জাতীয়

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংবিধান দর্শন বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক

আইপিনিউজ ডেস্ক (ঢাকা): মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংবিধান দর্শন বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল, যেখানে সমাজের সকল শ্রেণি, বর্ণ, ও সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে। লারমা সংবিধানের মাধ্যমে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন, যা শ্রেণি এবং জাতিগত বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সবার স্বার্থকে সুরক্ষা দেবে।– ঢাকায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংবিধান দর্শন শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা।

গত ৮ অক্টোবর, ২০২৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে মাওরুম জার্নাল ও আদিবাসীদের জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম আইপিনিউজ এর যৌথ উদ্যোগে ”মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংবিধান দর্শন: জুলাই গণঅভ্যুত্থান, রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী জাতিসমূহের অংশীদারিত্ব” শীর্ষক এক বাহাস ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আইপিনিউজ এর উপ-সম্পাদক সতেজ চাকমার সঞ্চালনায় উক্ত বাহাস ও মতবিনিময় সভার সূত্রধার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক . আমেনা মহসিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন, কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, কবি ও লেখক মিঠুন রাকসাম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ও সাংবাদিক অনিক রায়, আইনজীবী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সায়ক চাকমা

বাহাস ও মতবিনিময় সভার সূত্রধার বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় লারমা রাষ্ট্রের জাতীয়তা নির্ধারণে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের ওপর একতরফা জোর দেওয়ার বিরোধিতা করেন, কারণ এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র পরিচয়কে অস্বীকার করে। লারমা বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রীয় পরিচয় অবশ্যই সকল জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দেওয়া হবে। তিনি উন্নয়ন ও ভূমি অধিকার নিয়ে বিনাশী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর তীব্র সমালোচনা করেন, যা আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জুমচাষ ও কৃষির টিকে থাকার ওপর হুমকি তৈরি করেছিল।

তিনি বলেন, নারীর অধিকার নিয়ে লারমার অবস্থান ছিল খুবই স্পষ্ট। সংবিধানে নারীর অধিকার নিয়ে কোনো স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় তিনি এটিকে সমালোচনা করেন এবং বলেন, সমাজের অর্ধেক অংশ হিসেবে নারীর অধিকারকে উপেক্ষা করা চলবে না। তিনি নারীকে পুরুষের সমান অধিকারের দাবিদার হিসেবে দেখতেন, যা তার দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। লারমা উন্নয়ন, ভূমি অধিকার, এবং নিম্নবর্গের প্রান্তিকতা নিয়ে যে চিন্তা করেছিলেন, তা মূলত পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল। তিনি দেখেছিলেন, পুঁজিবাদী শোষণমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিম্নবর্গের মানুষের জীবন ও তাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছে। লারমার রাজনৈতিক দর্শন কৃষি, ভূমি, এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকারকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছিল। তিনি বিনাশী উন্নয়ন মডেলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সামগ্রিক উন্নয়নকে মানবিক ও মেহনতি মজদুরের স্বার্থে পরিচালিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গি তার রাজনৈতিক কাজেও প্রতিফলিত হয়েছিল। তিনি তার সংগঠনের কর্মীদের পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং কৃষি, জুমচাষ, ও ভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষের স্বার্থ রক্ষার লড়াইকে রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখতেন।

তিনি আরো বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লারমার চিন্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজকের প্রজন্ম যে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনের দাবি তুলেছে—যেখানে ‘হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশ’—এই চেতনা লারমার দার্শনিকতা ও সাম্যবাদের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। নতুন প্রজন্মের গ্রাফিতি ও রাজনৈতিক চেতনায় লারমার চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়, যেখানে পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব এবং উন্নয়নের নামে নিপীড়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। লারমার চিন্তার কেন্দ্রে ছিল রাষ্ট্রের এমন এক রূপান্তর, যেখানে কৃষি, শ্রমজীবী মানুষ, এবং প্রান্তিক সম্প্রদায় সবাই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে মর্যাদার সাথে বসবাস করবে।

