রাঙ্গামাটির কথিত কিশোর গ্যাং ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ
(১)
রাঙ্গামাটিতে সম্প্রতি কথিত কিশোর গ্যাংএর সদস্য অভিযোগে কয়েকজন কিশোরকে গ্রেফতার করেছে স্থানীয় পুলিশ। আমি ফেসবুকেই দেখলাম গ্রেফতার হওয়া প্রতিটা বাচ্চার নাম পিতার নাম আর সেই সাথে ছবি দিয়ে রিপোর্ট করেছে বেশ কয়েকটা নিউজ পোর্টাল। ছাপানো কাগজে এই খবর একইভাবে এসেছে কিনা জানিনা, কিন্তু অনলাইন পোর্টালগুলি থেকে ফেসবুকে শেয়ার হয়ে টয়ে এই বাচ্চাদের নাম ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। এই কাজটা অন্যায় হয়েছে। বাচ্চাদের ছবি আর নাম ঠিকানা এইসব নিশ্চয়ই পুলিশ দিয়েছে সাংবাদিকদের।
এই কাজটা অন্যায় ও অবৈধ হয়েছে। এই কাজটার জন্যে স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আর যে রিপোর্টাররা বাচ্চাদের নাম ছবি এইসব ছেপেছে ওরাও একটা অন্যায় ও অবৈধ কাজ করেছেন। ওদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এই নিয়ে আইন আছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক বাচ্চাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের হলে ওদেরকে গ্রেফতার করা আদালতে উপস্থাপন করা আর ওদের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করা এই সবকিছুতেই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বাচ্চাদের নাম ছবি এইসব কাগজে দেওয়া যাবে না- সে ভিক্টিমই হোক বা অভিযুক্তই হোক।
আর যেভাবে রিপোর্টগুলি এসেছে সেটাও খুবই অন্যায় আরকি। খবরগুলিতে বলা হচ্ছে যে ওরা সকলেই নাকি ক্ষর গ্যাঙের সদস্য আর নানা অপরাধের সাথে জড়িত এই কারণে পুলিশ তাঁদেরকে গ্রেফতার করেছে। এইটা তো ঠিক না ভাই। এমনিতে কিশোররা যদি একটা গ্যাং তৈরি করে সেটা তো অপরাধ না। সুতরাং কেবল একটা গ্যাংএর সদস্য এই কারণে তো কোন বাচ্চাকে আর সাজা দেওয়া যাবে না। যদি ঐরকম গ্যাং বানিয়ে কোন অপরাধ করে ওরা শুধু তখনই ওদের গ্রেফতার বিচার সাজা সেইসব প্রশ্ন আসে। আর আদালত সাজা দেওয়ার আগে ওদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সেগুলিকে অভিযোগ হিসাবেই রিপোর্ট করতে হবে, ওদেরকে অপরাধী বলে রিপোর্ট করতে পারেন না।
(২)
আপনারা যারা পুলিশে কাজ করেন বা সংবাদপত্রে কাজ করেন আপনারা মেহেরবানী করে এইটা মনে রাখবেন। শিশু কিশোরদের বিরুদ্ধে যদি কোন অপরাধের অভিযোগ থাকেও তাইলেও আপনি ব্যাপারটাকে ‘ব্যাটাকে আচ্ছা মতো শায়েস্তা করতে হবে’ এই দৃষ্টিতে দেখতে পারেন না।
এই যে কিশোরদের নিজেদের মধ্যে গ্যাং তৈরি করা আর এইসব গ্যাংএর মাধ্যমে এলাকায় প্রভাব বিস্তার ইত্যাদির চেষ্টা করা এইসব করতে গিয়ে অনেক সময় আইনের সীমারেখার ভুল প্রান্তে চলে যাওয়া এইরকম ঘটনা দেশের সর্বত্র ঘটছে। কিশোররা যখন এইরকম ঘটনায় জড়ায় এইগুলিকে আপনি সাধারণ আর দশটা অপরাধের মতো বিবেচনা করতে পারেন না। এইসব ঘটনায় জড়িত কিশোরদের ক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক বিবেচনা থাকে এইরকম অপরাধের সংশ্লিষ্টতা থেকে কিশোরটিকে কিভাবে মুল স্বাভাবিক সুস্থ ধারায় ফেরত আনবেন। শুধু এইরকম অপরাধ বলেই নয়, শিশু কিশোরদের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ বিচারের ক্ষেত্রেই মুল বিবেচনাটা থাকে এইটা- শিশুটির বা কিশোরটির কল্যাণ।
