অন্যান্য

বিলাইছড়িতে ধর্ষণের ভিকটিমকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে অস্বীকার পুলিশের

নিজস্ব প্রতিনিধি, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮: রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়াতে ধর্ষণ ও শ্লীনতাহানির চেষ্টার শিকার দুই মারমা সহোদরা কিশোরীকে চিকিৎসা শেষে রাঙ্গামাটি হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ অভাবনীয় তালবাহানা করছে বলে জানা গেছে। জানা যায় যে, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ সকালের দিকে হাসপাতাল থেকে তাদেরকে ছাড়পত্র দেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে হঠাৎ করে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ভিকটিমদেরকে একমাত্র জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা ব্যতীত কারো হাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছেড়ে দেবে না। কিন্তু সেদিন (২৫ জানুয়ারি) বাঞ্চিতা চাকমা ব্যস্ত থাকায় দুই ভিকটিম বোনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
অপরদিকে ২৫ জানুয়ারি বিকালের দিকে পুলিশের প্রহরায় ভিকটিমদের পিতা-মাতাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। যেহেতু তাদের পিতা-মাতাকে ফারুয়াস্থ বাড়ি থেকে ২৪ জানুয়ারি ভোরে একদল সেনা সদস্য ধরে নিয়ে আসে এবং তারপর থেকে সেনা-পুলিশের হেফাজতে তাদেরকে রাখা হয়েছে, সেহেতু দুই ভিকটিম বোন তাদের পিতা-মাতার সাথে যেতে অস্বীকার করে। তারা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা ও চাকমা সার্কেলের রাণী য়েন য়েন-এর হেফাজতে হাসপাতাল থেকে চলে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে।
২৬ জানুয়ারি দুপুরের দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা ও চাকমা সার্কেলের রাণী য়েন য়েন দুই মারমা বোনকে ছাড়িয়ে আনতে হাসপাতালে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের হেফাজতে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে। তাদের উপর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের চাপ রয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে উক্ত দুই বোনের সাথে থাকা সহায়তাকারীকেও এ সময় হাসপাতাল থেকে চলে যেতে হুমকি দেয় পুলিশ। কিন্তু পুলিশের হুমকি সত্বেও তিনি চলে যেতে অস্বীকার করেন। এক পর্যায়ে দুই ভিকটিমকে একটি কক্ষে দরজা বন্ধ করে রাখা হয় বলে জানা যায়। এ সময় হাসপাতালের বাইরে থাকা একদল সেনাসদস্য কর্তৃক সাংবাদিকদেরও হাসপাতাল এলাকা থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
অপরদিকে দুপুরের দিকে (২৬ জানুয়ারি) ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সাংসদ উষাতন তালুকদার রাঙ্গামাটি হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা: শহীদ তালুকদারের সাথে দুই মারমা বোনকে ছেড়ে দেয়া বিষয়ে কথা বলেন। ডা: শহীদ তালুকদার আশ্বাস দেন যে, তিনি আবাসিক চিকিৎসক ডা: নিহার নন্দীর সাথে কথা বলবেন এবং বিকালের দিকে দুই বোনকে ছাড়িয়ে আনার জন্য হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করেন। তদনুসারে বিকাল ৫:০০ টায় দুই ভিকটিম বোনকে ছাড়িয়ে আনতে সাংসদ উষাতন তালুকদার, চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, রাণী য়েন য়েন ও বাঞ্চিতা চাকমা হাসপাতালে যান। এ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা ও এ্যাডভোকেট ভবতোষ দেওয়ানও এ সময় হাসপাতালে উপস্থিত হন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের হেফাজতে ছাড়পত্র দিতে চাইলেও পুলিশ ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে। এ সময় আরো পুলিশ ফোর্স বাড়ানো হয়। অনেক সেনা সদস্যও হাসপাতালের প্রাঙ্গণে জড়ো হতে দেখা যায়। গোয়েন্দা সদস্যদের ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও হাসপাতালে ছুটে যান।
ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষা করার জন্য পুলিশ পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন করা হয়েছে মর্মে আদালতের একটা কাগজ এ সময় প্রদর্শন করেন পুলিশ সুপার। কিন্তু তদনুসারে ইতিমধ্যে মেডিকেল পরীক্ষা হয়ে গেছে। তাই সেই মেডিকেল পরীক্ষার নামে ভিকটিমদের হাসপাতালে রাখার পুলিশের অজুহাতও ধোপে টেকেনি। একপর্যায়ে বলা হয়, শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। তাই ছাড়পত্র দেয়া যাবে না। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের সাথে আলাপ করে পরবর্তী রবিবারে ছাড়পত্র দেয়া যেতে পারে বলে জানানো হয়। ভিকটিমদের হেফাজতকারী হিসেবে পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকরা হচ্ছে সরকারিভাবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরা হয়। চাকমা সার্কেল চীফ বা নির্বাচিত সংসদ সদস্যও হেফাজতকারী হতে পারে বলে এ সময় আইনজীবীরা পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেন। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরও ভিকটিমদের এভাবে অযথা হাসপাতালে রাখা একপ্রকার মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বলে তুলে ধরা হলেও পুলিশ দুই বোনকে ছাত্রপত্র দিতে একেবারেই নারাজ। এভাবে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুলিশ সুপার উত্তেজিত হয়ে সাংসদ উষাতন তালুকদার ও রাজা দেবাশীষ রায়ের সাথে কথা বলতে থাকেন।
হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হবে না মর্মে শোনার সাথে সাথে ভিকটিম ছোট বোন কাঁদতে শুরু করে এবং বিষ খেয়ে মরবে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। বড় বোনও রাণী য়েন য়েনের নিকট আর্জি জানিয়ে তাদেরকে নিয়ে যেতে হাউমাউ করতে থাকে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী শৈনু মারমা জানান, হাসপাতালে কয়েক ডজন রোগীর সাথে সাধারণ ওয়ার্ডে ভিকটিমদের রাখা হয়েছে। সেখানে প্রতিনিয়ত রোগীর শুশ্রুষাকারী লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতি থাকে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন থাকে। লোকজন গিয়ে অসংখ্য মানুষের সামনে প্রকাশ্যে তাদেরকে ধর্ষণ ও শ্লীনতাহানির চেষ্টার ঘটনা বিষয়ে আলোচনা হয়, যা কিশোর বয়সী ভিকটিকদের উপর আরেক ধরনের যৌন নিপীড়নের সামিল। এছাড়া হাসপাতালের অস্বস্তিকর পরিবেশে থাকতে সাধারণভাবে আদিবাসী পাহাড়িরা অভ্যস্ত নয়। হাসপাতালের থাকা-খাওয়ার সাথে পাহাড়িরা খাপ-খাইতে পারে না। এছাড়া চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরও মানসিক ও শারীরিকভাবে কাহিল অবস্থায় তাদেরকে হাসপাতালে রাখা চরম অমানবিক ও নিপীড়নমূলক। হাসপাতালে রাখার নামে বস্তুত তাদেরকে এখন বন্দী শিবিরে রাখা হয়েছে এবং প্রকারান্তরে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে বলে বিবেচনা করা যায়। এটি খোদ প্রশাসন কর্তৃক মানবাধিকারের এক দু:খজনক লংঘন ও অবমাননা বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। আরও উদ্বেগ ও গভীর পরিতাপের বিষয় হল, অভিযুক্ত বা দোষীদের গ্রেপ্তার করে যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি বলে জানান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী।
উল্লেখ্য যে, গত ২২ জানুয়ারি ২০১৮ দিবাগত রাত আনুমানিক ২:৩০ টায় রাঙ্গামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ওড়াছড়ি গ্রামে এক মারমা কিশোরী (১৭) ফারুয়া সেনা ক্যাম্পের সেনাসদস্য কর্তৃক নিজ বাড়িতে ধর্ষণের শিকার এবং তার আরেক ছোট বোন (১৫) শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

Back to top button