মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য আদিবাসীদের অবদান

মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য আদিবাসীদের অবদান
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশদের উপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে শাসিত হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও প্রকৃত অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে শাসন ক্ষমতা চলে যাওয়ায় পুনরায় উপনিবেশিক শাসনের অধীনে চলে আসে এদেশ। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ এদেশের মানুষ গ্রহণ করার সুযোগতো পায় নি, বরং পাকিস্তান আমলের চব্বিশ বছরের দুঃশাসনে জনজীবন হয়ে উঠে আরো দুর্বিষহ। তাই শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক প্রতিনিয়ত শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও বৈষ্যমের স্বীকার এদেশের মুক্তিকামী জনগণ ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে অগণিত শহীদদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করে মহান গৌরবময় বিজয়। আর এই মহান বিজয় অর্জনের অন্যতম অংশীদার দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে পার্বত্য অঞ্চল দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বিভিন্ন দিক থেকে স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বিধায় মুক্তিযুদ্ধে উক্ত অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। স্মরণাতীত কাল থেকে পার্বত্য আদিবাসীরা অনেকাংশে স্বাধীনভাবে বসবাস করলেও পাকিস্তান আমলের শাসন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক আকার ধারণ করে শাসন-শোষণের চিত্র। ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে পড়ে এই অঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। পাকিস্তানী দুঃশাসনের ছোবলে পার্বত্য আদিবাসীরা প্রান্তিক থেকে আরো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন হিসেবে তৎকালীন সময়ে দেশের চলমান মহান মুক্তিসংগ্রামে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ বিভিন্ন ট্রেইনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে গড়ে তোলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এক বিরাট প্রতিরোধ সংগ্রাম।
ত্রিপুরা, আরাকান, মুঘল, ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বার্তমান খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলাগুলো নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলতঃ পাহাড়-পর্বত, নদী-ছড়া, ঝর্ণা, অরণ্য ইত্যাদি প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরপুর একটি অঞ্চল। এই অঞ্চলে বাঙালি জাতির লোকজন ছাড়াও রয়েছে- ম্রো, খেয়াং, চাক, বম, খুমী, পাংখোয়া, লুসাই, ত্রিপুরা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা, সাঁওতাল, গুর্খা, আসাম, রাখাইন ইত্যাদি নামের আদিবাসী জাতির লোকজন। এই আদিবাসী জাতিগুলোর রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রথা, রীতিনীতি ইত্যাদি। তাই নানান দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। বলা হয়ে থাকে, এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম ত্রিপুরা ও আরাকানের শাসকদের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্র ছিল এবং এটি প্রায়ই দখল-বদল হতো। বীর রাজ ৫৯০ সালে পার্বত্য ত্রিপুরা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। জুজারুপা (বীর রাজা) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজাকে পরাজিত করে রাঙ্গামাটিকে তার রাজধানী স্থাপন করেন। ঐতিহ্য অনুসারে, পার্বত্য ত্রিপুরা রাজা উদয়গিরি Kilay এবং Manglay দুই ভাইকে মাতামুহুরী নদীর দক্ষিণে পাহাড়ে বসবাসকারী রিয়াংদের Officers-in-charge দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে, Tsula Tsandra (৯৫১-৯৫৭), আরাকানের রাজা বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের জেলা দখল করেন। আবার, ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা এই অঞ্চল দখল করেন ( (ISHAQ, 1975))।[১] ত্রিপুরা রাজার শাসন ক্ষমতার হাত থেকে চট্টগ্রামকে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ ১৩৪২ সালে দখল করলে চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন শুরু হয়। সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের চট্টগ্রাম জয়ের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনের সূত্রপাত ঘটে এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে ত্রিপুরা, আরাকান ও মুসলিম এই তিনশক্তির বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় (ত্রিপুরা, ২০০৬)।[২] তবে মুসলিম শাসকরা বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। ১৭১৫ সাল থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত মোগল শাসনামলে এবং ১৭৬০ সাল থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত ইংরেজ শাসনামলে এ অঞ্চলে তুলার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হত। ১৭৬০ সালের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা মুঘল সম্রাটের অধীনে অনেকটা স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৭৭ ও ১৭৮০ সাল বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে দুইবার সংঘর্ষের পর ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা জান বক্স খাঁ কোম্পানীর বশ্যতা স্বীকার করে নিলে তা সম্পূর্ণরূপে কোম্পানীর প্রভাবাধীনে চলে যায়। বৃটিশ শাসন শুরু হয় পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির উপর অর্থনৈতিক শোষনের মধ্যে দিয়ে। ১৮৬০ সালের ২০ জুন তারিখের Notification No.-3302 অনুসারে ১লা আগস্ট ‘রেইডস অব ফ্রন্টিয়ার ট্রাইব এ্যক্ট ২২ অব ১৮৬০’ অনুসারে পার্বত্য অঞ্চলকে চট্টগ্রাম জেলা থেকে পৃথক করে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে স্বতন্ত্র জেলায় পরিণত করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ ভারতের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রণয়ন করা হয় জেলার দেওয়ানী, ফৌজদারী বিচার ও রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রণয়ন করা হয়- ‘রেইডস অব ফ্রন্টিয়ার ট্রাইব এ্যক্ট ২২ অব ১৮৬০’, ‘এ্যাক্ট ৪ (বি.সী.) অব ১৮৬৩’, ‘রেগুলেশন ৫ অব ১৮৬৩’, ‘চিটাগাং হিলট্রেক্ট ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন ১৮৮১’ আইনগুলো।