সাক্ষাৎকার

বেচে থাকার জন্য শেষ লড়াইয়ের জন্য আদিবাসীদের প্রস্তুত হতে হবে – পঙ্কজ ভট্টাচার্য

ষাটের দশকের কিংবদন্তী ছাত্রনেতা, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা, পঙ্কজ ভট্টাচার্য । তিনি আদিবাসী দিবসকে কেন্দ্র আইপিনিউজের সাথে তিনি কথা বলেছেন। নিচে সাক্ষাৎকার টি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল……

১. কেমন আছেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
আমাদের দেশে নানান দিবস পালিত হয়, কিন্তু আদিবাসী দিবস কখনো সরকারীভাবে পালন হবেনা এইটুকু আমি জেনে গেছি। হতাশা গ্রাস করেছে জাতিকে এবং যারা সমাজকে – দেশকে বদল করতে চেয়েছিল, যারা দেশের আপামর জাতাগোষ্ঠীর সম-অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিল তারা বুঝে নিয়েছে যে এই অবস্থায় কোন পরিবর্তন হবেনা। সুতরাং হতাশা বেদনা এবং ক্ষোভ নিয়েই আছি।

২ঃ সামনে আদিবাসী দিবস, আপনি আদিবাসীদের জন্য কি বার্তা দিতে চান?

পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ আমি এইটুকু বলতে চাই পরিস্থিতির বিশ্লেষণ, আদিবাসীরা কেন ক্রমশ কেন বিলীন হয়ে যাবে, ক্রমশ কেন অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে, ক্রমশ তারা দেশান্তরী কেন হবে, তারা একসাথে অন্তত অবস্থা পরিবর্তনের জন্য, অন্তত বেচে থাকার জন্য শেষ লড়াইয়ের জন্য কেন প্রস্তুত হবেনা এটা আমার প্রশ্ন। আমি এইটুকু দাবী করিনা, আদিবাসীরা একাই এই সংগ্রাম করবে। এদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে যারা এখন পরিত্যক্ত বলা যায়, এবং অভিশপ্ত তাদের জীবন। আদিবাসীদের সাথে আমি সেইসব সংখ্যালঘুদের কথাও আমি বলি কারন তারাও আদিবাসীদেরে সাথে সাথে দেশ থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, ভুমিহীন হচ্ছে, দেশান্তরী হচ্ছে। সেই জায়গায় আদিবাসী, সংখ্যালঘু এবং সেইসাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শের অনুসারী বাংলাদশের জনগন যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল দেশের সকল মানুষ সমান এখানে ২২ পরিবারের শোষণ চলবেনা, কোন বৈষম্য চলবেনা, সব মানুষ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একটা অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করবে। এই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত জাতিকে রাষ্ট্রকে সঠিক জায়গায় আনার কাজটা আদিবাসী ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শের জনগন মিলে করতে হবে। এটা হলো আমার বিশেষ বার্তা।

