বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে আদিবাসীদের অধিকার দিতে হবে: অধ্যাপক সাদেকা হালিম
৯ আগস্ট,২০২১ ইং আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে অনলাইন সংবাদমাধ্যম আইপিনিউজ একান্ত আলাপচারিতায় মুখোমুখি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড: সাদেকা হালিমের সাথে। আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আইপিনিউজের বিশেষ এই সাক্ষাৎকার পর্বে বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে আদিবাসীদের অধিকার ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ব্যক্ত করেছেন। আইপিনিউজের পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সুলভ চাকমা। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল –
আইপিনিউজ:
আপা নমষ্কার। আইপিনিউজের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। ৯ই আগস্ট,২০২১ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আদিবাসীদের একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম আইপিনিউজের মাধ্যমে আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাচ্ছি। প্রথমেই জানতে চাইবো আপনি কেমন আছেন?
ড: সাদেকা হালিম:
ধন্যবাদ। আইপিনিউজকেও শুভেচ্ছা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইপিনিউজের কিছু কিছু কার্যক্রম দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমার মনে হয় আদিবাসী তরুণরা তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন এবং সেভাবেই তারা এগিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করছেন। যার কারণে আইপিনিউজের মতো সুচিন্তিত উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি যেখানে আদিবাসী তরুণরা তাদের মৌলিক অধিকার, তাদের জীবন-জীবিকা, নারী অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন। আইপিনিউজের মাধ্যমে আদিবাসীদের সাথে আমাদের সকলের মধ্যে একটা মেলবন্ধন গড়ে উঠার সুযোগ হচ্ছে। সেজন্য আমি আপনাদেরকে আন্তরিকভাবে শুভেচ্ছা জানাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই করোনা প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে যথেষ্ট উদ্বেগ-উঠকন্ঠার মধ্য দিয়ে দিন পার করছি। কেননা, আমাকে একদিকে যেমন পরিবার ও আত্মীয়বর্গের খোঁজখবর রাখতে হচ্ছে অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বড় একটি অনুষদের ডিন হিসেবে আমার শিক্ষার্থীদের প্রতিও আমার বিশেষ দ্বায়িত্ব রয়েছে। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমি চেষ্টা করছি সকলের খোঁজখবর রাখতে। প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ করি, গত কিছুদিন আগে আপনাদের চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা দেবাশীষ রায় আমাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ফোন করেছিলেন। তাঁর কাছে আমি রাঙ্গামাটির পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি জানালেন যে, এখনো পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ পর্যায়ে যায় নি। গ্রামাঞ্চলে সেভাবে হয়তো করোনা ছড়িয়ে পড়ে নি। তবে রাঙ্গামাটির সাথে দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের আন্ত:যোগাযোগ (Mobility) আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেকারণে মানুষের চলাচল, যোগাযোগ প্রভৃতির কারণে করোনা প্রাদুর্ভাব সেখানেও যেকোন সময় আশঙ্খার সৃষ্টি করতে পারে। দেশের সবখানেই মোটামুটি চিত্রটা এরকমই। কাজেই সবার মত আমিও কিছুটা উদ্বেগ-উঠকন্ঠার মধ্য দিয়েই দিন পার করছি। আমাদের সকলের উচিত হবে যথাযথ স্বাস্থ্যসচেতনতা ও সরকারি নির্দেশনা অণুস্মরণ করার চেষ্টা করা।
আইপিনিউজ:
আপনি দীর্ঘদিন ধরে এদেশের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সাহস ও সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছেন। এদেশের আদিবাসী অধিকার আন্দোলনকে কীভাবে দেখেন?