[৩] ১৮৮১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর মং, চাকমা ও বোমাং নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ৩ টি সার্কেলে বিভক্ত করে প্রত্যেক সার্কেলে ১ জন করে সার্কেল চীফ নিয়োগ দেওয়া হয়। বৃটিশ সরকার ১৮৮১ সালে ‘চিটাগাং হিলট্রেক্ট ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন’ প্রবর্তন করে স্থানীয় জাতিসত্তাদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। ১৯০০ সালে জারিকৃত CHITAGONG HILL TRACTS REGULATION ACT – 1900 অনুযায়ী এ অঞ্চলকে Excluded Area হিসেবে শাসন করা হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও তদানিন্তন পার্বত্য চট্টগ্রামের Excluded Area -এর মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হয়। তাই পরবর্তীতে বৃটিশ সরকার সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীদের মনে একটি বন্ধুভাবাপন্ন ইতিবাচক ধারনার জন্ম হয়। [৪] ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কয়েকটি গুরুতর অপরাধ ব্যতীত সার্কেল চীফ তাঁর সার্কেলের সাধারণ অধিবাসীদের সম্পর্কিত অধিকাংশ বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা লাভ করতেন। যারা জুম চাষ কিংবা লাঙলভিত্তিক স্থায়ী চাষাবাদে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের জন্য জুম ট্যাক্স প্রদান বাধ্যতামূলক ছিল। এছাড়া কোনো ব্যক্তি এক সার্কেলে বসবাস করে অন্য সার্কেলে জুম চাষ করলে তাকে নিজ সার্কেলের রাজার পাশাপাশি যে সার্কেলে চাষ করত সেই সার্কেলের রাজার নিকটও জুম কর প্রদান করতে হতো। আবার একই সার্কেলের এক মৌজায় বসবাস করে অন্য মৌজায় জুম চাষ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ মৌজার হেডম্যানকে নিয়মিত প্রাপ্য পরিশোধের পাশাপাশি যে মৌজায় চাষাবাদ করত সেই মৌজার হেডম্যানকেও অর্ধেক হারে খাজনা প্রদান করতে হতো।[৫]
পাকিস্তান শাসনামলের পার্বত্য চট্টগ্রাম
পাহাড়ের অনেক লেখকের ভাষায় ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি পরবর্তী সময়ে আদিবাসীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘোষণা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ঘোষণা, ব্রিটিশ সরকারের ভাগ কর শাসন কর নীতি, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে বৃটেনের ক্ষমতার পালাবদল, ১৯৪৬ সালের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচানে মুসলিম লীগের জয়লাভ, ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা, সারা ভারতে সংঘটিত নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সব মিলিয়ে ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির পরের বছর ৩০ জুনের মধ্যে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা আসে। এটলির এই ঘোষণায় পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষও নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজনৈতিকভাবে চেষ্টা তদবিরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।[৬] ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় একটি বড় রাজনৈতিক আঘাত চলে আসে আদিবাসীদের মনে। দেশ বিভাগের পর ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটলে পার্বত্য চট্টগ্রাম কোন রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত হবে তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় পতাকা ও বার্মা বা মায়ানমারের পতাকা উত্তোলন করে স্থানীয় জনগণ। কিন্তু ইতঃপূর্বে র্যাডক্লীফ ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্ত করার কথা ঘোষনা করলে ১৯৪৭ সালের ২১ আগস্ট পাকিস্তানের বেলুচ রেজিম্যান্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে। তবে অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হয়েও পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির কারণ হিসেবে দেখা যায় ভারত ও পাকিস্তানের স্বার্থের প্রয়োজন। পাকিস্তান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৪৮ সালে Chittagong Hill Tracts Frontier Police Regulation তুলে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে পাকিস্তান সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক্সক্লুডেড এরিয়া থেকে পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার চেষ্টা করে। অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রাদেশিক ও জাতীয় আইনসভার এখতিয়ারে নিয়ে আসে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় প্রাদেশিক পরিষদে হিন্দু ও বৌদ্ধ আসনের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের জন্য ১ টি এবং হিন্দু(মূলত ত্রিপুরা জাতিসত্তা)দের জন্য ১ টি আসন সংরক্ষণ করা হয়।[৭] নির্বাচনে ২ টি আসনের একটিতে বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা এবং আরেকটিতে কামিনী মোহন দেওয়ান জয়লাভ করে হয়েছেন পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। নামেমাত্র এক্সক্লুডেড এরিয়ার মর্যাদা থাকলেও প্রকৃত অর্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে যায় পাকিস্তানের সরাসরি শাসিত অঞ্চল। এরই মধ্যে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক প্রশাসক ইস্কান্দার মির্জা সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন জারি করে সেনাপ্রধানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। সামরিক আইন জারির বিশ দিন পর ২৭ অক্টোবর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আইয়ুব খান তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন। ইস্কান্দার মির্জা লন্ডনে নির্বাসিত হন। শুরু হয় পাকিস্তানের সামরিক শাসন। তবে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য আদিবাসীদের মনে সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছিল ১৯৬০ সালের দিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। এতে হাজার হাজার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নেয় দীঘিনালা, পানছড়ি, ত্রিপুরা রাজ্য, অরুণাচল, মিজোরামসহ নানান জায়গায়। কর্ণফুলি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রাথমিক পরিকল্পনা এবং এ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত প্রথম সংগ্রহ করা হয় ১৯০৬ সালে। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় দফায় ১৯২৩ সালের দিকে পুনরায় এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার পর ১৯৪৬ সালে কর্ণফুলি নদীর বর্তমান বাঁধস্থল থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার উজানে বরকল এলাকায় বাঁধ নির্মাণের একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ সালে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান Marz Rendal Vatten Consulting Engineers বরকলের আরেকটি স্থান, চিলোক-ধাক (চিলের-ধাক) এলাকায় বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করলেও কিছুদিন কাজ পরিচালনার পর ১৯৫১ সালে অজ্ঞাত কারণে পুনরায় বর্তমান কাপ্তাই এলাকার চিংমরং (চিৎমরং) স্থানে বাঁধ নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে Utah International Inc. নামক আন্তর্জাতিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং তা সম্পন্ন হয় ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় ৫৪,০০০ একর ভূমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে, যা তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় ৪০ শতাংশের সমান ছিল। এর সঙ্গে পুরাতন রাঙ্গামাটি শহরসহ মোট ১২৫টি মৌজার প্রায় ১,৮০০টি পরিবার এবং জনসংখ্যার হিসেবে প্রায় ১ লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি ও জীবনের ভিত্তিভূমি স্থায়ীভাবে পানির নিচে তলিয়ে যায় (চাকমা, ২০১৮)।