জাতীয়

রাষ্ট্রীয় হেফাজতে লাল থ্লেং কিম বমের মৃত্যুর বিচার ও নির্দোষ বম নারী-শিশুসহ সকলের মুক্তি চায় সম্মিলিত আদিবাসী ছাত্র সমাজ

আইপিনিউজ ডেস্ক: ”পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ কর।” এই স্লোগানে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে কারাগারে লাল থ্লেং কিম বম-এর মৃত্যুর বিচার, নির্দোষ বম নারী ও শিশুসহ সকলকে মুক্তি এবং চিংমা খেয়াং-এর ধর্ষণের পর হত্যার বিচারের দাবিতে আজ ১৮ মে, রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সম্মিলিত আদিবাসী ছাত্র সমাজ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় এবং বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক নুংমংপ্রু মারমার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক এহসান মাহমুদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ঢাকাস্থ ম্রো শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি পাতলাই ম্রো, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা, বাংলাদেশ খিয়াং স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রতিনিধি জনি খিয়াং এবং বম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের রুমা উপজেলার আহ্বায়ক রিচার্ড বম।

ছবি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করেছে সম্মিলিত আদিবাসী ছাত্র সমাজ।

লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুথানের পরে এটি হওয়ার কথা ছিলো না। পাহাড়ের আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে এবং তার বিচার চাইতে হচ্ছে রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাড়িয়ে, এটি হওয়ার কথা ছিলো না। পাহাড়ে সাধারণ বমদের সন্ত্রাসী বানিয়ে গ্রেপ্তার হত্যা করা হচ্ছে, আর আমাদের ঢাকায় এসে বিচার চাইতে হচ্ছে। এটি হওয়ার কথা ছিলো না। আমি আজকে এখানে দাড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে জানাতে চাই , আমি আজকে এখানে দাড়িয়েছি বান্দরবানের মুনলাই পাড়ার জন্য। যে পাড়া দেশের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম, যে গ্রামের মানুষরা প্রকৃতির মতো সরল তাদের আজ সন্ত্রাসী বানিয়ে পুরো গ্রামবাসীদের গ্রামছাড়া করেছে। যাদের অনেককে আজ বনে জঙ্গলে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই প্রধান উপদেষ্টা, আপনাকে সাজানো সমস্যার সমাধান করতে হবে। কেননা এইসব ঘটনা জুলাই গণহত্যার পরিপন্থী। আজ যে শিশুটি জেলে বন্দি আছে সে তখনো মায়ের পেটে যখন বান্দরবানের ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটে ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, কারাগার কারা চালায়? এই কারাগার চালায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাষ্ট্রের সরকার। তাহলে জেল হেফাজতে অবস্থানরত সকল ব্যক্তিদের খাওয়া, চিকিৎসা, নিরাপত্তা দেওয়ার সকল দ্বায়িত্ব এই রাষ্ট্রের, সরকারের। নিরীহ বমদের বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের দায় যেমন শেখ হাসিনা সরকারের, ঠিক তেমনি কারাগারের ভিতরে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর দায়ও এই অন্তর্বতীকালীন সরকারকে নিতেই হবে। এই দেশের আইন যদি নিরপেক্ষভাবে চলে তাহলে প্রশ্ন থাকবে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জেল থেকে বের হয়ে যায় কিন্তু নিরীহ বমদের বিনা ওয়ারেন্টে, বিনা অপরাধে কিভাবে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদীন জেলে আটকে রাখে? এই প্রশ্ন রাখেন দীপায়ন খীসা।

”৭২ এর সংবিধানে এম এন লারমা নিজের জাতিকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই রাষ্ট্র তা হতে দেয় নাই। দেশের সরকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু আদিবাসীদের সাথে এই রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ আচরণ পরিবর্তন হয় নাই…” মন্তব্য করে সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক এহসান মাহমুদ তার বক্তব্যে আরও বলেন, যে জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদযাত্রায় সবসময় বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাথে সঙ্গ দিয়েছে তাদের সাথে এই রাষ্ট্র বারংবার বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, আমরা খবর পেয়েছি যে সাধারণ বম আদিবাসীদের সন্ত্রাসী সাজিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আটক করে রাখা হয়েছে। তাদের অনেকেই চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন । আমরা এই সরকার, এই রাষ্ট্রকে বলতে চাই আপনারা দ্রুত নিরীহ বম আদিবাসীদের নি:শর্তে ছেড়ে দেন এবং অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা দেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করেন। তা না হলে, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় সেটা কারোর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

ছবি: রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সম্মিলিত আদিবাসী ছাত্র সমাজ

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা তার বক্তব্যে বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর আয়নাঘরে যতজন বন্দি ছিলো তাদের সকলকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে গ্রেপ্তার করা নিরপরাধ বমদের এখনো মুক্তি দেওয়া হয়নি। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বিপদ্জনক কারাগার করে রাখা হয়েছে। আয়নাঘরে চক্ষুর অন্তরালে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু পাহাড়ে প্রকাশ্যে নিরাপরাধ আদিবাসীদের অত্যাচার করা হয়। দেশের সরকার এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। আমি এসব চরিত্রকে ধিক্কার জানাই।

বম ছাত্র প্রতিনিধি রিচার্ড বম বলেন, বিগত তিন বছর ধরে বম জনগোষ্ঠীকে এক প্রকার নজরবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে পুরো বম জনগোষ্ঠীকে হয়রানি করে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর বিচারহীন অবস্থায়। আপনারা কিসের স্বার্থ রক্ষা করতে চান সেটা আমার প্রশ্ন? আজ রাষ্ট্রের অবহেলা, বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে আমার বোনকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হতে হয়। রাষ্ট্র যদি একটু মানবিক হয় তাহলে পাহাড়ের এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক নুমং মারমা বলেন, গতবছরে আটক করা বমদের এখনো পর্যন্ত মুক্তি দেওয়া হয় নাই। বরং এই রাষ্ট্র নানান কায়দা করে এই মিথ্যা মামলাকে বৈধ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে সারা বাংলার অগ্রগতি সম্ভব নয়। সুতরাং এই সরকারকে বলতে চাই অনতিবিলম্বে পাহাড়ের সকল সমস্যার সমাধান করুন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পাতলাই ম্রো বলেন, পাহাড় এবং সমতল মিলিয়ে কয়েকমাসের মধ্যে ১০-১২ টি আদিবাসী নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একটা ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার পাওয়া যায় নাই। আপনারা যদি একটু অনুসন্ধান করে দেখেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশী সামরিকায়ন করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। সেখানে প্রতি ৮ জন আদিবাসীর পিছনে একজন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এত সেনা থাকার পরও এই রক্ষীবাহিনী আদিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে পারে না।

জনি খেয়াং তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, আমরা সবাই জানি যে কেএনএফ সৃষ্টির পেছনে রাষ্ট্রের এক বিশেষ গোষ্ঠী জড়িত। কিন্তু সেই গোষ্ঠী আবার এখন সেই কেএনএফকে দিয়ে সন্ত্রাসী-সন্ত্রাসী নাটক সাজিয়ে সাধারণ বমদের নির্বিচারে গুম, হত্যা , গ্রেপ্তার করে জাতিগতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, আমরা আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো দেখলে দেখতে পাই, তারা সাধারণ বম আদিবাসীদের সন্ত্রাসী হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করার চেষ্টা করে। এই রাষ্ট্রের কোন কিছুই আদিবাসীদের রিপ্রেজেন্ট করে না। ৭২ এর সংবিধানেই তারা সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছে।

সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
সমাবেশে আরও ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের পক্ষ থেকে সংহতি জানানো হয়।

Back to top button