ড: সাদেকা হালিম:
প্রশ্নটি আসলে সরলভাবে উত্তর দেওয়া কঠিন। প্রাসঙ্গিক অনেক কিছুই চলে আসে। বাংলাদেশে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন আদিবাসীর বসবাস আছে বলে মনে করা হয়। ১৯৪৭ সালে যখন দেশ বিভাগ হয়, সেসময় আমরা জানি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ভারতের সাথে যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। তারা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে চান নি। কিন্তু সেটা হয় নি। ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য এলাকাকে বিশেষ আইনের মাধ্যমে শাসন বহির্ভূত এলাকা (Excluded Area) হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সমতল অঞ্চলেও এরকম বেশ কিছু উপজেলা ছিল, বিশেষত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে। অর্থাৎ বৃটিশদের সাথে একধরনের বোঝাপোড়া ছিল যে, যেসকল এলাকায় আদিবাসীরা আছে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা। অবশ্য পাকিস্তান আমলে তা আর বজায় থাকে নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি। এর মাধ্যমে সেখানকার শাসনব্যবস্থা, সেখানকার ভূমি ব্যবস্থাপণা প্রভৃতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারিত আছে।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসনামলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে যেটাকে আমরা শান্তিচুক্তি হিসেবে অভিহিত করি। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে কিন্তু সেখানে এতদিন ধরে যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলমান ছিল এবং সেখানে স্বায়ত্বশাসনের যে দাবী ছিল তার একধরনের স্বীকৃতি মিলেছে। তাহলে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে যদি বলি ১৯৪৭ এ দেশভাগ হলো। এরপরে পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬০ সালের কাপ্তাই বাঁধের কথা বলতে হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এই বাঁধের ফলে প্রায় ১লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। অনেকেই ক্ষতিপূরণ পান নি। আবাধযোগ্য ভূমির অধিকাংশই পানির নীচে চলে যায়। এবং কি বর্তমান যে চাকমা রাজা তাদের রাজপ্রাসাদও পানির নীচে চলে যায়। একারনেই সেখানে শোষণ-বঞ্চনার বিপরীতে ধীরে ধীরে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে উঠেছে। এরপরে ১৯৭১ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরাও অংশগ্রহণ করেছে। তবে এখানে উল্লেখ না করলেই নয় যে, আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজা ত্রিদিব রায় এর ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। তিনি সরাসরি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে কাজ করেছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন। একারণে এদেশের অনেক মানুষের মধ্যে আদিবাসীদের নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তি আছে। বিশেষত, পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের নিয়ে। অনেকেরই ধারণা যে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু এটি ভূল ধারণা। আমি গবেষণা করতে যেয়ে যে তথ্য পেয়েছি, বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীদের সাথে কাজ করতে যেয়ে যা দেখেছি বা প্রফেসর ইমতিয়াজ, মেঘনা গুহঠাকুরতা, আমেনা মহসীন, ভেন সেন্ডেল প্রমুখ এর লেখালেখি পড়ে যা জেনেছি সেটা এই ধারণাকে সমর্থন করে না। বরং দেখা যায় যে সাধারণ আদিবাসীরাও এদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। পার্বত্য এলাকা থেকে অনেক বীরাঙ্গনা নারীর তালিকা পাওয়া যায় যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। কাজেই আমি বলবো কেবল রাজা ত্রিদিব রায় এর ব্যক্তিগত অবস্থানের কারণে মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ আদিবাসীদের অবস্থানকে সাধারণীকরণ করা যায় না। তাই নতুন প্রজন্মের দ্বায়িত্ব এসকল বিভাজন- বিভ্রান্তিগুলো দূর করার জন্য কাজ করা। অধিকারের ধারণার সাথে আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়টিও জড়িত। আমি অবশ্যই আশাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেহেতু পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন কোন ৩য় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সেহেতু পর্যায়ক্রমে আদিবাসীদের অন্যান্য দাবীগুলোও নিশ্চয়ই পূরণ হবে। তবে এক্ষেত্রে আদিবাসীদের মধ্যকার ঐক্য-সংহতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যেও ঐক্য-সংহতি গড়ে তুলতে হবে।
আইপিনিউজ:
আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের দাবী দীর্ঘদিনের? কিন্তু এখনো পর্যন্ত আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই কেন?