[৮] ক্ষতিগ্রস্থরা পর্যাপ্ত ন্যায্য ক্ষতিপূরণও পায়নি। এছাড়াও ১৯৬২ সালে পাকিস্থানী সরকার Excluded Area কে Tribal Area করা হয়। ১৯৬২ সালের সংবিধানে ১৯০০ সালের Regulation এর ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয় যা পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের স্বার্থবিরোধী। ফলে ১৯৬৩ সালের জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে ‘ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করা হয়। ১৯৬৪ সালের ১০ই জানুয়ারী Tribal Area বাতিল করা হয় এবং ১৯০০ সালের CHITAGONG HILL TRACTS REGULATION-1900 রহিত করা হয়। তাছাড়া ১৯০০ সালের REGULATION কে লংঘন করে ১৯৫০ সালের দিকে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়াচর, লংগুদু এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইখ্যাংছড়িতে কয়েকশ মুসলিম পরিবারকে পূনর্বাসিত করা হয়। পাকিস্তান সরকারের এই নীতিসমূহ পাহাড়ী জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং দুর্বিসহ করে তোলে। তৎকালীন পাহাড়ী জনগোষ্ঠী নিজেদের প্রতিনিধিদের ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জয়লাভ করান। নির্বাচনে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (স্বতন্ত্র) পি ই- ২৯৯ পার্বত্য চট্টগ্রাম- ১ আসন থেকে এবং অংশৈ প্রু চৌধুরী (স্বতন্ত্র) পি ই- ৩০০ পার্বত্য চট্টগ্রাম- ২ আসনে জয়লাভ করেন। [৯]
পার্বত্য আদিবাসীদের মনে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মনে রাজনৈতিক চিন্তা প্রবেশ করে বিংশ শতকের শুরুর দিকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগঠিত আন্দোলনের সূচনা প্রথমে চাকমা জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের হাতেই ঘটে। ১৯১৫ সালে রাজমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে রাঙামাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘চাকমা যুবক সমিতি’, যা ছিল এ অঞ্চলের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর একটি। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘চাকমা যুবক সংঘ’। এরপর ১৯২০ সালে কামিনী মোহন দেওয়ানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি’, যা আদিবাসী অধিকার ও স্বার্থক্ষার আন্দোলনকে একটি সংগঠিত রূপ দেয়। এই সংগঠনকে আরও কার্যকর ও গতিশীল করার লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে যামিনী রঞ্জন দেওয়ানকে সভাপতি এবং স্নেহকুমার চাকমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও উপমহাদেশ বিভক্তির প্রাক্কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৬ সালে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে কয়েকজন ছাত্রনেতার উদ্যোগে গঠিত হয় ‘স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি’, যার সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্রী অনন্ত বিহারী খীসা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও কিংবদন্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।[১০] এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মনে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে।
পার্বত্য আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বঞ্চনা, ভূমি-সংকট, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, সামাজিক সংহতি এবং অস্তিত্ব রক্ষার গভীর তাগিদ থেকে উৎসারিত একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। নিজেদের জীবন বাজি রেখে তারা মনে প্রাণে চেয়েছিলেন পাকিস্তানীমুক্ত একটি অংশগ্রহণমূলক সুন্দর রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে কয়েকটি কারণ বেশ উল্লেখযোগ্য। সেগুলো হলো- প্রথমত, রাজনৈতিক বঞ্চনা ও প্রতিনিধিত্বহীনতা ছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অন্যতম মৌলিক কারণ। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রক্ষমতায় পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের কার্যকর প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত সীমিত থাকায় প্রশাসন, সামরিক বাহিনী ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের মতামত ও স্বার্থ উপেক্ষিত হয় এবং রাজনৈতিক বৈষম্য ক্রমশ প্রকট আকার ধারণ করে, যা তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিরোধচেতনা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, ভূমি ও অস্তিত্ব সংকট আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধমুখী করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থদের রাষ্ট্র যথাযথ পুনর্বাসন না করায় আদিবাসীদের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব জোরদার হয় এবং মুক্তিযুদ্ধকে তারা নিজেদের হারানো অধিকার পুনরুদ্ধারের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করে। তৃতীয়ত, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন, নির্যাতন ও সহিংসতা আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে ত্ব¡রান্বিত করে। চতুর্থত, বাঙালি জনগণের সঙ্গে সংহতি ও পারস্পরিক সহাবস্থানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পঞ্চমত, স্থানীয় আদিবাসী রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে সংগঠিত ও অর্থবহ করে তোলে। সর্বোপরি, পার্বত্য আদিবাসীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাদের ভূমি, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। নিজেদের ঐতিহ্যগত জীবনব্যবস্থা, সামাজিক স্বাতন্ত্র্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আকাক্সক্ষা থেকেই তারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী
পাহাড়ের আদিবাসীরা কেউ সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছেন, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রসদ যোগাড় করে দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, কেউবা মুক্তিযোদ্ধা গ্যারিলা বাহিনীকে খাওয়া-দাওয়াসহ নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আবার কেউবা ইনফরমার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যুদ্ধে জয়লাভ করার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী মুক্তিবাহিনীর প্রতি যে বহুমাত্রিক সহযোগিতা প্রদান করে, তা স্বাধীনতা সংগ্রামের সামরিক ও কৌশলগত সাফল্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবপ্রথম তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। পাহাড়ি দুর্গম এলাকা, ঘন বনভূমি ও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোকে তাঁরা কার্যত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র ও অস্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেন, যা পাকিস্তানি বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি ও দুর্গম পথঘাট সম্পর্কে তাঁদের গভীর স্থানীয় জ্ঞান মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছাতে সহায়তা করে এবং এ কারণে আদিবাসীরা কার্যকর পথপ্রদর্শক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সীমিত অর্থনৈতিক সামর্থ্য সত্তে¡ও তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা সামগ্রী ও অন্যান্য প্রয়াজনীয় রসদের যোগান নিশ্চিত করেন, যা যুদ্ধকালীন লজিস্টিক ব্যবস্থাকে সচল রাখে। একই সঙ্গে আদিবাসীরা অত্যন্ত ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থায় থেকেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান, চলাচল, ক্যাম্প স্থাপন, অভিযানের সময়সূচি ও কৌশলগত পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তা মুক্তিবাহিনীর কাছে সরবরাহ করেন, যা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পরিকল্পনা ও প্রতিরোধ কৌশল নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, অনেক আদিবাসী যুবক কেবল সহায়তাকারী হিসেবে নয়, বরং সরাসরি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সম্মুখসমরে লড়াই করেন এবং কেউ কেউ আত্মোৎসর্গও করেন। এই আশ্রয়দান, পথপ্রদর্শন, রসদ সরবরাহ, গোয়েন্দা তথ্য প্রদান ও সশস্ত্র অংশগ্রহণ, সব মিলিয়ে পার্বত্য আদিবাসীদের অবদান মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাসে একটি অপরিহার্য, সাহসিকতাপূর্ণ ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ প্রবল উত্তেজনার মধ্যে এক অনিশ্চয়তার ছায়া সারা বাংলাদেশ জুড়ে। অতঃপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বাংলার সাধারণ নীরিহ মানুষের উপর আক্রমণ পরিণত হয় নৃসংশ এক গনহত্যায়। ২৫ মার্চের পর মুক্তিকামী পার্বত্য মুক্তিযোদ্ধাদেরও বুঝতে বাকী নেই যে, এবার পাকিস্তানী শত্রুদের হাত থেকে এই পাহাড় তথা দেশকে রক্ষা করতে হলে যুদ্ধের কোন বিকল্প নেই। তাঁই সংঘটিত হয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে। তখন এই পাহাড়ে একটি জেলাই ছিল, নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। এই সরকারের অধীনে সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পুরো দেশকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছিল ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। আর উক্ত সেক্টরের প্রথম দিককার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান (১০ এপ্রিল -২৫ জুন, ১৯৭১)। যদিও পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন রফিকুল ইসলাম (২৮ জুন-৬ এপ্রিল, ১৯৭২)। ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল ঋষিমুখ, শ্রীনগর, মনুঘাট, তবলছড়ি ও ডিমাগিরি নামক ৫ টি সাব-সেক্টর। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ছিলেন হোসেন তওফিক ইমাম, যিনি এইচ. টি ইমাম নামেই সমাধিক পরিচিত। এই জেলার অধীনে ‘রাঙ্গামাটি’, ‘রামগড়’ ও ‘বান্দরবান’ নামে তিনটি মহকুমা ছিল। এই তিনটি মহকুমাতেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। তবে প্রথমদিকে মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় রাঙ্গামাটি ও রামগড় সদরে। রাঙ্গামাটিতে গৌতম দেওয়ান ও সুনীল কান্তি দে -এর নেতৃত্বে গঠিত হলো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২৫ মার্চের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, রামগড়সহ বেশ কিছু এলাকায় ডিফেন্স লাইনে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে পাঠানোর কাজে আদিবাসী ছাত্র যুবকেরা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পার্বত্য এলাকায় গ্যারিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল।[১১] এইচ.টি ইমাম তাঁর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ নামক প্রবন্ধে রাঙ্গামাটির প্রথম মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচের নামগুলো লিখেছিলেন। প্রবন্ধে তিনি যে নামগুলো উল্লেখ করেছিলেন- ইফতেখার, আবদুস শুকুর, মোহাম্মদ শফি, মামুন, এস.এম. কামাল, মাহবুবুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ, সুনীল, দিদারুল আলম, রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, প্রভূদান চৌধুরী(মার্মা), গৌতম দেওয়ান, মোহাম্মদ ইয়াছিন, অনিল চন্দ্র দাস, কানু বিশ্বাস, বাবুল বিশ্বাস, আলমগীর, জাহাঙ্গীর।[১২] অর্থাৎ রাঙ্গামাটিতে মুক্তিযুদ্ধাদের প্রথম ব্যাচে কয়েকজনের মধ্যে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, প্রভূদান চৌধুরী ও গৌতম দেওয়ান। গৌতম দেওয়ান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে পার্বত্য জেলার মানুষদের আন্দোলনে উদ্বোদ্ধ করার জন্য প্রতিদিনই রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার, বনরূপা, তবলছড়িতে ৩-৪ টি করে মিটিং করতেন। তাঁর সাথে প্রায়ই সাক্ষাৎ হতো তৎকালীন জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম ও এসডিও এম আবদুল আলীর সাথে। ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানীরা দেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা করেছিল তখন রাঙ্গামাটির ছাত্র, যুবকদের সুসংগঠিত করে গৌতম দেওয়ান ঘাগড়া ডাক বাংলোর পাশে জঙ্গলে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পাহারা দিয়েছিলেন।[১৩] মূলত ২৫ মার্চের আগেই রাঙ্গামাটি মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর অবাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে ক্লোজ করে নিয়ে আসেন। সাথে বাঙালি প্রস্তুত রাখা হয় যে-নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথেই যেনো সকলেই রাঙামাটি শহরে চলে আসে এবং অবাঙালি সদস্যদের গ্রেফতার করে।[১৪] ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহের দিকে বান্দরবানে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য হলো পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত সৈনিকদেরকে খাদ্য এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা। আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুবুর রহমান, মোখলেছুর রহমান, মংস মিয়ান্ট (জনি বাবু), শফিকুর রহমান, ছাত্র নেতা আব্দুল ওয়াহাব, ক্যশৈপ্রু (খোকা), উচপ্রু, উচনু, প্রীতি কান্তি ত্রিপুরা এবং আরো অনেকে এই সংগ্রাম পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলেন। [১৫]
