রঁদেভূ’র মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ কর্মশালা-২০২৫ এর সমাপনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন

গতকাল ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সোমবার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত “মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ কর্মশালা-২০২৫” এর সমাপনী অনুষ্ঠান কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের গ্যালারিতে আজ বিকাল ২:০০ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আদিবাসী ভাষার প্রশিক্ষকদের সম্মাননা ক্রেস্ট এবং প্রশিক্ষণার্থীদের সনদপত্র বিতরণ করা হয়।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চাকমা, প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের (সাবেক) পরিচালক ড. ফারজানা ইয়াসমিন চৌধুরী, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের প্রভাষক(ইংরেজি) নৈরঞ্জনা চাকমা প্রমুখ।
রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক নুখ্যাইমং মারমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি রবি বিকাশ চাকমা। অনুষ্ঠানের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন রঁদেভূ’র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জাল্লাং এনরিকো কুবি।
ড. কাঞ্চন চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্বায়নের যুগে ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর ভাষাসমূহ এখন সংকটে পড়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের এবং ভিন্ন ভাষার আগ্রাসনের ফলে নিজ নিজ মাতৃভাষার গুরুত্ব আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে কমে যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী যুগোপযোগী বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতি নিজে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ভলান্টিয়ারিং কাজ করে আমরা সমাজে ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা বৃদ্ধি করতে পারি। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের এসব উদ্যোগে যুক্ত করে ভাষা-সংস্কৃতি সচেতন প্রজন্ম গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে নিজের ভাষা নিয়েও গবেষণায় মনোযোগী হতে হবে।
ড. সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, একটি ভাষার সাথে একটি জাতির সংস্কৃতি, জীবনযাপন ও মূল্যবোধ ইত্যাদি জড়িত থাকে। ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে এগুলো হারিয়ে ফেলা। ভাষা অনেক কারণেই হারিয়ে যায়, আমরা ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে দেখি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যই এর প্রধান কারণ। এটা যেমন আমেরিকার আদিবাসীদের জন্য সত্য একইভাবে আমাদের দেশের অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে মাতৃভাষায় মেধাবী হওয়া ছাড়া মেধাবী হওয়া যায়না। পৃথিবীতে বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সাথে ঐ ভাষাভাষী লোকের অস্তিত্বও এখন সংকটাপন্ন। আমাদের সকলের নিজ নিজ কমিউনিটির প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। একটা মানুষ বেড়ে ওঠার পেছনে কমিউনিটির ভূমিকা অপরিসীম। রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী তার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
ড. ফারজানা ইয়াসমিন চৌধুরী বলেন, একটা ভাষা সংকটে পড়ে যখন ঐ ভাষায় বলা ও লেখার মানুষ থাকেনা। ভাষা নিয়ে সচেতন হয়ে সংকটাপন্ন ভাষাগুলো নিয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার কর্তৃক আদিবাসী ভাষা নিয়ে যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী তার জায়গা থেকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে যা এ সময়ের জন্য খুবই উপযোগী।
নৈরঞ্জনা চাকমা বলেন, রঁদেভূ’র কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নিজের মাতৃভাষা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। ছোটবেলা থেকে বাংলা ভাষায় পড়ালেখার সূত্রে আমরা নিজের ভাষা চর্চা হারিয়ে ফেলি যা বর্তমান সময়ে অধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ভাষা কর্মশালা উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে যদি নিজের বর্ণমালা ও ভাষা চর্চা ও শেখার সুযোগ পাই, যেটা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গণে রঁদেভূ সৃষ্টি করে দিচ্ছে এটা আমাদের কাজে লাগানো জরুরি।
তিনি আরও বলেন, ভাষা শুধু যোগাযোগ এর মাধ্যম না, এটা আমাদের অস্তিত্বের অংশ। কোন ব্যক্তি একটা ভাষায় কথা বলছে মানে একইসাথে সে ঐ ভাষার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। সামাজিক ভলান্টিয়ারিং এর মাধ্যমে আমাদের এই চর্চা ও উদ্যোগসমূহ বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আধুনিক প্রযুক্তিও আমরা নিজ নিজ ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার্থে ব্যবহার করতে পারি।
সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আয়োজিত সমাপনী অনুষ্ঠানের আলোচনা সভা শেষ হয়। আলোচনা সভার পরবর্তীতে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পর্বের মাধ্যমে সমাপনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য যে, রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে এইবারের কর্মশালায় ৪ টি আদিবাসী ভাষায় মোট ৩৩ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করে সফলভাবে কর্মশালা সম্পন্ন করে।