মাওরুম জার্নালের সম্পাদক এবং মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা যে আওয়ামী ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়ছি, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সেই ১৯৭২ সালে গণপরিষদ বিতর্কে একাই লড়াই করেছিলেন। তিনি কাঠামোগত ভাবে সংবিধানকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি বহুত্ববাদের চিন্তা করেছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন এ আদিবাসী নেতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে সরল বানানোর ডিসকোর্সের মাধ্যমে নির্যাতন করা হচ্ছে। দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্ধারণে আলোচনা করা উচিত। রাষ্ট্র যে বাঙালি আধিপত্যবাদের ভিত্তিতে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে মূল্যায়ন করে আধিপত্যবাদ আর চলতে পারে না। এ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বদা লড়াই করে গেছেন এম এন লারমা। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ সালের যে বিষয়গুলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ক্ষুন্ন করে সেগুলোকে সংস্কার করা দরকার। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ এর যে ধারাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলোর বিষয়েও কাজ করা জরুরী। মেজরিট্যারিয়ান ডেমোক্রেসিতে সকল শ্রেণী-মানুষদের নিয়ে ডেমোক্রেসি সম্ভব কিনা তা বিচার বিশ্লেষণ করে কিভাবে সকলকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করা যায় তার চেষ্টা করতে হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, তর্কহীন সমাজ মৃত সমাজ। আমরা এমন এক সময়ে এম এন লারমাকে নিয়ে করছি, যখন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সমস্থ রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের সংস্কারের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এ পর্যায়ে এসে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দর্শন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে আরো বেশী প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার মাত্র ৩৬ দিনে ১৫০০ মানুষকে হত্যা করেছে, ৩০,০০০ হাজার মানুষকে  হতাহত করেছে এবং প্রায় ৪০০০ মানুষকে অন্ধ করা হয়েছে যেটা এদেশের বিগত স্বৈরাচারী শাসকদের শাসনের সময়ও করা হয়নি। আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু আমরা এখন কী দেখছি? আমরা দেখছি রাষ্ট্র সংস্কারে নারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে, বাদ দেওয়া হয়েছে আদিবাসীদের। আমরা বরং দেখতে পাই মৌলবাদীদের ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়েছে, ধণাঢ্য শ্রেণীদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। আন্দোলনের সময় আমরা  যে কল্পনা চাকমাকে উদ্ধৃত করেছিলাম  আন্দোলনের পরে তাকে কি কেউ খোঁজার চেষ্টা করেছি? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে শুধুমাত্র ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, সিস্টেম বদলায়নি। দেশের সমস্থ সিস্টেম এখনো স্বৈরাচারী বানানোর পথ খোলা করে রেখেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরো বলেন, এই সংবিধান একটি সামন্তবাদী সংবিধান। যে সংবিধানকে ভেঙে এম এন লারমা, সন্তু লারমারা বের হয়ে উঠে আসতে চেয়েছেন। এ সংবিধান কেবল মুসলমানের, এ সংবিধানে অন্য ধর্মের স্বীকৃতি নেই। এই সংবিধান কেবল বাঙালির, এখানে অন্য কোন জাতির স্থান দেওয়া হয়নি। এদেশের সংবিধানে, রাষ্ট্র সিস্টেমে বহুত্ববাদের স্থান দেওয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশ একটি বহুভাষা, বহুজাতির, বহু সংস্কৃতির দেশ। আমরা এখন যে অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি সে অন্তর্ভুক্তিতে সকল শ্রেণীর মানুষদের কথা বলতে হবে। বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে লক্ষ্যে যে সংবিধান সংস্কার করা হচ্ছে সেখানে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সমাজ দর্শনকে গুরুত্ব দিতে হবে  বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আদিবাসীরা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে রয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পটুয়াখালীতে রাখাইন জনগোষ্ঠীরা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ডেমোগ্রাফিক পলিটিকসের ফলে আগামী ১০ বছরে আদিবাসীদের এ সংখ্যা আরো উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে তখন  জাতিগত স্বীকৃতি দিলেও কোন লাভ হবেনা। তিনি বলেন, একসময়কার নিপীড়িত জাতি এখন নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশের আদিবাসীদের উপড় নির্যাতন করছে। এ সমস্থ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ এবং রাষ্ট্র নির্মাণ জবাবদিহীতার কাঠামো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে।