ড: সাদেকা হালিম:
আমরা যদি আমাদের সংবিধানের দিকে তাকাই সেখানে বঙ্গবন্ধু ৪টি মূল স্তম্বের কথা বলেছেন- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অমর্থ্য সেন বলেছেন এই ভারতীয় উপমহাদেশে বঙ্গবন্ধু যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুঝেছেন তা অন্যান্য নেতারা বুঝেন নি। সংবিধান রচনায় বঙ্গবন্ধুর সাথে জাতীয় চার নেতা ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক ড: আনিসুজ্জমান উল্লেখ করেছেন যে আদিবাসীরা তাকে জিজ্ঞেস করেছে কেন সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকারের কথা সেভাবে উঠে আসে নি। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আমি নিজেও প্রশ্ন করেছি আপনি তো ছিলেন সংবিধান রচনার সময়। আপনারা কেন বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেন নি। তিনি আমাকে বলেছেন যে, সেসময় আমরা ভেবেছিলাম হয়তো সংবিধানে বিষয়গুলো যেভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে সেভাবেই সকল কিছু অর্ন্তভূক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান রচিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। কিন্তু আমরা যদি পুরো সংবিধানের মৌলিক অধিকারের প্রয়োজনীয়তা এবং বৈশিষ্ঠ্যের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখি সেখানে সকল নাগরিকদের অধিকার প্রাপ্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে। যেমন সংবিধানের ২৮(১) এ বলা হয়েছে-
“কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।”
আবার ২৮(৪) এ বলা আছে-
“নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ণ হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”
কাজেই আমরা বলতে পারি সংবিধানে হয়তো সেভাবে সুনির্দিষ্টভাবে আদিবাসীদের কথা উল্লেখ করা হয় নি তবে সকল নাগরিকের অধিকার প্রাপ্তির বিষয়েই কিন্তু নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। এখানে আমি আরো একটি বিষয় যোগ করি। আদিবাসীদের আজকের যে অধিকারের লড়াই-সংগ্রাম তার মূল নায়ক কিন্তু ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আমি তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। একজন পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে সংসদে তার উপস্থাপন করা বক্তব্যগুলো আমি পড়ে দেখেছি। তিনি বঙ্গবন্ধুর নিকটও তুলে ধরেছিলেন যে, আমরাতো বাঙালি নই। আমাদের ভিন্ন ভাষা রয়েছে। আমরা দেখতে ভিন্ন। কাজেই সংবিধানে আমাদের স্বকীয়তার স্বীকৃতি থাকা দরকার। এই জায়গায় আমি বলবো, হ্যাঁ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সকল আবেদন হয়তো এখনো সংবিধানে স্বীকৃত হয় নি। আমি আশা করি সেটা পর্যায়ক্রমে সম্ভবপর হবে। আমরা কিন্তু বলতে পারি যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে স্বায়ত্বশাসনের দিকটা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে। এখানে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে কিন্তু সংবিধান কাটাছেড়া করা হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছে যেটা সর্বশেষ ১৫ তম সংশোধনীতেও বহাল থেকেছে। সেকারণে ৭২ এর সংবিধানের যে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনা তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
যাই হোক, সংবিধানের সর্বশেষ ১৫তম সংশোধনীতে কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও আদিবাসীদের একধরনের স্বীকৃতি মিলেছে। সংবিধানের ২৩(ক) তে বলা হয়েছে-
“রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ঠ্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”
এ প্রসঙ্গে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায়ও কিন্তু মন্তব্য করেছেন যে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে অবশিষ্ট জাতিসত্ত্বাগুলোকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃত দেয়া হয়েছে। তারপরেও আমি বলবো শব্দ চয়নে হয়তো আরো লক্ষ্য রাখা যেতে পারে। উপ, ক্ষুদ্র প্রভৃতি অভিধাগুলো কিন্তু হেয় করার মতন। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও জাতীয় অধ্যাপক ড: রঙ্গলাল সেন আমাকে বলতেন আমি যেন কখনোই উপজাতি শব্দটি ব্যবহার না করি। আমি যদি নিউইয়র্কের রাস্তায় হাঁটি, আমিওতো সেখানে সংখ্যালঘু। তবে কি আমি সেখানে উপজাতি হয়ে গেলাম?
আইপিনিউজ:
আদিবাসী নেতারা আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন করা এবং আদিবাসী কমিশন গঠন করার দাবী তুলছেন। এসব দাবী নিয়ে আপনার মতামত কি?