আর শুধু আদালত কেন, এই যে গ্যাং প্রবণতা, এর জন্যে বিচারের আগে আমাদের সকলেরই ভাবতে দেখতে হবে আমাদের বুড়োদের ব্যর্থতাটা কোন জায়গায়। আমরা কোন জায়গাটায় ভুল করেছি যে আমাদের ছোট ছোট ছেলেরা নিজেদেরকে এইরকম গ্যাংস্টার হিসেবে দেখতে চাইছে।
দেখেন, একটা পনের ষোল সতের বা আঠার বছর বয়সের বাচ্চা, সে তো সুবোধ বালক বা সুবোধ বালিকার মতো পিতামাতা চাচাজ্যাঠা খালামামা বা মাস্টারমশাইদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে চলবে না। একটা দুইটা বাচ্চা হয়তো সুবোধ হবে, বাকিরা হবে প্রাণবন্ত সৃজনশীল এবং মুখর। ওরা নানারকম কাজ করবে যেগুলি প্রচলিত শৃঙ্খলাবোধের সাথে মিলবে না। কিন্তু এই যে শৃঙ্খলা না মানা, এইটাই ওদের প্রাণশক্তির বহিঃপ্রকাশ ওদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। ওদেরকে এটা করতে দিতে হবে। ওদেরকে শৃঙ্খলা ভাঙতে দিতে হবে, ওদেরকে প্রশ্ন করতে দিতে হবে- ওরা যা চায় সেইটাই করতে দিতে হবে, সামান্য একটু নিয়ন্ত্রণ রাখবেন, যেন অন্যের ক্ষতি না করে। ব্যাস।
(৩)
না ভাববেন না যে এইটা আমি একলাই বলছি। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের নেতারা বছরের পড় বছর আলাপ আলোচনা বিচার বিবেচনা গবেষণা ইত্যাদি করে তবেই জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের মতপ্রকাশের অধিকারসহ বড়দের মতো সকল অধিকারের নিশ্চয়তার বিধান করার কথা বলা হয়েছে। আমরা তো এইটা করতে পারছি না। বাচ্চাদেরকে স্বাধীন চিন্তা করতে দিচ্ছি না, রাজনীতি নিয়ে ওদেরকে ভাবতে শিখাই না, মানুষের কথা ওরা ভাববে না, সৃজনশীল কাজ করবে না, তাইলে ওদের এনার্জি কি কাজে ব্যবহৃত হবে?ওরা তো তখন এইসব গ্যাং ফ্যাং করবেই।
শোনেন, অপরাধ যদি কিশোররা করে, আইনত তার বিচার তো হবেই। ওদের বিচারের জন্যে বিশেষ আইন আছে, বিশেষ আদালতও হচ্ছে এখন। বিচার তো হবেই। কিন্তু ওদের বিচার ও সাজার লক্ষ্যটা কি সেটা ভুলবেন না। বদলা নেওয়াটা লক্ষ্য না- সমাজ ওদেরকে শাস্তি দিচ্ছে এটা কিশোর অপরাধীদেরকে সাজা দেওয়ার লক্ষ্য না। লক্ষ্যটা হচ্ছে ওদেরকে সংশোধন করা। ছোট মানুষ, ভুল করে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছে, কিন্তু তাই বলে সারা জীবন সে অপরাধী হিসাবে বাঁচবে নাকি? না, আমাদের dআয়িত্ব হচ্ছে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা ওরা যেন স্বাভাবিক ধারায় ফেরত আসে। ওদের ভবিষ্যৎ আছে, সংশোধন করা গেলে সমাজের জন্যে ওরা অনেক কিছু করতে পারে।
কিশোরদের বিরুদ্ধে যখনই কোন ফৌজদারি পদক্ষেপ নিবেন, গ্রেফতার হোক বা মামলা করা হোক বা মামলা তদন্ত করা হোক বা সেটার ট্রায়াল হোক, এই প্রিন্সিপালটা মাথায় রাখতে হবে। এইটাই নীতি, এইটা আমাদের দেশের আইনও বটে। আর এরই একটা অনুষঙ্গ হচ্ছে যে শিশু কিশোরদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে- গ্রেফতার তদন্ত বা ট্রায়াল যাই হোক না কেন, এগুলির রিপোর্ট যখন আপনারা করবেন বাচ্চাদের নাম উল্লেখ করবেন না ওদের ছবি ছাপাবেন না।
আপনারা এইসব মানবেন না। তো যেই শহরের পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা শিশু অধিকারের এই মৌলিক ব্যাপারটা মানেন না, সাংবাদিকতার এই মৌলিক নিয়মটা মানেন না সেই শহরের কিশোররা কি করবে আর কি শিখবে?
ইমতিয়াজ মাহমুদ; লেখক ও আইনজীবী
ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট থেকে