অন্যদিকে রামগড়ে ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ কাজী রুহুল আমিনকে আহবায়ক ও সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরাকে যুগ্ম আহবায়ক করে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কর্মকান্ড এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ২৯ মার্চ রামগড় হয়ে আগরতলায় গমন করেন চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং এম আর সিদ্দিকী । ১ এপ্রিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ২ ট্রাক গোলাবারুদ রামগড়ে প্রেরণ করা হয়। সেগুলো গ্রহণ করেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন হারুন। ২ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম রামগড়ে চলে যান। ১৯৭১ সালে রামগড়কে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বাংলাদেশি ভারতের উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং আশ্রয়ের জন্য ভারতে গমন করেন। রামগড় পতনের পূর্বে বহু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বিশিষ্ট নাগরিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সামরিক কর্মকর্তারা রামগড়ে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকেই ভারতে পাড়ি জমান। এই সময়ে তাঁদেরকে সীমানা অতিক্রম, সাময়িক আশ্রয় প্রদান, খাবার সরবরাহসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করেছিলেন স্থানীয় আদিবাসীরা ও আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা। তৎকালীন রামগড় হয়ে ভারতে গমনকারী সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী), মেজর শামছুদ্দিন, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন এজাজ, ক্যাপ্টেন এনামুল হক, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন শামছু, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন ওয়ালী, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া, ক্যাপ্টেন মতিন এবং তৎকালীন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, পরবর্তীকালে বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সুলতান মাহমুদ প্রমুখ। এ সময় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল ঘোষ, মেজর প্রধান, ক্যাপ্টেন ঘোষ, সাব্রুম পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্রী মুখার্জী এবং ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক শ্রী অনিল ভট্টাচার্য রামগড়ে আগমন করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এম. এ. ওহাব, এম. এ. মান্নান, এম. এ. হান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, মির্জা আবুল মনসুর, মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক খালেদ, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, সাংবাদিক শিশির দত্ত, চিত্রশিল্পী কবরী, বাদশাহ আলম, শিল্পপতি এ. কে. খান, এ. আর. মল্লিক, সৈয়দ আলী আহসান, সাইদুর রহমান চৌধুরী, এম. আর. সিদ্দিকী, ফজলুল হক বিএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুমানিক ১৫-১৬ জন নাম-অজ্ঞাত অধ্যাপক ও অধ্যাপিকা প্রমুখ।[১৬] চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানীদের দখলে চলে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশনের ১০ কিলোওয়াট বেতার যন্ত্রটি রামগড়ে নিয়ে রামগড় থেকে ৩-৫ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়। জিয়াউর রহমান রামগড়ে গমন করেন ৪ এপ্রিল। রামগড় পাকিস্তানীদের দখলে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রামগড়ে অবস্থান করে মুক্তিযদ্ধ পরিচালনা করেন। সেখানে ছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধ এবং একটি ট্রেইনিং সেন্টারও। বীর উত্তম শহীদ আবতাবুল কাদেরও ৮ এপ্রিল রামগড়ে চলে যান। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল রাঙ্গামাটি জেলা সদর দখল করে ফেলে পাকবাহিনী। মুক্তি বাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা বাহিনী মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করলে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর এলাকার বুড়িঘাটে ২০ এপ্রিল বীরদর্পে যুদ্ধ করে শহীদ হন বীর শ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ। উল্লেখ্য, ১৯ এপ্রিল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে সেনা, ইপিআর, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০ জনের একটি দল নানিয়ারচর বাজারে পৌঁছালে সেখানে স্থানীয় চেয়ারম্যান তিলক চাকমা সকলকে রাতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।[১৭] মহালছড়িতে মীর শওকতের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীরা প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তোলেন এবং পাকবাহিনীর সাথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে গুলিবিদ্ধ হন বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত আব তাবুল কাদের। অতঃপর ২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি এবং সর্বশেষ রামগড় মহকুমার হেডকোয়ার্টার পাকিস্তানীদের দখলে যায় ২ মে বিকেল ৪ টায়। রামগড়ের পতনের পর পাকবাহিনীরা জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় আদিবাসী জনগণ। রামগড়ের বহু আদিবাসী গ্রাম পাকিস্তানীরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়। রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবান সদর এলাকা দখল করে পাকবাহিনীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং বিভিন্ন এলাকায় শান্তি কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অরাজকতা সৃষ্টি করে। বহু আদিবাসী গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, হত্যাযজ্ঞ চালায়, লুটপাত চালায়, আদিবাসী নারীদের অমানবিক অত্যচার ও ধর্ষণ করে।
১ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত পার্বত্য অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধগুলোর মধ্যে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি-ডাইনছড়ি (চেম্প্রুপাড়া) এলাকায় সংঘটিত অভিযান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ডাইনছড়ি চেম্প্রুপাড়া এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সফল গেরিলা আক্রমণ পরিচালিত হয়, যেখানে শত্রুপক্ষের একজন ক্যাপ্টেনসহ মোট ১২ জন সেনা নিহত হয়। পরবর্তীতে একই বছরের ৭ অক্টোবর যোগ্যছলা এলাকায় তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আরেকটি গেরিলা অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্তত ৯ জন সেনা আহত হয়। এছাড়া ১৯৭১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে রামগড়ের মহামুনি এলাকায় পরিচালিত এক সফল গেরিলা অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন কর্নেলসহ মোট ১৭ জন সেনা নিহত হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৬ ও ৭ ডিসেম্বর রামগড়ে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর বিমান হামলা পরিচালিত হয়। প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী রামগড় সদর দপ্তর ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ৮ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। রামগড় মুক্তাঞ্চলে পরিণত হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে রামগড় ও ভারতের সাব্রæম মহকুমার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ফেনী নদীর ওপর একটি অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে ভারতীয় মিত্র বাহিনী দিনরাত সাঁজোয়া যানসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রামগড়-কেরানিহাট সড়ক ব্যবহার করে বিভিন্ন মুখে যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। সর্বশেষে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর রাঙ্গামাটি ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। [১৮]
