বিশেষ প্রতিবেদন: লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্তৃক অবৈধ ভূমি দখল ও মানবাধিকার লংঘন

বিশেষ প্রতিবেদক, আইপিনিউজ বিডি: লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত তিন এলাকা- লংকম পাড়া, রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়া এবং জয়চন্দ্র কারবারি পাড়ায় বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: এসব অঞ্চলে বসবাসরত অনেকেই লামা রাবার কোম্পানি কর্তৃক অবৈধ ভূমি দখল, ভূমি সুরক্ষা আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, নিরাপত্তাহীনতা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জানা যায়, বর্তমানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, কোনো কারণে একটি রাবার গাছ পড়ে গেলেও গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ভূমি দখলকারীদের অব্যাহত নিপীড়নের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে, তাদের মধ্যে প্রায় ১৭ জন সাধারণ মানুষ মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন। মিথ্যা মামলার এই প্রক্রিয়া এতটাই ব্যাপক যে, অনেক ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে একেকজনের নামে ১৩টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় তারা এসব মামলার মোকাবিলা করতে পারছেন না, যার ফলে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে।
অন্যদিকে, আদিবাসী নারীরা দৈনন্দিন কাজের সময় ক্রমাগত হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা তাদের নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে। তাছাড়া, এই গ্রামগুলোর জনগণ এখনো পর্যন্ত তাদের পৈতৃক ভূমি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।

রিং রং ম্রো-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা: লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষ থেকে মৃত আব্দুল হান্নানের পুত্র মোঃ আব্দুল মালেক (৩৮) ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি লামা থানায় মোট (৬) ছয়টি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন, যেখানে ত্রিপুরা ও ম্রো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ১০ জনের নাম উল্লেখসহ একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়।
এই (৬) ছয়টি মামলার মধ্যে একটি মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে রিং রং ম্রো-এর বিরুদ্ধে পাঁচটি মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। অন্যদিকে, ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আদিবাসীদের পানির উৎসে বিষ প্রয়োগের অভিযোগে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু পুলিশ এ মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক দায়ের করা মিথ্যা মামলার অভিযোগে পুলিশ ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের গ্রেপ্তার করছে। উল্লেখযোগ্য যে, ২০২৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার সন্ধ্যায় বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লংকম পাড়া এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভূমি রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা রিং রং ম্রো-কে গ্রেপ্তার করে।
সে সময় লামা-সরই ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা ছিলেন—সচিব: লংকম ম্রো, যুগ্ম আহ্বায়ক: রেংইয়েন ম্রো, ফাদরাম ত্রিপুরা, সাংলে ম্রো, সদস্য: মাথি ত্রিপুরা, রুইপাও ম্রো। পরে মিথ্যা মামলায় ভুক্তভোগী রেংইয়েন কারবারি, রিং রং ম্রো, কাদিং ম্রো ও দূইথং ম্রো আদালত থেকে ২০২৫ সালের ২৪ মার্চ জামিন পান।
লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছরি মৌজা নং: ৩০৩–এর অধীনে প্রায় ৪০০ একর ভূমি ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অধীনভুক্ত। এই ভূমিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তিনটি গ্রামের—লংকম পাড়া (ম্রো কারবারি পাড়া), জয়চন্দ্র পাড়া (ত্রিপুরা), ও রেংইয়েন পাড়া (ম্রো)—মোট ৩৯টি আদিবাসী পরিবার বসবাস করে আসছে।
কিন্তু ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ জহিরুল ইসলাম এবং মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ২০০’রও বেশি রোহিঙ্গা ওই ভূমি দখলের চেষ্টা চালায়। তারা জোরপূর্বক লংকম পাড়া, জয়চন্দ্র পাড়া ও রেংইয়েন পাড়ার বাসিন্দাদের আবাদি জমি দখল করতে যায় এবং আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা জনগণের ফলজ বাগান যেমন- আনারস, বরই, আম, জাম, কাঁঠাল এবং বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশবন কেটে ধ্বংস করে। এরপর ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল তারা ঐ জমির বাগানে অগ্নিসংযোগ করে, যার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং লক্ষ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়।
অতীতে লামা উপজেলার অধিকাংশ ভূমি ছিল ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সমষ্টিগত মালিকানাধীন ভূমি। সেই সময় তারা জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তখন কোনো কোম্পানি, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, প্রতিষ্ঠান বা বহিরাগত দখলদার ছিল না।