৩ঃ আপামর মানুষের অংশগ্রহনে যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে সংবিধান প্রণয়ন হলো, সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কে একটা ভিত্তি করা হলো তা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ এইটা আমি মনে করি বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ হচ্ছে বাঙ্গালীর ঐতিহ্য বাঙ্গালীর যত সৎ কর্ম , যত অতীত ঐতিহ্য, সাহিত্য সংস্কৃতি, তার সমাজ সংস্কার তার আত্মত্যাগ, গৌরবের যত ইতিহাস সব মিলিয়ে যদি বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ হয় সেই জাতীয়তাবাদের পক্ষে আমি। কিন্তু যে জাতিয়তাবাদ উগ্র, বাঙ্গালী ব্যতীত অন্য কোন মানুষকে আদিবাসী ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিবেচনা করে তারা বাঙ্গালী হওয়া সত্বেও অদের আদিবাসী সংখ্যালঘুদের অত্যাচার করে, আদিবাসীরা ভিন্ন সংস্কৃতির লোক যেহেতু সেজন্য তাদের অত্যাচার করবে এটা কো যুক্তিসংগত কাজ হতে পারেনা। আমার কাছে একদা বাঙ্গালী হয়েছিলাম যে বন্ধুরা স্বার্থের জন্য অস্তিত্বের জন্য শোষন থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে বাঙ্গালীদের এখন প্রকৃত বাঙালি হওয়ার জন্য সাধনা করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে। একদা বাঙ্গালী হলাম এবং সাম্প্রদায়িক হলাম এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী হলাম, পাঞ্জাবীদের হাতে বাঙ্গালীরা নির্যাতিত হয়েছে, পাকিস্তান আমলে। বাঙ্গালী হয়ে আদিবাসীদের উপরে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপরে, সমতলের আদিবাসীদের উপরে নির্যাতন চালালে আমরা পাঞ্জাবী হয়ে গেলাম। পাঞ্জাবী বাঙ্গালী আমি চাইনা। পাঞ্জাবী আধিপত্য আদি বাঙ্গালী, বাঙ্গালী উগ্র জাতিয়তাবাদী বাঙ্গালী এটা কেউ কখনো আমরা চাইনা এবং সংবিধানেও এটা নাই। সংবিধানের ব্যত্যয় একটা আছে, এটা হচ্ছে আদিবাসীদের পরিচয়, স্বীকৃতি- সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। এটা আমরা মনে করি জাতিয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল শক্তির ব্যার্থতা। আমরা প্রগতিশীল শক্তি তখন কিছু মৃদুস্বরে কিছু প্রতিবাদ করেছিলাম, কিন্তু তা যথেষ্ট না। আরও জোর প্রতিবাদ হওয়া দরকার ছিল, যেমন মানবেন্দ্র লারমা সংসদে দাড়িয়ে দৃঢ়ভাবে উচ্চারন করেছিলেন এবং হুমকির মুখেও তিনি তার বক্তব্যের জায়গা থেকে তিনি সরে আসেন নি। জাতীয় ৪ নীতিতে জাতীয়তাবাদ সবার পরে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য ছিল সংবিধান অনুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম-অধিকারের। ৭২ এর সংবিধানে স্ববিরোধী কাজ রয়েছে। এবং সংবিধানের একটা বড় ক্রুটি যে তার জাতিগোষ্টীগুলোকে দেশে জুম্ম জাতিসহ আদিবাসী জাতিসমূহকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি এই ব্যার্থতা রাষ্ট্রের এই ব্যার্থতা সংবিধানের এই ব্যার্থতা বাঙালি জাতিরও। সেই হিসেবে আমিও লজ্জিত। আমরা সেই স্বীকৃতি দিতে পারিনি।


৪ঃ বাংলাদেশের আদিবাসীদের বর্তমানে প্রধানতম সমস্যা কি বলে মনে হয়?

পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ আদিবাসীদের প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা। পাহাড়ে এবং সমতলের একই সমস্যা। আদিবাসী জীবনটাই হচ্ছে ভূমি নির্ভর, আদিবাসীদের সংস্কৃতিটাও সংস্কৃতি নির্ভর। আদিবাসী জীবনধারা হচ্ছে ভূমি নির্ভর। ভূমি বন জলাশয় এবং পাহাড় নিয়েই তাদের জীবন। জঙ্গল পরিস্কার করে হাজার বছর ধরে যারা এ অ লকে বসবাসযোগ্য করে তুলেছে তাদের কাছ থেকেই সেই ভূমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ভূমির সাথে সাথে আদিবাসীরাও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এক কথায় আমি সেটা বলি, একটা স্বাধীবনতার মধ্য দিয়ে যে সুবাতাসটা এসেছিল, সকলেই সমান সুযোগ পাবে সেই জায়াগায় আদিবাসীরা প্রথম থেকেই বঞ্চিত হলো। তারা এই পরিবর্তনের অংশীদার, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, এদেশের সকল কৃষক আন্দোলন, শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন, নারী আন্দোলন সবকিছুর মধ্যেই কিন্তু আদিবাসীদের অবদান আছে। আদিবাসীরা সমস্ত পরিবর্তনের অগ্রবাহিনী ছিল। আজ তাদেরকেই আমরা বি ত করে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন উপহার দেব, তাদেরকেই আমরা সমকক্ষ বানাবোনা তাদের আমরা সেকেন্ড ক্লাশ সিটিজেন হিসেবে বিবেচনা করবো, কিংবা পারলে তাদের বিতারিত করবো, তাদের জমি দখল করবো, তাদের অধিকার রাখবোনা এটা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শের বাংলাদেশের পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সকল মানুষেরে জন্য, সকলের সম বিকাশের জন্য।