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর বিক্রম উপাধি লাভ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুরু হলেই পাহাড়ের মানুষ যাঁকে নিয়ে খুব গর্ব করেন, তিনি হলেন বীর বিক্রম ইউ কে চিং। তাঁর ‘যুদ্ধের ডাক শোনার অপেক্ষায়’ নামক লেখায় তিনি লিখেছিলেন- “পাহাড়ি মানুষ হিসেবে মুক্তির আকাক্সক্ষা তো জন্ম থেকেই। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সুযোগটা যখন এল, আমাকে থামায় কে? দুরন্ত গতি আসে মনে। সেই যে ঝাঁপিয়ে পড়া, শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি নিরন্তর যুদ্ধ করা। কখন ১৬ ডিসেম্বর এল টেরও পাইনি। তখনও হাতে ধরা লাইটমেশিনগান গর্জে উঠার অপেক্ষায়। যখন শুনলাম দেশটা স্বাধীন হয়ে গেছে, ভাবলাম আমাদের যুদ্ধও কি শেষ? আনন্দের পরিবর্তে কেমন জানি খালি খালি লাগছে। আহ্ আরো কয়টা দিন যদি পেতাম।”[১৯] ইউ কে চিং ১৯৫২ সালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে তিনি ইপিআরের নায়েক পদে কর্মরত অবস্থায় রংপুর জেলার হাতীবান্ধা বিওপিতে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তিনি এক বিহারী ও দুই পাঞ্জাবি সদস্যকে হত্যা করে নয়জন বাঙালি ইপিআর সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে তিনি অসামান্য সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন এবং দেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে। [২০]
মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী আরেকজন ছিলেন মান সার্কেল চীফ মংরাজা মং প্রæ সাইন চৌধুরী। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণে পার্বত্য অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভূমিহীন ও উদ্বাস্তু হয়ে পড়লেও পাকিস্তান সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হলে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেল চিফদের ক্ষমতাও পরিকল্পিতভাবে খর্ব করা হলে রাজা মং প্রæ সাইনের মধ্যে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ জন্ম নেয়। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল চট্টগ্রাম পতনের পর পাকবাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের ফলে অসংখ্য মানুষ মানিকছড়ি হয়ে রামগড় পথে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করলে এই শরণার্থীর স্রোতের মুখে মং রাজবাড়ি এক বিশাল আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়। রাজা মং প্রু সাইন ও রানী নিহার দেবী আশ্রয়প্রার্থীদের আহার, আশ্রয় ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করেন। রাজবাড়িতে স্থাপন করা হয় শরণার্থী চিকিৎসাকেন্দ্র, যেখানে রানী নিজ হাতে অসুস্থ ও গর্ভবতী নারীদের সেবা এবং প্রসবে সহায়তা প্রদান করতেন। শরণার্থীদের সহায়তার পাশাপাশি রাজা মং প্রু সাইন নিজ জেলা রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তিনি নিজের অস্ত্রভান্ডার থেকে ৩৩টি আগ্নেয়াস্ত্র মুক্তিবাহিনীকে প্রদান করেন এবং ব্যক্তিগত যানবাহন যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করতে দেন। ১৯৭১ সালের ১ মে পাকবাহিনীর আগ্রাসনের মুখে তিনি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে ত্রিপুরার রূপাইছড়িতে আশ্রয় নিয়ে হরিণা ক্যাম্পের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ, রিক্রটমেন্ট ও গেরিলা অভিযানে সহায়তা করেন। মং রাজার অনুপস্থিতিতে পাকবাহিনী মানিকছড়ির রাজবাড়ি দখল করে ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করে এবং রাজভান্ডারের বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে নেয়। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর ভূমিকা প্রচারিত হলে তিনি বিশ্বজনমত গঠনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল কণ্ঠে পরিণত হন। এ কারণে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ঘোষণা করে এবং হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার প্রেক্ষিতে তাঁকে আগরতলায় নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। নভেম্বর মাসে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে তিনি মিত্রবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সাহসিকতা ও নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মিত্রবাহিনী তাঁকে অনারারি কর্নেল পদে ভূষিত করে। আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ ও ভৈরব অভিযানে তিনি সরাসরি অংশ নেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি বিজয়ী বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন।[২১] মং রাজা মং প্রু সাইন-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে লেখক ও কবি অংসুই মারমা তাঁর ‘এক ভাগ্য বিড়ম্বিত রাজার নাম: মংপ্রুসেইন’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন- “আমাদের মহান স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে রাজা মং প্রু সেইনের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ভারতের রূপাইছড়ি ও হরিণাক্যাম্পে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎকার প্রদান করে বিশ্বের বিবেকবান মানুষের সাহায্যের আবেদন জানান।”[২২]
মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের ভূমিকাও উল্লেখ করার মত। বিশেষ করে প্রাক্তন সাংসদ সুদীপ্তা দেওয়ান, রাঙ্গামাটি সমাজকল্যাণ অফিসের প্রাক্তন কর্মকর্তা আরতি চাকমা, বিশিষ্ট সমাজসেবক মিসেস মঞ্জুলিকা খীসা, রাঙ্গামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিসেস অঞ্জলিকা খীসা এবং রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের শিক্ষিকা ড. আলো রাণী আইচ। এ মহিলারা রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন জায়গা, বিভিন্ন সংস্থা, জনসাধারণের কাছ থেকে, অর্থ, খাদ্য সামগ্রী, বস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধা, ই,পি, আর এবং শরণার্থীদের কাছে বিতরণ করেছেন। এভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। লাল সবুজের পতাকা ও বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অর্জনের পেছনে মূল ধারার বাঙালি বীর সন্তানদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী নারী-পুরুষ সাহসী যোদ্ধাদেরও ছিল অনন্য অবদান। পাহাড় পর্বতসংকুল ছড়া ঝরনা উপত্যকা বেষ্টিত চিরচেনা পাহাড়ি জনপদে আগন্তুক হানাদার শত্রæবাহিনীকে পরাজিত করার জন্যে আদিবাসী মুক্তিসেনারা নিজস্ব ঢঙে রণনীতি রণকৌশল রচনা করে সহসা পরাজিত করতেন শত্রুসেনাদের। তাই বাংলার লাল-সবুজের পাতাকার মাঝে আকার বা পরিমাণে ক্ষুদ্রতম হলেও মিশে রয়েছে আদিবাসী মুক্তিসেনাদের বুকের রক্ত। তবুও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুসন্ধানমূলক খোঁড়াখুঁড়িতে কেমন করে যেন আদিবাসীদের অবদান, রক্ত, ত্যাগ, বিজয়ের কাহিনি অনুল্লেখিতই থেকে যায়। স্বীকৃতি মিলছে না আজও বহু আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার। [২৩] তারপরও যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁদের মনোবল আজও সুদৃঢ়। ভরাট কন্ঠে ভেসে আসে গৌরবময় দিনগুলোর স্মৃতিচারণের স্বর।