ভূমি দখলের পটভূমি: ভূমি দখলকারীরা মান্নান বাগান, মকবুল উকিল বাগান, ক্লিফটন এগ্রো, মেরিডিয়ান এগ্রো, গাজী গ্রুপ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, নিজামপুর এগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেড, হামেলা হোসেন ফাউন্ডেশন, পাহাড়িকা প্লান্টেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নামে ভূমি ইজারা নিয়ে আদিবাসী জনগণকে তাদের পৈতৃক ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে। ১৯৮৮ সালে রাবার বাগান স্থাপনের কারণে ফাইয়াং পাড়া ও এনগুইন পাড়া সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
এই দুই পাড়ায় ৮০টিরও বেশি আদিবাসী পরিবার বসবাস করত। সূত্র অনুযায়ী, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৯৮৮-৮৯ সালে ডলুছড়ি মৌজায় ১৬ জন শেয়ারহোল্ডারের নামে ৪০০ একর ভূমি ইজারা পায়, যেখানে প্রত্যেককে ২৫ একর করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩-৯৪ সালে একই মৌজায় ২৮ জন শেয়ারহোল্ডারের নামে আরও ৭০০ একর জমি (জনপ্রতি ২৫ একর করে) বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং ১৯৯৪-৯৫ সালে ৪ জন শেয়ারহোল্ডারের নামে ১০০ একর জমি (জনপ্রতি ২৫ একর করে) ইজারা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, মোট ৪৮ জন শেয়ারহোল্ডারের নামে ডলুছড়ি মৌজায় ১,২০০ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, একই ইউনিয়নের সরই মৌজায় ১৬ জন শেয়ারহোল্ডারের নামে ২৫ একর করে মোট ৪০০ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার নতুন পাড়া, ঢেঁকিছড়া পাড়া ও নোয়াপাড়ায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে মোট ১,৬০০ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়। ফলে ঐ এলাকার তিনটি গ্রামের শত শত পরিবার উচ্ছেদের হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ৬৪ জন শেয়ারহোল্ডারের নামে এই জমিগুলো ৪০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়।
তবে বাস্তবে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে ইজারা নেওয়া জমির পরিমাণ ১,৬০০ একর হলেও বর্তমানে তাদের দখলে জমির পরিমাণ ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ একর পর্যন্ত পৌঁছেছে। এত বিশাল পরিমাণ জমি দখলের পরও তাদের ভূমি দখলের ক্ষুধা শেষ হয়নি। এখন তারা পূর্বদিকে লংকমপাড়া ও জয়চন্দ্র পাড়া এবং দক্ষিণ দিকে রেংইয়েন পাড়ার ভূমির দিকেও নজর দিয়েছে। কোম্পানিটি ঐ এলাকাতেও রাবার বাগান স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। যদিও ইজারা চুক্তিতে লিজগ্রহীতাদের জন্য ২৮টি শর্ত উল্লেখ করা ছিল, তারা কোনো শর্তই মানেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে ।
ঢেঁকিছড়া নতুন পাড়ার কারবারি রেংইয়েন ম্রো বলেন, “লামা উপজেলার বেশ কয়েকটি রাবার কোম্পানি আমাদের ভূমি ও বাগান দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ১,৬০০ একর, মেরিডিয়ান কোম্পানি ৩,০০০ একর এবং লামা কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ৩,৫০০ একর ভূমি দখল করেছে।”
গ্রামবাসীরা জানান, তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রায় ৪০০ একর জমিতে চাষাবাদ ও বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু হঠাৎ ২০১৯ সালে “লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ” নামে একটি কোম্পানি রাবার প্লটের নামে তাদের ভূমি দখলের চেষ্টা শুরু করে। যখন গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন কোম্পানির লোকজন মামলা, হামলা, হত্যা ও পুলিশের হুমকি দেয়। এরপর থেকে কোম্পানির পক্ষের লোকেরা ভাড়াটে শ্রমিকদের ব্যবহার করে বারবার আদিবাসী গ্রামবাসীদের জমি দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপ:
জানা যায়, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মোজাম্মেল হক বাহাদুর। এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল—আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা জনগণের ৪০০ একর জুম ভূমি ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উদ্ভূত সমস্যাগুলোর সমাধান করা। কমিটি ২০২৩ সালের ১০ মে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা ২০২৩ সালের ১৯ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (MoCHTA) সচিব ও স্থায়ী কমিটির কাছে একটি চার দফা সুপারিশ পাঠান।
সে সুপারিশে ছিল:
১। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সব লিজ বাতিল করা।
২। অগ্নিসংযোগের ঘটনার দায়ীদের গ্রেপ্তার করা।
৩। ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো ও ত্রিপুরা জনগণের জন্য সহায়তা প্রদান এবং
৪। জুম চাষ ও বাগান উন্নয়নে সরকারি সহায়তা প্রদান।