৫ঃ আদিবাসীসহ বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের এই দুরবস্থার জন্য প্রগতিশীল শক্তি কি কোনভাবে সম্পর্কিত?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
অবশ্যই সম্পর্কিত, এটা আমাদের দুর্বলতা, আমাদের লজ্জা এবং আমাদের ব্যার্থতা। সেই ব্যার্থতার একটি মাপকাঠি হল, সমাজে যারা প্রান্তিক মানুষ আদিবাসী সহ তাদের আমরা স্বাধীনতার মৌল সাফল্যগুলোর মধ্যে অংশীদার করতে পারিনি। সেটা স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু হয়েছে। ৭২ এর সংবিধান থেকেই শুরু, বাঙ্গালীত্বের জাহির করা এবং সেটা উগ্র বাঙ্গালীয়ানা জাহির প্রকৃত বাঙ্গালীয়ানার জাহির না বলে আমি মনে করি। এখানেই বাঙ্গালী হেরে গেছে। এবং মুক্তিযুদ্ধও এখানে হেরে গেছে , পরাজিত হয়েছে।

৬ঃ একজন বুদ্ধিজীবি/রাজনীতিবিদ হিসেবে আদিবাসী সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে আপনার সুপারিশ কেমন থাকবে?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
আদিবাসীদের জীবন অস্তিত্ব অধিকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এককভাবে এই সংগ্রামের সমাধান হবেনা। আদিবাসীদের অবশ্যই চুড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি রাখতে হবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরে যাওয়া যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শে দাড় করানোর জন্যে অপরাপর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের বিপুল অংশকে সামিল করতে হবে। সেটা কঠিন কাজ, কিন্তু এছাড়া আর কোন উপায় নেই। পাঞ্জাবীরা ছিল বর্নবাদী, এখন বাঙ্গালীরাও হবে বর্নবাদী এজন্যতো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল পুর্ব বাংলা, এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের উপনিবেশে পরিনত হয়েছে। এজন্যতো বাংলাদেশ যুদ্ধ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। অধিকার আদায়ের জন্য আদিবাসীদের আরেকটা বিপ্লবের আন্দোলনের জন্য প্রস্তু হতে হবে। এবং সেই আন্দোলন শুধু আদিবাসীরা না, সাথে আরও অনেককেই যুক্ত করতে হবে। সমচিন্তার মানুষদের নিয়ে বিশাল একটি ব্যারিকেট তৈরী করতে হবে।

৭ঃ আদিবাসী নারীদের প্রতি যে সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কারন কি বলে মনে করেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
আমি এটাকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বিকৃত করা বলে মনে করি। একবার অন্যায়ের পথে হাটা মানে শত শত অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। পাক বাহিনীর গনহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক দরবারে আমরা ২৫ শে মার্গচকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করছি, গণহত্যার মধ্যে ধর্ষণ- গণধর্ষনও ছিল এবং আমাদের যুদ্ধ শিশু আছে। পাকিস্তানীরা এইটা স্বজ্ঞ্যানে করেছে, আজ এই বাংলাদেশে পাকিস্তানী প্রেতাত্মারাই আদিবাসীদের উপর একই কায়দায় এইসব সহিংসতা চালাচ্ছে। এটা আমাদের জীবনে জাতীয় অভিশাপ, রাষ্ট্রীয় অভিশাপ। এই সহিংসতার পেছনে একটি রাজনৈতিক উদ্যেশ্য আছে এটা পরিস্কার। রাজনৈতিকভাবে আদিবাসি নারীদের প্রতি সহিংসতাকে আক্রমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