ড: সাদেকা হালিম:
সংবিধানের ২৩(ক) ধারাকে উপজীব্য করে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন হয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন তো দেখবে সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে। সংবিধানের কোথাও কিন্তু আদিবাসীদের ভূমি এবং ভাষিক অধিকার নিয়ে সুস্পষ্ট কোন উল্লেখ নেই। এই বিষয়ে সংবিধানে কিছু সুস্পষ্ট সংযোজন আসতে পারে। সরকার আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এখনো অণুসমর্থন করে নি। আমি আশা করি সেটা একসময় হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু অসাধ্যকে সাধন করার ক্ষমতা রাখেন। ‘তিনি শেখের বেটি’।
১৯৭২ সালে আইএলও ১০৭ বঙ্গবন্ধু অনুসমর্থন করেছেন। যাই হোক, আইএলও ১০৭ তে কিন্তু ট্রাইবাল শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। এখন শব্দগত দিক থেকে যাই হোক, আদিবাসী হোক বা উপজাতি সেখানে কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে অধিকার সুরক্ষার কথা বলা আছে। আইএলও ১০৭ এর ১,২,৩ এ কিন্তু ভূমি, ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি অধিকার নিয়ে সুনির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতার উল্লেখ আছে। আমাদের এখানে সমস্যা হচ্ছে যতদিন পর্যন্ত আদিবাসী শব্দটি আদিম বা হেয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ততদিন কোন সমস্যা হয় নি। ২০১৬ সাল পর্যন্তও আমরা নির্দ্বিধায় আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার দেখেছি। কিন্তু যেই না আদিবাসী শব্দটিকে আত্মপরিচয়ের হাতিয়ার হিসেবে, অধিকারের হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে তখন থেকেই সমস্যার সৃষ্টি। এবিষয়ে নৃবিজ্ঞানী প্রশান্ত ত্রিপুরাও বলেছেন। এখানে রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় জড়িত থাকতে পারে। আমাদের ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো জড়িত থাকতে পারে। তবে যাই হোক, আন্তর্জাতিকভাবে যেসব অধিকার সুরক্ষাকবচ গুলো রয়েছে যেমন- আইএলও ১০৭, CEDAW, ECOSOC প্রভৃতি, এগুলোর আলোকে আদিবাসীদের অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অবশ্যই আইন হতে পারে। আমাদের যে আইন কমিশন আছে সেখানেও একটি বিশেষ সেল করা যেতে পারে। আদিবাসীদের জন্য আদিবাসী বিষয়ক কমিশন হতে পারে। আদিবাসী কমিশন বা আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে পারে। নেপালে এধরনের প্রতিষ্ঠান আছে। ফিলিপাইনে আছে। ফিলিফাইনে একজন আইনপ্রণেতা নিজের জীবন উৎসর্গ করে আদিবাসীদের জন্য প্রথাগত আইনের স্বীকৃতি অর্জন করে দিয়ে গেছেন। যদিও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হয়তো সীমাবদ্ধতা আছে।
আইপিনিউজ:
এদেশের আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে এদেশের আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপণের জন্য আদমশুমারিতে সুনির্দিষ্ট তথ্যাবলী সন্নিবেশিত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি না?
ড: সাদেকা হালিম:
এবিষয়ে কিছুদিন আগেও একটি আলোচনায় থাকার সুযোগ হয়েছে। দৈনিক বণিকবার্তার উদ্যোগে আসন্ন জনশুমারিকে সামনে রেখে “জনশুমারি ২০২১: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভাজিত ও অন্তর্ভূক্তিমূলক পরিসংখ্যান” শীর্ষক একটি অনলাইন আলোচনায় আমি আমার মতামত রেখেছিলাম। সেখানে আমি বলার চেষ্টা করেছি যে, গত দুইদশক ধরে আমরা বিভিন্ন প্লাটফর্মে আদিবাসীদের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি নিয়ে বলছি। যখনই আদমশুমারি হয় তখনই কোন অজ্ঞাত কারণে সুকৌশলে আদিবাসীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে আদিবাসীদের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৫ শতাংশ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত রয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি তাই আমাদের খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের গবেষণা অনুসারে, চার লাখ আদিবাসী ১১ হাজার গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে। শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারীর উন্নয়ন ও জাতিসত্তার উন্নয়নের জন্য আদিবাসীদের বিভাজিত তথ্য প্রয়োজন। আমি আশা করব, একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে এ কাজগুলো করা যেতে পারে। কমিটিতে আদিবাসী প্রতিনিধি রেখে মতামত নেওয়া যেতে পারে। মোটকথা, সমাজবিজ্ঞানের একজন গবেষক হিসেবে আমি বলবো আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা ও তথ্যগুলোর প্রকৃত চিত্রটা সঠিকভাবে উঠে আসা খুবই জরুরী। আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেকেই প্যাশন হিসেবে আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের অনেকের মধ্যে একীভূতকরণ করার যে দৃষ্টিভঙ্গি (Assimilationist point of view) সে প্রবণতা আছে। আদিবাসীদের বৈচিত্রটাকে স্বীকার করেই তাদেরকে যথাযথভাবে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত।
আইপিনিউজ:
প্রান্তিক অবস্থানের কারণে এদেশের আদিবাসীদের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা অনেক বেশি। জাতীয় বাজেট এ আদিবাসীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করেন কি না?
