মধুপুরে আদিবাসীদের কৃষি জমিতে জোরপূর্বক লেক খনন প্রকল্পের প্রতিবাদে সংবাদ সন্মেলন
আজ ১০ই মার্চ, ২০২২ সকাল ১১.০০ ঘটিকায় টাংগাইলের মধুপুরে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের কৃষি জমিতে বনবিভাগ কর্তৃক জোরপূর্বক লেক খনন ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে আদিবাসী ছাত্র-যুব সংগঠনসমূহের উদ্যোগে ঢাকার সেগুনবাগিচায় রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ’র সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক বুশ নকরেক, গারো স্টুডেন্টস ফেডারেশন ঢাকা মহানগর এর সাংগঠনিক সম্পাদক লেবিয় ম্রং, বাংলাদেশ কোচ আদিবাসী ইউনিয়নের চন্দন কোচ, গারো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ঢাকা মহানগরের সভাপতি সতীর্থ চিরান, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শোভন রহমান, হাজং স্টুডেন্টস কাউন্সিল ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক হরিদাস হাজংসহ বিভিন্ন ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রমূখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি চিরান। তিনি তাঁর লিখিত বক্তেব্যে বলেন, টাংগাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে ২৫ হাজারের অধিক গারো, কোচ ও বর্মণ আদিবাসী সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করে আসছে। তারা সেখানে পরম মমতায় বন ও জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করে আসছে। একারণে আদিবাসীরা এই প্রাকৃতিক বনভূমির ঐতিহাসিক সংরক্ষক ও ব্যবস্থাপক। আদিবাসীরা পুরো পৃথিবী জুড়ে বন রক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮০ শতাংশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু উপনিবেশ আমলে গড়ে উঠা বনবিভাগ বন রক্ষার নামে বিভিন্ন সময় বন ও পরিবেশ ধ্বংসকারী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে এই প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় বনবিভাগ উডলট/সামাজিক বাগান কিংবা রাবার বাগানের নামে হাজার হাজার একর প্রাকৃতিক শালবন উজাড় করে পরিবেশ আগ্রাসী বিদেশি গাছ যেমন- রাবার, একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম গাছ রোপন করেছে। তাছাড়াও ইকোপার্ক, ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের নামে বনের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা, জাতীয় উদ্যান, পিকনিক স্পট কিংবা ফায়ারিং ও বম্বিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করে দেশের অন্যতম পাতা ঝড়া প্রাকৃতিক বনের সর্বনাশ করেছে।
উন্নয়নের নামে মধুপুর গড় থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের যে ষড়যন্ত্র চলছে তা ঊনিশ শতক থেকেই চলে আসছে। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমির মালিকানাকে অস্বীকার করে ১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দে “পূর্ব পাকিস্তান প্রাইভেট ফরেস্ট অ্যাক্ট” ও ” Acquisition and Tenancy Act (1950) এর মাধ্যমে মধুপুরের আদিবাসী অধ্যুষিত বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রায় ২০৮২৭.৩৭ একর আদিবাসী অধ্যুষিত বিশাল এলাকাকে ”জাতীয় উদ্যান” ঘোষণা ও তারের বেড়া দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বনবিভাগ গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে আদিবাসীদের উদ্দেশ্যে দাপুটে উচ্ছেদ নোটিশ প্রদান করা হয়। ২০০০ সালে বনবিভাগ ৩ হাজার একর ‘কোর এরিয়াতে’ ৬১ হাজার রানিং ফুট দেয়াল তুলে ইকোপার্ক প্রকল্প হাতে নেয় এবং ইকোপার্কের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সেই আন্দোলনে বনবিভাগ ও পুলিশের গুলিতে শহীদ হন পিরেন স্নাল ও গুরতর আহত হয়ে চিরপঙ্গু অবস্থায় আজো বেঁচে আছেন উৎপল নকরেক। অন্যদিকে আদিবাসীদের নামে শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ বনরক্ষার নামে বিভিন্ন সময় বনবিভাগ ৭জন আদিবাসীকে গুলি করে হত্যা করেছে। বনবিভাগের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায়, ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে বনবিভাগ ১৯২৭ সালের বন আইনের ২০ ধারায় চূড়ান্ত গেজেট জারি করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার ৯,১৪৫.