৮ঃ সমতলের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন ও মন্ত্রনালয়ের গুরুত্ত্ব কতটুকু?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
এটা আদিবাসীদের অস্তিত্বের সাথে যুক্ত, তাদের জীবন, জীবন ধারা, জীবিকা পিতৃপুরুষের শেষ চিহ্ন এই ভূমি। আজ এটি চরম হুমকির মুখে। তাদের এই ভূমির অধিকার রক্ষা করার জন্যেই পৃথক ভূমি কমিশন জরুরী। পৃথক ভূমি কমিশন না থাকার কারনেই পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত ভূমি হারাচ্ছে। ভূমি কমিশনকে মানবাধিকার কমিশনের অধীনে রেখে গঠন করতে হবে। আদিবাসীদের পাহাড়ে এবং সমতলে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে একটি বিশেষ কোটা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। সবথেকে বড় কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি যদি যথাযথ বাস্তবায়ন হয় তবে সমতলের আদিবাসীদের পৃথক ভূমি কমিশনের দাবী আরও জোরদার হবে।

৯ঃ আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস তার কাজ কতটুকু করতে পারছে বলে মনে করেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ আমার মতে শাসক গোষ্ঠীর মধ্য থেকে একটি উদার অংশের আদিবাসীদের প্রতি সমর্থন ওখানে পাওয়া যায়, কিন্তু আদিবাসীদের মুক্তির সংগ্রামে ধারাবাহিক আন্দোলন ককাসের মাধ্যমে সম্ভব না। ককাস হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীকে শাসন কাজে সহায়তার একটি ব্যবস্থা। আমি তাদের প্রয়োজনীয়তা একেবারে অস্বীকার করছিনা, কিন্তু আদিবাসীদের সমস্যাটা যখন সংকটের গভীরে চলে গেছে, সমস্যা একেবারে শেষ প্রান্তে চলে গেছে সেই আদিবাসীদের উদ্ধারের জন্য, মানবিক, সার্বজনীন অধিকার আদায়ের জন্য অর্থাৎ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ককাস যদি কখনো ভুমিকা রাখে তাহলে আমি ককাসকে স্যালুট জানাব। কিন্তু আমি সেই লক্ষন দেখতে পারছিনা। কিছু কাজ হচ্ছে, কিছু কথা হচ্ছে এইটুকুই।

১০ঃ পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
চুক্তির মুল অংশটা ভূমি, ভূমি মানে আদিবাসীদের অস্তিত্ব। পাহাড়ে যেখানে আদিবাসীরাই সংখ্যায় বেশি ছিল আজ সেখানে তারাই সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় আজ বাঙ্গালীরা দিন দিন প্রধান হয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের কাছ থেকে তাদের বন জঙ্গল, পাহাড় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, যার ফলে আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতিও আজ হুমকির মুখে। পাহাড়ের সেটেলার সমস্যার সমাধান না করলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী শুন্য করার জন্যই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বিলম্ব করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই, আদিবাসীদের নিজস্ব ভূমি, সংস্কৃতি এবং ভাষা নিয়ে জীবন যাপন নিশ্চিত করার জন্য এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতেই হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্চা নেই এটি পরিস্কার।