ড: সাদেকা হালিম:
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে। আমার মনে আছে, কিছুদিন আগে পার্বত্য এলাকার কোন এক দুর্গম এলাকায় অসুখের কারণে অনেক শিশুর অসুস্থতার খবর শুনার পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেখানে বিশেষ সহযোগিতা পাঠানোর নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি পুনর্বাসনের কারণে আদিবাসীরা আরও প্রত্যান্ত অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। সেকারণে ঠিকমতোন স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। আমি দেখেছি যে, সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কার্যক্রমে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীরা যথেষ্ট সম্পৃক্ত আছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক এলাকায় তা পৌছাতে পারে নি। একারনেই আদমশুমারিতে আদিবাসীদের সম্পর্কে পৃথক ও সঠিক তথ্য সন্নিবেশিত হওয়া দরকার। আদিবাসীদের মধ্যেও কিন্তু বৈষম্য রয়েছে। সব মারমা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া, লুসাই এর কাছে কিন্তু সমানভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছাতে পারে না। এসকল বৈষম্য দূর করার জন্য জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। জনপ্রতিনিধিরাও এবিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। কেবল বাজেট ঘোষণা করার সময় চলে আসলেই এসব বিষয়ে কথা তুললে হবে না। সারাবছর ধরেই এবিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যম্যমেও কিন্তু সেভাবে তথ্য আসছে না। সাংবাদিকরা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে অনেক তথ্য তুলে নিয়ে আসতে পারে।
আইপিনিউজ:
একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আদিবাসীদের শিক্ষার অধিকার বিষয়ে আপনার মতামত কি?
ড: সাদেকা হালিম:
এখনও পর্যন্ত কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা সিট বৃদ্ধি করার কোন উদ্যোগ সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে আমার জানামতে, আদিবাসীদের জন্য এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুনির্দিষ্ট কিছু কোটা সিট বরাদ্দ থাকে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শুনেছি পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিদের জন্যও কোটা রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন দাবী জানানোর কথা আমি শুনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে কেউ দাবী জানাতে আসে নি। অন্যদিকে মেডিকেল কলেজগুলোতে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত সিটের বিপরীতে অ-আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করার বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ আছে। আমি মনে করি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা সিট যথাযথভাবে সংরক্ষিত হওয়া দরকার। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রেও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
আইপিনিউজ:
আদিবাসীদের সাথে বন, পাহাড়, প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পর্যটন, ইকো পার্ক প্রভৃতি কারণে আদিবাসীরা ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছেন। তাদের চিরায়ত ভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাজমান নানা সমস্যা সমাধানের উপায় কি?