০৭ একর ভূমি রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করেছে যেখানে রয়েছে ১৪টি আদিবাসী গ্রাম, বসতবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কোন ধরনের আলোচনা না করেই সরকার জোরপূর্বকভাবে এই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। মধুপুরের গারো-কোচ-বর্মন ও সাধারণ জনগণ এই সংরক্ষিত বন ঘোষণার বিরুদ্ধে জোড়ালো ভাবে প্রতিবাদসহ মহামান্য হাইকোর্টে আপিল করলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কার্যত কোন উদ্যোগ গ্রহন করেনি বরং স্থানীয় আদিবাসী জনগণ উদ্বেগ, আতংক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছে।
সম্প্রতি বনবিভাগ বিশ্বব্যাংক এর সহযোগিতায় ( Sustainable Forest and Livelihood) SUFAL -সুফল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাছাড়া “মধুপুর জাতীয় উদ্যানের ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা” বনবিভাগ আদিবাসীদের ভূমিতে সীমানাপ্রাচীরসহ আরবোরেটাম বাগান, দ্বিতলবিশিষ্ট গেস্ট হাউজ, ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণসহ নানান স্থাপনা বাস্তবায়ন করছে। টাঙ্গাইল জেলাধীন মধুপুর উপজেলার আদিবাসী অধ্যুষিত চুনিয়া, পেগামারি, পীরগাছা, সাইনামারী,ভূটিয়া, থানারবাইদ গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে ১১ নং শোলাকুড়ি ইউনিয়নের পীরগাছা মৌজার আমতলী নামক বাইদে (নিচু জমিতে) দেশি-বিদেশি পর্যটকদের চিত্ত-বিনোদনের উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের তিন ফসলী আবাদি জমিতে বনবিভাগ কর্তৃক জোরপূর্বক কৃত্রিম লেক খনন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে আদিবাসীদের জীবন জীবিকার উপর মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে ও ব্যাহত হবে আদিবাসীদের কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতি। এছাড়াও উলেখিত প্রস্তাবিত লেক এর পাশে বসবাসকারী আদিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাবসহ মধুপুর বনের অবশিষ্ট প্রাকৃতিক বন ও পরিবেশের উপর স্থায়ীভাবে প্রভাব পড়বে বলে আমরা মনে করছি। বন বিভাগের এহেন আত্মঘাতী পরিকল্পনার কারণে একদিকে যেমন বন ও পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ হবে ১২টি আদিবাসী কৃষক পরিবারের প্রায় ১২ একর (আরওআর রেকর্ডভূক্ত) স্বত্ব দখলীয় কৃষি জমি। আর সামান্য এই কৃষি জমির উপরেই আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল।
রাষ্ট্র কর্তৃক মধুপুর গড়ে চিরতরে জুম চাষ বন্ধ করে প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদিবাসীদের জুম চাষ থেকে লাঙল চাষে বাধ্য করা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ আদিবাসীর জীবন-জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই আদিবাসীদের কৃষি জমিতে বিনোদনের উদ্দেশ্যে লেক খনন ও আদিবাসীদের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র বন্ধের জোড়ালো দাবি জানানো হয়।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে নিম্নলিখিত দাবিসমূহ পেশ করা হয়:
১। প্রস্তাবিত আদিবাসীদের কৃষি জমিতে লেক খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত বাতিল করতে হবে।
২। আদিবাসীদের কাছ থেকে পূর্ব অনুমতি ও সন্মতি ছাড়া আদিবাসী এলাকায় তথাকথিত উন্নয়নের নামে কোন প্রকল্প গ্রহণ না করা ও ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ করতে হবে।
৩। আদিবাসী অঞ্চলে আদিবাসীদের ক্ষতি হয় এমন সকল প্রকল্প যেমন- ইকোপার্ক, ইকো-ট্যুরিজম, জাতীয় উদ্যান, অবকাশযাপন কেন্দ্র, বানিজ্যিক কর্পোরেট পর্যটন বাতিল করতে হবে।
৪। কোনো বনভূমি এলাকা সংরক্ষিত, রক্ষিত, অশ্রেণীভুক্ত না অর্জিত তা চিহ্নিতকরণ বা ঘোষণার আগে আদিবাসী জনগণের সাথে অর্থপূর্ণ আলোচনা করা।
৫। আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার নিশ্চিতকরণে গৃহীত সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদ যা বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে তা দ্রত বাস্তবায়ন করা এবং আদিবাসীদের সম্মতিক্রমে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।