স্বাধীনতাত্তোর আদিবাসীদের স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি কথা
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও এই আদিবাসী জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রকৃত অর্থে মেলেনি। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময় ক্ষমতার মসনদে বসলেও পার্বত্য অঞ্চলের এই আদিবাসীদের প্রতি সরকারি নীতি প্রায় একই রয়ে গেছে। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশীদার হওয়া সত্তে¡ও রয়ে যায় বাতির নিচে অন্ধকার। ঈশানী চক্রবর্তী ও জোবাইদা নাসরীন ‘ইতিহাস নির্মাণের সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন- “একদিকে ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বিভিন্ন জাতিসত্তাকে স্থান দিতে যেভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী ইতিহাস নির্মাণও একইভাবে উপেক্ষা করেছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের অবদান এবং অংশগ্রহণকে। উভয় ইতিহাসেই প্রবল শ্রেণীর প্রাধান্য লক্ষণীয়। ব্রিটিশ বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল সেই জাতীয়তাবাদের পরিসরে নির্মিত ইতিহাস বিভিন্ন জাতিসত্তার ঐতিহাসিক ও জাতীয়তাকে অস্বীকার করছে। সব সময় তাদের অবস্থান ছিল নিকৃষ্ট ‘অন্যে’র (Least otherness) ভূমিকায়। ১৯৭১ সালের পরও এই জাতীয়তাবাদী ইতিহাস নির্মাণের এই সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। [২৪]
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে যে পার্বত্য আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের নামগুলো বেশ উল্লেখযোগ্য সেগুলো হলো- ইউ কে, চিং (বীর বিক্রম) (ইপিআর), হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা, মং প্রু সাইন, রনবিক্রম ত্রিপুরা, নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, প্রিয় জ্যোতি রোয়াজা, মংথা মারমা, রবি রশ্মি চাকমা, রুইপ্রু মারমা, কংজরী মগ, মংলাপ্রু মারমা, সুইমং মার্মা, উক্যজেন, মংমং মারমা, কংগ্য দেওয়ান, ম্রাসাথোয়াই মারমা, ভূপেন ত্রিপুরা, সাথোয়াই মারমা, ফিলিপ বিজয় ত্রিপুরা, মংসাথোয়াই মগ, সাথোয়াইপ্রু মগ, মংশোয়েঅং মগ, লোকনাথ ত্রিপুরা, পূর্ণ কুমার ত্রিপুরা, মনিন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা, বিন্দু কুমার ত্রিপুরা, নীলোৎপল ত্রিপুরা, কংচাই মারমা, থোয়াইঅং মগ, মংমংচিং মগ, নারাসু মারমা, আথুইঅং মগ, চোহ্লাপ্রু চৌধুরী, সুবিলাস চাকমা, রমনী রঞ্জন চাকমা, জয়কুমার ত্রিপুরা, সুরেশ ত্রিপুরা, রূপেন্দ্র ত্রিপুরা, হরেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা, চেংঞরী মারমা, সাথোয়াইপ্রু মগ, অংকিউ মগ, হৃদয় কুমার ত্রিপুরা, কালাচাঁন দেব বর্মন ত্রিপুরা, মংআফ্রুসি মগ, ভাগ্যধন ত্রিপুরা, রনজিত দেব বর্মন, নীল মোহন ত্রিপুরা, লাল মোহন ত্রিপুরা, বেনুরায় ত্রিপুরা, মংনেওহাঅং (এমএন অং মং), ভূবন মোহন ত্রিপুরা, কংক্য মগ, উথাই মগ, পথোয়াই মারমা, নাইগ্য মারমা, মংমেৎ মারমা, মংজচাই মারমা, মংরুইবাই মারমা, চাইলাপ্রু মারমা, লাব্রে মগ, ধুমপরী মগ, গগন চন্দ্র ত্রিপুরা, মংসাথোয়াই চৌধুরী, নির্পদ ত্রিপুরা, রামেচ মার্মা, মং মার্মা, মংপাই মগ, কর্ণ মোহন ত্রিপুরা, মংসুইসা মার্মা, মংসালা মারমা, মংহ্লাপ্রু মগ, কংজ অং মগ, কংজসাই মারমা, মংহলাপ্রু মারমা, দোঅংগ্য মারমা, অংসাথোয়াই মারমা, থোয়াইঅংরী মার্মা, আদুং মগ, সুই হ্লা প্রু মগ, রিপ্রু মগ, ধর্ম চরণ চাকমা, ভূপেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, অন্ন কুমার ত্রিপুরা (বিএলএফ), মোহন ত্রিপুরা, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, কাহরি মগ, অর্চন ত্রিপরা, পূর্ণ মোহন ত্রিপুরা, যতিন্দ্র ত্রিপুরা, ম্রাসাথোয়াই মগ, Swenhchndra, মংহ্লাপ্রু চৌধুরী, কর্ণ মোহন ত্রিপুরা, ধুংচাই মার্মা, মং শৈই প্রু মার্মা, সানু অং, লাম পুম বম, শাকিয়াংআং, কালু বাহাদুর, অরুণ রায় ছেত্রী, অংগত কুমার ছেত্রী, ইত্যাদি। রাঙ্গামাটিতে শহীদ হয়েছেন- চিরঞ্জীব চাকমা, লাল বাহাদুর ছেত্রী, খগেন্দ্র লাল চাকমা, শান্তি বাহাদুর রায় ইত্যাদি। উপরোক্ত নামগুলো ছাড়াও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাদেও নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা নিজের সবটুকু দিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশের সমগ্র মানুষ যখন স্বাধীনতার সুমহান চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষও আন্দোলনে শরীক হয়। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা থেকেই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তাঁরা। কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় যখন বারংবার অস্বীকৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ হতে হয় এই অঞ্চলের আদিবাসীর মুক্তিযোদ্ধাদের তখন বরাবরই প্রশ্ন থেকে যায় একটি বহু সংস্কৃতির বাংলাদেশ, বহু ভাষার বাংলাদেশ, বহু জাতির বাংলাদেশ ও বহু ধর্মের বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ আরো কতটুকু দীর্ঘ। তবুও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই সেইসব আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের যাঁরা সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দেশ-মাতৃকার মর্যাদা রক্ষায় নিজেদের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, সেই বীর যোদ্ধাদের। তাঁরা চির অমর হয়ে থাকুক আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়।
লেখক পরিচিতি:
মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
শিক্ষক, লেখক ও গবেষক।
তথ্যসহায়িকা:
[১] ISHAQ, MUHAMMAD (Edi.), Bangladesh District Gazetteers: CHITTAGONG HILL TRACTS, Officer on Special Duty, Establishment Division, Incharge, Bangladesh Govemment Press, Dacca, 1971, Published on 1975.[২] ত্রিপুরা, প্রভাংশু, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ইতিহাস, প্রকাশকাল: এপ্রিল ২০০৬।
[৩] পাম্পু, এডভোকেট প্রতীম রায়, পার্বত্য আইন: তত্ত্বে ও প্রয়োগে, প্রকাশক: এ. কে. এম. মকছুদ আহমেদ, রাঙ্গামাটি প্রকাশনী, রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি, এপ্রিল, ২০০১ ইং।
[৪] ত্রিপুরা, পানতুই, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমচাষ ও একটি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, জুম (কিংশুক চাকমা সম্পাদিত), জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি, ঢাকা বিশ্বেবিদ্যালয়, পৃষ্ঠা: ২২।