ড: সাদেকা হালিম:
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে সেখানে প্রথাগত ভূমি অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী সেখানে ভূমি মালিকানা বা ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পরিচালিত হওয়ার কথা। পার্বত্য চটগ্রামে একসময় সবচেয়ে বেশি রিজার্ব ফরেস্ট ছিল। সেখানে মৌজা রিজার্ব রয়েছে। ভিলেজ কমিউনিটি ফরেস্ট (VCF) বা পাড়াবন রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় যেসকল রেকর্ডেড ভূমি রয়েছে তার অধিকাংশই কিন্তু সেখানে পুনর্বাসিত সেটেলারদের নামে। এখন দেখা যাচ্ছে সেখানে নানাভাবে ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। সেখানে রিসোর্ট হচ্ছে। সরকারিভাবে, ব্যক্তিমালাকানা হিসেবে বানিজ্যিক উদ্যোগ ও উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। অনেকসময় শোনা যায়, সাবেক সেনাকর্মকর্তাদের নামেও নাকি সেখানে ভূমি লীজ প্রদান করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় প্রচুর বনভূমি উজার হয়েছে। প্রাকৃতিক বন উজার করে বাণিজ্যিকভাবে বন সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ দেখা যায়। ভূমি হারানোর কথা যদি আমরা বলি তবে আদিবাসীরাই বেশি ভূমি হারিয়েছে। আদিবাসীদের ভূমি হারানোর চিত্রটা কিন্তু বিশ^ব্যাপীই কমবেশি দেখা যায়। অথচ আদিবাসীরা কখনোই বন ধ্বংস করে নি। আমরা কেন জানি বন রক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বেশী উদাসীন। আমার মনে হয়, বন এবং ভূমি রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। সমতল অঞ্চলে যদি দেখি সেখানে খাসিয়ারা তাদের পানপুঞ্জি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। তাদের ভূমি খাস হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলেই এমন সমস্যা হচ্ছে। অথচ তারা সেখানে হয়তো বংশপরম্পরায় বহুকাল ধরেই বসবাস করছে। ভূমি বেদখলের ক্ষেত্রে প্রভাবশালীরা যুক্ত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমি বলবো আদিবাসীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নিশ্চয়ই রয়েছে। সেকারণেই এবিষয়গুলো দেখা যাচ্ছে।
আইপিনিউজ:
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। অনুরুপভাবে দেশের সমতল অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত আদিবাসীরাও তাদের ন্যায্য ভূমি অধিকার সংরক্ষণের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করার জন্য দাবী জানিয়ে আসছেন। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
ড: সাদেকা হালিম:
হ্যাঁ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ-নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণীত হয়েছে এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এখন আইনের যথাযথ প্রয়োগ হওয়া দরকার। কমিশনে নিয়মিত শুনানি হওয়া দরকার। এই আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা ছিল। মাননীয় সন্তু লারমা স্যার, রাজা দেবাশীষ রায়, পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সকলের সংশ্লিষ্টতা ছিল। আমি যা জানি সেখানকার আদিবাসী নেতারা কিন্তু এই আইনটা নিয়ে সন্তুষ্ট। এই আইনের মাধ্যমে সেখানকার আদিবাসী ও স্থায়ী বাসিন্দাদের ভূমি অধিকার সুরক্ষাক্ষেত্রে আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঠিক সেভাবে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্যও পৃথকভাবে ভূমি কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
আইপিনিউজ:
আদিবাসী নারীদের উপর সহিংসতা ও নিপীড়ন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কি কারণে আদিবাসী নারীরা সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হয়? আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতা ও নিপীড়নের প্রতিকার কি?
ড: সাদেকা হালিম:
বাংলাদেশের সর্বত্রই নারীর উপর নিপীড়ন ও সহিংসতা রয়েছে। আমি জেনেছি যে, এই করোনা প্রাদুর্ভাবকালীন সময়েও সারাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আদিবাসী নারীরাও নানাভাবে সহিংসতা, নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয়। একদিকে তারা নারী অন্যদিকে আবার আদিবাসী নারী। প্রান্তিক অবস্থানের কারণে তাদের উপর নিপীড়ন ও সহিংসতার বিপরীতে বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নানাকারণে আইনগত সুরক্ষা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তারা সমস্যার সম্মুখীন হন। আবার অনেকসময় দেখা যায় একজন নারীকে নিপীড়ণ করে তার পুরো পরিবারকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। বিশেষত জমি দখলের উদ্দেশ্যে। আমি যখন বৃহত্তর সাতক্ষীরা অঞ্চলে চিংড়ি ঘের এলাকায় কাজ করেছি তখন দেখেছি যে, যখন কেউ জমি ছাড়তে চাচ্ছে না তখন নারীর উপর আক্রমন করে সেই পরিবারকে চাপে ফেলা হচ্ছে জমি দখল করার জন্য। আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার ক্ষেত্রে দেখা যায় যদি নিপীড়ক