আন্তর্জাতিক

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূতি উপলক্ষে আলোচনা সভা

আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): আজ ২ ডিসেম্বর ২০২৩, আগরতলার প্রেস ক্লাবে “ক্যাম্পেইন ফর হিউমিনিটি প্রটেকশন” (সিএইচপি)-এর উদ্যোগে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূতি উপলক্ষে “হিউম্যান রাইটস সিচুয়েশন অফ দ্যা মাইনরিটি ইন বাংলাদেশ: ইন দ্যা লাইট অফ দ্যা চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস একোর্ড” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সিএইচপির সদস্য প্রিয়লাল চাকমার সঞ্চালনায় ও সিএইচপি’র সভাপতি নিরঞ্জন চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সঞ্জীব দেব, সম্পাদক, নর্থ ইষ্ট কালার পত্রিকা। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উষা রঞ্জন মগ, রামঠাকুর কলেজের প্রাক্তন ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. রবীন্দ্র দত্ত, প্রবীন সাংবাদিক স্রোত রঞ্জন খীসা, নয়ন জ্যোতি ত্রিপুরা ও বিমান জ্যোতি চাকমা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সঞ্জীব দেব বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের যে দুর্বিসহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে সেই প্রেক্ষাপট বিচার করতে গেলে আমার দেখতে পাব সেই ভুলটা নিহিত রয়েছে আমাদের স্বাধীনতার পর যখন দেশ ভাগ হয় ঠিক সেই সময়ে, আমাদের জাতীয় নেতাদের ভুল বা অবেহেলার কারণে। যার ফলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯৭ শতাংশ অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেদিন পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেদিন কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এর প্রতিবাদ করেছিলেন এবং প্রায় তিনদিন ভারতীয় পতাকা তুলে রেখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের ভারতীয় নেতৃত্ব সেদিন সেই ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজনবোধ মনে করেননি। যার ফলশ্রুতিতে আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের এক অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা দেখেছি যে দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত হতে হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জন্ম হয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে সেই পার্টি গড়ে উঠার পর সেখানে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক হত্যা, অগ্নিসংযোগ তথা বিভিন্ন অত্যাচারের কারণে উদ্ধাস্তু জীবন কাটাতে হয়েছে আমাদের এই ত্রিপুরা রাজ্যে।

পরবর্তীতে, ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তির ২৬ বছর আজকের পূর্ণ হলো। সেই চুক্তি এই আশায় করা হয়েছিল যে, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে সেখানকার মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে, মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ২৬ বছর পরও তা বাস্তবায়িত হয়নি। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে সেই সরকার এই ঐতিহাসিক চুক্তিটি বাস্তবায়ন করার আন্তরিকতা দেখাতে পারেনি। চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশির ভাগ ধারাই বাস্তবায়ন করেনি।
বিশেষ অতিথি উষা রঞ্জন মগ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলাদেশে সর্বমোট ৪৮ টি ক্ষুদ্র জাতি আছে সেগুলোকে আদিবাসী বলা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৪৭ সালে হিল ট্রাইবস ছিল ৮৯.৯১% আর শুধুমাত্র ৯.০৯% ছিল “নন-ট্রাইবস”। সেই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৬১ সালে ৮৭%, ১৯৭৪ সালে ৮০.৭৯%, ১৯৮১ সালে ৬১.০৭%, ১৯৯১ সালে ৫১.৪৩% হিল ট্রাইবস। অন্যদিকে “নন-ট্রাইবস” ১৯৫৬ সালে যেখানে ৯.০৯% তা ১৯৯১ সালে হয়ে গেছে ৪৮% এর উপরে। আমার জানা নেই হয়তোবা এখন সেথা ৫২% এর উপরে চলে গেছে। এইরকম ক্ষেত্রে ধর্মীয় বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে দেখি ১৯৪৭ সালে যেখানে ৮৫% তা ২০১১ সালে ৫০% এর নিচে নেমে গেছে, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালে যেখানে ১০% ছিল তা এখন ১% বা তারও কম হয়ে গেছে সেখানে। এখানে যে ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন তা স্পষ্টভাবে লক্ষনীয়। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল হচ্ছে। টাইবালরা উচ্ছেদ হচ্ছে।

স্রোত রঞ্জন খীসা বলেন, আপনারা কমবেশি সবাই জানেন পার্বত্য চট্টগ্রামে কিভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করে চলেছে। তারা তাদের ভূমি, তথা আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার রক্ষা করার জন্য ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে ঐতিহাসিক চুক্তি করলেও আজ ২৬ বছরেও বাস্তবায়ন করেনি সরকার। বরং তাদের উপর আজও সেনা শাসন জিইয়ে রেখেছে। তাদের অস্তিত্ব আজ সংকটের পথে।

তিনি আরো বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ৯৮% অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয় যা ভারতবর্ষের সাথে অন্তর্ভুক্ত হওয়া কথা। পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পর থেকে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম বাঙালি বসতি স্থাপন করছে যা আজও থামার নাম নেই। আমার বয়স হয়েছে আমার নিজের চোখেই দেখলাম ১৯৪৭ সালের মেজরিটি ট্রাইবসরা আজ ২০২৩ সালে এসে মাইনরিটিতে পরিণত হয়েছে, নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্রাইবেল এরিয়া মুসলিম বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হতে আর বেশিদিন নেই।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের রক্ষার্থে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার যাতে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয় তার জন্য ভারতের সকল আদিবাসীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

ড. রবীন্দ্র দত্ত বলেন, আজ ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। চুক্তিতে ভূমি সমস্যার সমাধান করার কথা থাকলেও প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল হচ্ছে। ভূমি বেদখলের উদ্দেশ্যে ট্রাইবদের গ্রামে ও জুমভূমি অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। ৩০ এপ্রিল ২০২২ তারিখে ডেইলী স্টার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, অগ্নিসংযোগের ফলে পাখি মারা গেছে, ঝর্ণার বিষ প্রয়োগে জল দুষিত হয়েছে, মাছ মারা গেছে। সেখানে অস্থানীয়দের নিকট ভূমি লীজ দেয়া হয়েছে। এই লীজের কারণে জনজাতিরা অত্যাচারিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এ ধরনের অনুষ্ঠান বার বার হওয়া উচিত যাতে বাংলাদেশ সরকারের নিকট তুলে ধরা যেতে পারে।

সভাপতির বক্তব্যে নিরঞ্জন চাকমা বলেন, চুক্তিতে জুম্মদের জায়গা-জমি রক্ষা করা ও বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত দেয়ার কথা রয়েছে। চুক্তিতে আরো ছিল যে, সমতল জেলাগুলি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতিকারী সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। সরকার বলেছিল যে, তারা সেটেলার বিষয়ে চুক্তিতে কিছু লিখতে পারবে না। তবে তারা সেটেলারদের সরিয়ে নেবে। কিন্তু বিগত ২৬ বছরেও সেটেলারদের ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। বরং সেটেলারদের দিয়ে জুম্মদের উপর হামলা, খুন, গুম, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটনা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, চুক্তিতে আরো ছিল যে, ৬টি ক্যান্টনমেন্ট ব্যতীত সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে। কিছু ক্যাম্প প্রত্যাহার হলেও সরকার আরো নতুন করে ক্যাম্প স্থাপন করছে। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের ক্ষমতা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করার বিধান করা হয়েছে চুক্তিতে। তাও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া দরকার বলে সভাপতি নিরঞ্জন চাকমা জানান।
উক্ত আলোচনা সভায় সাব্রুম, গন্ডাছড়া, লংতলাই ভেলী, ছামনু সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

Back to top button