[৫] চাকমা, শরদিন্দু শেখর, চাকমা জাতির ইতিহাস, প্রকাশক: মোহাম্মদ সোলাইমান হোসেন, অনুভূতি প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ: জুন ২০১৬, পৃষ্ঠা: ৫৩।
[৬] চাকমা, আনন্দ বিকাশ, কার্পাস মহল থেকে শান্তিচুক্তি: পার্বত্য চট্টগ্রামের রাষ্ট্রীয় নীতির ইতিহাস, প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, তেজগাঁও, ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ: জুলাই ২০২৩, পৃষ্ঠা: ১৬১।
[৭] চাকমা, আনন্দ বিকাশ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ২০০।
[৮] চাকমা, সমারী, কাপ্তাই বাঁধ: বর-পরং ডুবুরীদের আত্মকথন, প্রকাশক: কমরেড রূপক চাকমা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, নারানখাইয়া, খাগড়াছড়ি, ফেব্রæয়ারি, ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১১।
[৯] ত্রিপুরা, পানতুই, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ২২।
[১০] ত্রিপুরা, খগেশ্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা জাতি, ককক্রিয়েটিভিটিস, খাগড়াপুর, খাগড়াছড়ি সদর, ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, পৃষ্ঠা: ১৭।
[১১] ত্রিপুরা, হেমদা রঞ্জন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম, Ho-Machang (মিলন জ্যোতি ত্রিপুরা সম্পাদিত), Tripura Students’ Forum Bangladesh, Dhaka Metropolitan Branch, 26 March, 1999, পৃষ্ঠা: ১৩।
[১২] ইমাম, এইচ.টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম: মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস, পার্বত্য চট্টগ্রাম: বন পাহাড়ের সাত সতের (নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত), পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সেপ্টেম্বর, ২০১৪ , পৃষ্ঠা: ১০-১১।
[১৩] সোহেল, ইয়াছিন রানা, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় বীর (মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত) শহীদ এম আবদুল আলী, মুদ্রণে: কার্পাসমহল, ২৭ এপ্রিল ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা: ৩৯।
[১৪] সোহেল, ইয়াছিন রানা, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় বীর (মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত) শহীদ এম আবদুল আলী, মুদ্রণে: কার্পাসমহল, ২৭ এপ্রিল ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা: ৩৯।
[১৫] ত্রিপুরা, প্রীতি কান্তি, মুক্তিযুদ্ধে বান্দরবান, Emang (Editor- Nipon Tripura), Tripura Students’ Forum Bangladesh, Central Committee, 30 December, 2017,, পৃষ্ঠা: ১৫।
[১৬] ত্রিপুরা, হেমদা রঞ্জন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ১৫।
[১৭] সোহেল, ইয়াছিন রানা, হ্রদ-পাহাড়ের বুকে চিরশায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ, ২০ এপ্রিল, ২০১৭ খ্রি. (প্রথম প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০১৬ খ্রি.)
[১৮] ত্রিপুরা, হেমদা রঞ্জন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিপুরা, ওয়াকরাই (পুষ্পায়ন ত্রিপুরা সুনেন্দু সম্পাদিত), ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটি, ৮ তালহিং ১৪১৩ ত্রিপুরাব্দ, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০০২ খ্রি. , পৃষ্ঠা: ২৭।
[১৯] ইউ কে চিং, বীর বিক্রম, যুদ্ধের ডাক শোনার অপেক্ষায়, মো লাং নীং, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর শাখা।
[২০] চৌধুরী, চিংলামং, মহান মুক্তিযুদ্ধে মান রাজা বা মং প্রু সাইন চৌধুরী এর অবদান, অক্ষর (প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত), খড়িমাটি, এপ্রিল ২০১৮, পৃষ্ঠা: ৫৬-৬০।
[২১] ইসলাম, মনু, বান্দরবানে মুক্তিযুদ্ধ, অক্ষর (প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত), খড়িমাটি, পৃষ্ঠা: ৬১-৬৬, এপ্রিল ২০১৮।
[২২] মারমা, অংসুই, এক ভাগ্য বিড়ম্বিত রাজার নাম: মংপ্রুসেইন, অক্ষর (প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত), খড়িমাটি, এপ্রিল ২০১৮, পৃষ্ঠা: ৮৬।
[২৩] ত্রিপুরা, মথুরা বিকাশ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী, অক্ষর,(প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত), এপ্রিল, ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১১৩।
[২৪] চক্রবর্তী, ঈশানী ও নাসরীন, জোবাইদা, ইতিহাস নির্মাণের সংস্কৃতি, বিপন্ন ভূমিজ: অস্তিত্বের সংকটে আদিবাসী সমাজ: বাংলাদেশ ও পূর্ব-ভারতের প্রতিচিত্র (মেজবাহ কামাল ও আরিফাতুল কিবরিয়া সম্পাদিত), প্রকাশক: সৈয়দ জাকির হোসাইন, অ্যাডার্ন পাবলিকেশন, দ্বিতীয় মুদ্রণ: এপ্রিল, ২০১৭, প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল, ২০০৩, পৃষ্ঠা: ৭২।
[২৫] রহমান, হাসান হাফিজুর (সম্পা), বাংলাদেশের স্বাদীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খন্ড, প্রকাশক: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তথ্য মন্ত্রণালয়-এর পক্ষে- গোলাম মোস্তফা, হাক্কানী পাবলিশার্স, ধানমন্ডি, ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ: নভেম্বর ২০১১, অগ্রহায়ণ, ১৪১৮, প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর, ১৯৮২।
[২৬] চাকমা, মৃত্তিকা, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস: রাঙ্গামাটি জেলা (আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত), প্রকাশক: এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি, তাম্রলিপি, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
[২৭] খীসা, আলোড়ন, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস: খাগড়াছড়ি জেলা (আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত), প্রকাশক: এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি, তাম্রলিপি, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
[২৮] অংশৈসিং, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস: বান্দরবান জেলা (আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত), প্রকাশক: এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি, তাম্রলিপি, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
[২৯] ত্রিপুরা, প্রশান্ত, ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ: এক নৃবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর চোখে দেখা স্বদেশের ছবি, প্রকাশক: পারভেজ হোসেন, সংবেদ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০।
[৩০] ত্রিপুরা, প্রশান্ত, বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস, প্রকাশক: পারভেজ হোসেন, ফকিরেরপুল, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫।
[৩১] হোসেন, আইয়ুব, মুক্তিযুদ্ধে নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
[৩২] হোসেন আইয়ুব ও হক, চারু, মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী, ঐতিহ্য, ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।