মূলধারার বাঙালি হয়ে থাকেন তবে ভুক্তভোগীর বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। কেননা থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারি প্রভৃতি ক্ষেত্রেই ধর্ষক বা নিপীড়নকারীরা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন। অনেকসময় তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার জন্যও তারা পার পেয়ে যান। এবিষয়গুলো নিয়ে আসলে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইনসমূহের পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠা প্রয়োজন। তারপরেও এবিষয়গুলো নিয়ে কিন্তু অনেক সংগঠন এখন কাজ করছে। পূর্বে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত তথ্য তেমন পাওয়া যেত না। এখন কিন্তু অনেক রিপোর্ট হচ্ছে। অনেকে জিডি করছে। থানায় যাচ্ছে।
আইপিনিউজ:
আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কেমন বলে আপনি মনে করেন? এক্ষেত্রে মুলধারার বাঙালি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
ড: সাদেকা হালিম:
আদিবাসী ফোরামের ২০১৭ সালের “সংহতি” প্রকাশনায় সোহেল হাজং এর একটা লেখা আছে। আমি সেটা পড়ে দেখেছি। তিনি সেখানে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি শাসনামলে আদিবাসীদের অবস্থার তুলনামূলক চিত্রটা তুলে ধরেছেন। দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছে। এবং একারণেই কিন্তু আদিবাসীদেরও আওয়ামীলীগ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিশেষ প্রত্যাশা থাকে। ২০০৮ সালের আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও কিন্তু আদিবাসীদের বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। এই আওয়ামীলীগই কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী অঙ্গীকার এর প্রতি দৃষ্টি দিলেও এটাই পরিষ্কার হয় যে, অন্তত কিছু হলেও আওয়ামলীগই কিন্তু আদিবাসীদের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছে। যদিও বর্তমানে আদিবাসী শব্দটি হয়তো ব্যবহার করা হচ্ছে না, তারপরেও বলা যায় আওয়ামীলীগের শাসনামলেই কিন্তু আদিবাসীদের অনেক দাবী পূরণ হয়েছে। কাজেই আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে এবং বৈষম্যহীন, প্রগতিশীল ও অসাম্পদায়িক চেতনার প্রতি সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকায় আওয়ামীলীগের প্রতিই আদিবাসীরা আস্থাশীল। এখন তো আদিবাসীরাও রাজনৈতিকভাবে অনেক সচেতন। তারাও কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং যুক্ত হচ্ছে। যারা রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত আছে তাদের সঠিকভাবে লবিং পরিচালনা করতে হবে। কেবলমাত্র মন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কথা চিন্তা করলে হবে না। আদিবাসীদের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে।
আইপিনিউজ:
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সাথে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেখানকার স্থানীয় আদিবাসী জনগণের দাবী চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয় নি। বর্তমান সময়ে এসে সুনির্দিষ্টভাবে চুক্তির কোন বিষয়ে কাজ করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
ড: সাদেকা হালিম:
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় পুলিশ গঠন করার কথা ছিল। সেটা হয় নি। যদিও সরকারি চাকুরিসহ বড় বড় বিভিন্ন পদেও সেখানকার অধিবাসীরা নিয়োগ পাচ্ছেন কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র আদিবাসী এলাকায় হচ্ছে না। সেরকম হলে হয়তো মানবাধিকার, নারী অধিকার বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তো। চুক্তি বিষয়ে কাজ করার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বিষয়ের কথা বলতে হলে আমি বলবো উদ্বাস্তুদের সঠিকভাবে পুনর্বাসন করার কথা। যেসব উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা হয়েছে তারা কেমন আছে এসব বিষয়েও গবেষণা হতে পারে। চুক্তি হয়েছে আজ প্রায় ২৪ বছর। প্রত্যাগত শরণার্থীরা কি তাদের ভূমি ফেরত পেয়েছে। আমি মনে করি ভূমি কমিশন কার্যকর হলেই পার্বত্য চুক্তির বড় একটা অংশ বাস্তবায়িত হয়ে যায়। ভূমি কমিশনকে কার্যকর করতে হবে। এক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ^াস করি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবিষয়ে যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে এবং তিনি পারবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটাকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা উচিত নয়। পার্বত্য সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে দেখা উচিত এবং রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান হওয়া উচিত।
আইপিনউজ: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন।
ড: সাদেকা হালিম: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।