মতবিনিময় সভার একাংশ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন বলেন, এম এন লারমাই প্রথম, যিনি জাতি এবং জাতীয়তার ব্যপারে প্রশ্ন করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে  বাঙালী ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের বুঝাতে যে উপজাতী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা আসলে একটি উপনিবেশিক মনঃস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ ছিলো। এ সময়ে এসে একটি জাতির সংজ্ঞায়নের প্রশ্নে একই ধরণের চিন্তা করা সঠিক নয়।  তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আজকের এ সকল বিষয়গুলোকে সংস্কার করতে হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদেরকে আমরা সবসময় উপনিবেশিক চশমা দিয়ে দেখি। এ চশমাটি খুলে আদিবাসীরাও যে দেশের গর্বিত নাগরিক, তাদেরও যে অধিকার রয়েছে সে অধিকার সুরক্ষায় সকলকে কাজ করতে হবে । আজকের নতুন বাংলাদেশে আমরা এথনিসিটি নির্ধারণ করার সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের সমতল অঞ্চলেও যে সমস্থ আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ বলেন, এম এন লারমার ধারণাকে বাঙালীর চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে। যে কারণে তাকে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকলে আঞ্চলিক নেতা হিসেবে রাখা হয়েছিলো। অথচ তিনি দেশের সকল শ্রেণীর মেহনতি মানুষের অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ করার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, যে শ্রেণী দ্বারা দেশের প্রথম সংবিধান রচনা করা হয়েছে সেই উচ্চবিত্ত শ্রেণী-ই বর্তমান সংস্কার কমিশনকেও প্রতিনিধিত্ব করছে। যার ফলে এ সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। তিনি আরো বলেন, মূলত যেদিন শেখ মুজিবুর রহমান আদিবাসীদেরকে বাঙালী হয়ে যেতে বলেছিলেন সেদিন থেকেই দেশের আদিবাসীদের মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। এখন আমাদের সামনে নতুন সুযোগ এসেছে সকলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। সমতা, ন্যায্যতা এবং মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে সাথে নিয়ে লড়াই করে যেতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, আমরা যে এক দফার ভিত্তিতে আন্দোলন করেছিলাম সেটি এখনো সফল হয়নি। তবে এ আন্দোলনের ফলে নতুন করে প্রশ্ন করার সুযোগ এসেছে, আলাপ আলোচনার সুযোগ এসেছে। এ আলাপ আলোচনার পরিসর যেন শেষ না হয়। আমাদের সংবিধান একটি অভিশপ্ত সংবিধানে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নাগরিক মর্যাদাকে বেশ গুরুত্বসহকারে দেখা হয় কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান এটি করতে ব্যর্থ। সুতরাং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংবিধানকে জনমুখী করতে হবে। নতুন সংবিধানে নাগরিক মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকলে শ্রেণীর মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, এম এন লারমা সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে যে বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার কথা বলেছিলেন সেই যৌথতা এবং শান্তি-ই হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রধান ভিত্তি।

কবি ও লেখক মিঠুন রাকসাম বলেন, আমি যে সময়ে এখানে কথা বলছি সে সময়ে আমার এলাকায় বন্যায় ঘর ডুবে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বন্যায় সরকার এবং গণমানুষের যে প্রতিক্রিয়া সেটা উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই না।মূলত সংবিধানে আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি না দেওয়ার ফলেই প্রান্তিক মানুষদের সাথে এ ধরণের বৈষম্য করা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। যে নতুন সংবিধান সংস্কার করা হচ্ছে সেখানে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানান তিনি।

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ও সাংবাদিক অনিক রায় বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে শুধুমাত্র আঞ্চলিক নেতা হিসেবে রাখা অত্যন্ত দুঃখের এবং এটা তার প্রতি অন্যায়ের সামিল। কেননা, আজকে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে আমরা যে আলোচনাগুলো করছি, সেগুলো ১৯৭২ সালেই তিনি বলে গেছেন। তিনি বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংবিধান বিতর্ক অধ্যয়ন না করে সংবিধান রচনা করা সম্ভব নয়। কারণ,আজকের তরুণ প্রজন্মের গ্রাফিতিগুলোর মাধ্যমে যে আকাঙ্ক্ষার বার্তা দেওয়া হচ্ছে সেই বার্তাগুলো শ্রী লারমা ১৯৭২ সালের সংবিধানে বলে গেছেন। তিনিই প্রথম এদেশে বহুত্ত্ববাদের কথা বলেছেন। কিন্তু সেই সময়ের গণপরিষদ সংবিধানে শুধুমাত্র মুজিববাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কাজ করে গেছে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্যা সেটা রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে কোন  ধরণের বৈষম্য রাখা উচিত হবেনা। সারা দেশে একই ধরণের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোন একটা অঞ্চলকে একটি নির্দিষ্ট বাহিনী কর্তৃক শাসন ও শোষনে রেখে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে না। সেজন্য সবাইকে নিয়ে আলোচনা করতে হবে, আলোচনার ধার খোলা রাখতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আইনজীবী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সায়ক চাকমা বলেন, এম এন লারমা সংবিধান বিতর্কে‍শুধু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কথা বলেননি, বরং দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কথা বলেছেন। তিনি শোষন-বঞ্চনাহীন সমাজের কথা বলেছেন। তিনি কোন নির্দিষ্ট জাতির নেতা নন, তিনি একজন জাতীয় নেতা। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী একটি বড় স্টেকহোল্ডার। আমরা একটি ইতিহাসের সন্ধিঃক্ষণে দাড়িয়ে আছি। একটি বড় রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে পরাভূত করে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে সে সংস্কারে আদিবাসীদের ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব রাখতে হবে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম প্রথাগত সমাজব্যবস্থা ভেঙে যে বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গঠনে হাত দিয়েছে সেখানে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না করলে সেই বৈষম্যহীন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে না।

Back to top button