পরবর্তীতে, ২০২৩ সালের ২১ মে, বান্দরবান জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় সরকার উপপরিচালক মোঃ লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে একটি ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়, যা ৪০০ একর জমি সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য লামা উপজেলার ৫নং সরই ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে শুনানি পরিচালনা করে। শুনানির সময় কমিটির পক্ষ থেকে ৩৯টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রত্যেককে ৫ একর করে জমি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, কিন্তু গ্রামবাসীরা এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে।
এরপর, ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট, তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি-র সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আরেকটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আগের মতোই প্রতিটি পরিবারকে ৫ একর করে জমি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ভূমি রক্ষা কমিটি এই প্রস্তাব অন্যায্য বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
এদিকে, ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই, ভূমিদস্যু কামাল উদ্দিন, মোয়াজ্জেম হোসেন ও জহির উদ্দিন তাদের ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে ডলুছড়ি হেডম্যান অফিসে ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরার ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সে হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন এবং হাসপাতালে ৫ দিন ভর্তি ছিলেন।
ভূমিদস্যুরা পরে রেংইয়েন কারবারি পাড়ায় নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারের ওপরও হামলা চালায়, বিহারের সম্পত্তি ভাঙচুর করে এবং দুটি বুদ্ধমূর্তি লুট করে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা দেন।
এছাড়াও, ভূমিদস্যু কামাল উদ্দিন ও তার সহযোগীরা ভূমি রক্ষা কমিটির (ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি) আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা, সদস্য সচিব লংকম ম্রো, যুগ্ম আহ্বায়ক রেংইয়েন ম্রো, ফাদরাম ত্রিপুরা, সদস্য মাথি ত্রিপুরাসহ ১১ জন ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

ঘটনার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ধারাবাহিক বিবরণী:
১। ২০১৯ সাল থেকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানি “রাবার প্লট” তৈরির নামে জুম্ম আদিবাসী গ্রামবাসীদের জমি দখলের চেষ্টা শুরু করে। যখন গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ জানায়, তখন কোম্পানির লোকজন মামলা, হামলা, হত্যা ও পুলিশের হুমকি দেয়।
২। একই বছরে (২০১৯) ম্রো পরিবারগুলো বান্দরবানের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)-এর নিকট লিখিত অভিযোগ দাখিল করে, কিন্তু এখনো তারা বিচার পায়নি কিংবা তাদের ভূমি ফেরত পায়নি।
৩। ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি, রাত প্রায় ১টার দিকে, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের রেংইয়েন কারবারি পাড়ায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লোকজন অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায়। এতে ম্রো গ্রামবাসীদের ৭টি ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে যায় এবং ২টি ঘর ভেঙে ফেলা হয়।
৪। ২৬ এপ্রিল ২০২২, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লংকম কারবারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারি পাড়া ও রেংইয়েন কারবারি পাড়ায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত হামলাকারীরা ৪০০ একর চাষযোগ্য জমি কেটে ফেলে ও আগুন দেয়। এতে প্রায় ১০,০০০ বাঁশ এবং ৩৯টি পরিবারের ২০০ জন গ্রামবাসীর জীবিকা ও খাদ্য-পানির সংকট সৃষ্টি হয়।
৫। ১৩ জুলাই ২০২২, ভূমিদস্যু কামাল উদ্দিন, মোয়াজ্জেম হোসেন ও উহির উদ্দিনের নেতৃত্বে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দল ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরার ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়।
৬। ১০ আগস্ট ২০২২, কোম্পানির ভাড়াটে শ্রমিকরা রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়ায় নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারের ওপর হামলা চালিয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর করে।
৭। ১৪ আগস্ট ২০২২, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপক মোঃ আব্দুল মালেক বান্দরবান সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা, কারবারি রেংইয়েন ম্রো, লংকম ম্রো এবং আরও ১৫/২০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলাটি দায়ের হয় দণ্ডবিধির ১০৯/১৪৩/৪৪৭/৩৭৯/৪২৭/৫০৬/৩৪ ধারায়।
৮। ১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ভূমিদস্যুরা লংকম পাড়ার ম্রো গ্রামবাসীদের মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেত থেকে ২৫ মণ কুমড়া লুট করে নিয়ে যায়।
৯। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ভূমি রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রাংধজন ত্রিপুরা ও লংকম ম্রোসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মিথ্যা মামলা (সিআর মামলা নং-৩১৩/২০২২) দায়ের করেন লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপক আব্দুল মালেক।
