতেও পারতো। কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কিছুটা জড়িয়ে আসে বিশাখা দেওয়ানের। তাছাড়া অনেক দিনপর তারা দুইবোন জানতে পারেন তাদের পড়াতে গিয়ে মায়ের অনেক জায়গায় ঋণের বোঝা ভারী হয়েছে। তবুও কখনোই মেয়েদের সে কষ্ট জানতে দেননি তিনি। নিজেদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে মায়ের সেই ত্যাগ এবং কষ্টের যথাযথ প্রতিদান দিয়েছেন বিশাখা দেওয়ান ও তাঁর বোন।

পাহাড়ে যে সমস্ত কৃষিজপন্য উৎপাদিত হয় সে সব যদি একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে নিয়ে আসা যায়, এবং দেশের বাইরে নিয়ে যাবার সুযোগ তৈরি হয় তবে পাহাড়ের চাষীরা অনেক লাভবান হতে পারবেন। তাঁর স্বপ্ন আগামী দিনে সেই ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য তিনি কাজ করবেন। সে জন্য তিনি মনে করেন সরকার ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিৎ। কিন্তু সেই কাজের, সে স্বপ্নের শুরুটা কাওকে না কাওকে করতে হবে। সে দায়িত্ববোধ থেকে তিনি নিজের আগামী দিনের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে এই বিষয়টি বেছে নিয়েছেন।

বিশাখা দেওয়ান জন্মগ্রহণ করেছেন রাঙামাটি জেলার পশ্চিম ট্রাইবাল আদামে ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিজে যেমন গর্বিত তেমনি গর্বিত করেছেন সমাজের মানুষকে, আদিবাসী সত্তাকে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আদিবাসীদের প্রতি অন্যন্যদের যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে তা যাতে পালটে দিতে পারেন সে ভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করে যান শিক্ষার্থীদের কাছে, বিশ্বের আরো তাবৎ মানুষের কাছে। জীবনের বৈরি পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত বিশাখা দেওয়ান।

Back to top button