১১ঃ অনেকে মনে করে থাকেন আওয়ামী লীগ আদিবাসীবান্ধব দল ও সরকার কতটুকু যৌক্তিক?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
সবাই স্বার্থপর, আওয়ামী লীগ, বিএনপি জাতীয় পার্টি প্রত্যেকেই স্বার্থবাদী। কিন্তু আমি আওয়ামী লীগকে অন্যান্য দল থেকে ভিন্নভাবে দেখি, জাতীয় পার্টি, জামাত বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগ পৃথক এই কারনে- তার সুদীর্ঘ একটা লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। তার পৃথক ঐতিহ্য আছে, জনগনের স্বার্থে লড়াই করার, মুক্তিযুদ্ধ করার ইতিহাস আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ভেতর থেকে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে আওয়ামী লীগ ছিল নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষের দল। এখনকার আওয়ামী লীগ উচ্চবিত্তের দলে পরিনত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এখানে উচ্চবিত্ত। সুতরাং উচ্চবিত্তের দলের সাথে অর্থনৈতিক কারনে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির কোন পার্থক্য নেই। বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগের শুধুমাত্র ঐতিহ্যগত পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ থাকছেনা, এটা অনেক বেশি ভয়ংকর। এখনকার আওয়ামী লীগ তার শ্রেনীগত কারনে, স্বার্থগত কারনে, অর্থনৈতিক কারনে চুক্তি বাস্তবায়ন করছেন। তারা এখন মৌখিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আছে, আদর্শিক মুক্তিযুদ্ধের জায়াগায় আর নেই।

১২ঃ আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী বিতর্কের ফলাফল কি?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে বাঙ্গালী আদিবাসী যখন একসাথে যুদ্ধ করেছি, একসাথে খেয়েছি- ঘুমিয়েছি তখনতো আমরা কে বাঙালি আর কে আদিবাসি এই হিসেব আমরা করিনি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম প্রত্যেকেই মানুষ হিসেবে। সেই লড়াইয়ের ফল হিসেবে যখন দেশটা পেলাম সেখানে আমার আদিবাসী ভাইয়েরা তাদের অধিকার থেকে বি ত, তাদেরকে রাষ্ট্র স্বীকার করে নিচ্ছেনা। এটা আমি মনে করি রাষ্ট্রীয় দৈন্যতা। উগ্র জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয় হীনমন্যতা থেকে, বাঙালি জাতি আজ হীনমন্যতায় ভুগছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের মধ্যে বর্নবাদ লুকায়িত থাকে, সেই বর্ণবাদের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই বর্নবাদের কারনেই আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, আদিবাসীদের ক্ষুদ্র না করলে বাঙালি বড় হতে পারছেনা এই বিকৃত চিন্তা জাতিকে গ্রাস করেছে।

১৩ঃ সারা দেশে একরকম আইন, আর পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় সেনা শাসন ব্যাপারটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
পাকিস্তান আমলের ১৯৪৭ সাল থেকে প্রায় ৭১ বছর ধরেই পাহাড় সেয়ানশাসনের আওতায় আছে, তখন থেকে এখন অবধি পাহাড় একটি দিনের জন্যেও সেনাশাসন থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সেখানে সুদীর্ঘ সংগ্রাম, লড়াই করে এই পার্বত্য চুক্তি করতে সরকারকে বাধ্য হয়েছে। গণতন্ত্রের বাংলাদেশে আজ ১০ শতাংশ বাংলাদেশ গণতন্ত্রহীন হয়ে আছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ, এর বিকল্প নেই।

১৪ঃ ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নাই’ রাষ্ট্রের এই প্রজ্ঞাপনকে কিভাবে দেখেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্যঃ
বাংলাদেশে আদিবাসীদের অস্বীকার করা মানে এককথায় তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং সংগ্রামী ইতিহাসকে অস্বীকার করা। আদিবাসীদের অস্বীকার করার কারনে সরকারের পায়ের মাটি আরও সরে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আশাবাদী, আদিবাসী জনগন একদিন এদেশের অধিকাংশ জনগন আদিবাসীদের সমর্থন জানাবে, এদেশের সকল বাম রাজনৈতিক শক্তি আদিবাসীদের লড়াইয়ে ওতোপ্রোতভাবে অংশগ্রহন করবে এবং আদিবাসীরা তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে সাংবিধানিকভাবে সীকৃতি পাবে।

Back to top button