১০। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, রাবার কোম্পানির শ্রমিকরা রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার পানির উৎস কলাইয়া ঝিরিতে বিষ মিশিয়ে গ্রামবাসীদের হত্যার চেষ্টা করে।
১১। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, কোম্পানির লোকেরা রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার বাসিন্দা রেংইয়ং ম্রো-এর ৩০০টি কলাগাছ কেটে ফেলে।
১২। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, লামা থানার এসআই শামীম গ্রামে বিদ্যালয় নির্মাণকাজ বন্ধের নির্দেশ দেন।
১৩। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ভূমি বিরোধের কারণে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ দণ্ডবিধির ১৪৪/৪৫ ধারা জারি করে উভয় পক্ষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে কোম্পানির লোকজন বন কেটে ফেলে।
১৪। ২৩ থেকে ২৬ অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত, কোম্পানির লোকজন ৭০টি আমগাছ ও প্রায় ২০ একর গ্রাম্য বনভূমি কেটে ফেলে।
১৫। ১ জানুয়ারি ২০২৩, রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার ৭টি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ২টি ঘর ধ্বংস করা হয়।
১৬। ৫ জানুয়ারি ২০২৩, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
১৭। ৭ জানুয়ারি ২০২৩, রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার কারবারি রেং ইয়ং ম্রো লামা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন— লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রকল্প পরিচালক কামাল উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম, ম্যানেজার আরিফুল ইসলাম, সহকারী ম্যানেজার আব্দুল মালেক, এবং আরও ১৫০–১৭০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি। তবে এখনো কোনো অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
১৮। ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়া পরিদর্শন করেন, যেখানে লামা-সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা মানবাধিকার কমিশনের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দেন।
১৯। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি সরই ইউনিয়নে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে, রেংইয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার বৌদ্ধ বিহারের জমি দখল ও ঘর নির্মাণের প্রতিবাদে।
২০। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ঢাকার হাইকোর্টের সামনে অবস্থান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয় ৪০০ একর ভূমি দখল ও বৌদ্ধ বিহারের স্থানে জোরপূর্বক ঘর নির্মাণের প্রতিবাদে এবং ভূমিদস্যুদের শাস্তির দাবিতে।
২১। ১ মার্চ ২০২৩, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল মালেক বাদী হয়ে ১২ জন আদিবাসীর বিরুদ্ধে আরেকটি সাজানো মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
২২। একই দিনে (১ মার্চ ২০২৩) ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সংগঠক মাথি ত্রিপুরাকে ওই মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
২৩। ২৭ মার্চ ২০২৩, ২৬ দিন কারাভোগের পর মাথি ত্রিপুরা জামিনে মুক্তি পান।
২৪। ৪ মার্চ ২০২৩, ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা অভিযোগ করেন যে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ৪০০ একর ভূমি দখলের জন্য আন্দোলনের ভেতরে বিভাজন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে।
২৫। ৩০ মার্চ ২০২৩, লংকম ম্রো, রংধজন ত্রিপুরা, রেংইয়েন ম্রো, রিংরং ম্রো, দূইথং ম্রোসহ ৮ জন আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক নজমুল হোসেন ৭ জনের জামিন মঞ্জুর করেন, তবে লংকম ম্রোর জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২৬। ২৬ এপ্রিল ২০২৩, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপকমিটি নং-২ দীর্ঘদিনের এই ভূমি বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
২৭। ১০ মে ২০২৩, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে মোজাম্মেল হক বাহাদুরের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করা হয়।
২৮। ২৬ জুন ২০২৩, ৩ মাস কারাভোগের পর লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও পাড়া কারবারি লংকম ম্রো রাত ৮টার দিকে জামিনে মুক্তি পান ।
২৯। ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, মৃত আব্দুল হান্নানের পুত্র মোঃ আব্দুল মালেক (৩৮) লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষ থেকে লামা থানায় ১০ জনের নাম উল্লেখসহ একজন অজ্ঞাতনামা আদিবাসী গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে ৬টি মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন।
৩০। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লংকম পাড়ায় সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভূমি রক্ষা আন্দোলনের নেতা রিংরং ম্রো-কে গ্রেপ্তার করে।
৩১। ২৪ মার্চ ২০২৫, রেংইয়েন কারবারি, রিংরং ম্রো, কাদিং ম্রো ও দূইথং ম্রো আদালত থেকে জামিন পান।


