মতামত ও বিশ্লেষণ

বিরলের কড়া গ্রামে হামলার বিচার চাইঃ পাভেল পার্থ

বাংলাদেশে আদিবাসী জনগণের সাংবিধানিক পরিচয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০-এর ২(১) এবং ধারা ১৯ এ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, সাঁওতাল, ডালু, উসাই(উসুই), রাখাইন, মণিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওরাও, বর্মণ, পাহাড়ী, মালপাহাড়ী, কোল এবং বর্মণ নামে মোট ২৭ জনগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। পূর্বের ২৭ আদিবাসী জাতির পাশাপাশি বর্তমানে কুর্মি মাহাতো, কন্দ, গঞ্জু, গড়াইত, মালো, তুরি, তেলী, পাত্র, বানাই, বাগদী, বেদিয়া, বড়াইক, ভূমিজ, মুসহর, মাহালী, রাজোয়ার, লোহার, শবর, হদি, হো এবং কড়া এ ২১ আদিবাসী জাতির নাম ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ এর তফশিলভূক্তকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ২০১৩ সনে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তফশিলভূক্ত এই কড়া জাতির জনসংখ্যা একশ’র কম। দিনাজপুরের বিরলের হালজায়-ঝিনাইকুড়ি কড়াদের বড় গ্রাম। এই গ্রামে কড়াদের সংখ্যা ৭০। এছাড়া বিরলের বৈরাগী পাড়াতে এক পরিবার ও ঘুঘুডাঙ্গায় ৩ পরিবার কড়ারা আছে। অবিস্মরণীয় স্বাধীনতার এই মাসে, ৬ মার্চ দিনেদুপুরে হালজায়-ঝিনাইকুড়ি কড়া গ্রামটিতে অতর্কিতে হামলা করেছে বাঙালি ভূমিদখলদাররা। সকাল ৯.৩০ থেকে দুপুর ১ পর্যন্ত এই নৃশংসতা চলে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে বিরল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভর্তি আছেন ৫ জন কড়া আদিবাসী। কলো কড়া (৬০) ও নিরন কড়ার পিঠ ও পায়ে লাঠি দিয়ে গুরুতর জখম করা হয়েছে। সাতল কড়ার (৫০) হাত, পা, উরু থ্যাৎলে গেছে। কেদু কড়ার (৭০) নাক ও মাথায় আঘাত লেগেছে এবং মলিন কড়ার (৩৫) হাত, পা ও গাল ধারাল অস্ত্র দিয়ে চিরে ফেলা হয়েছে। নির্দয় এই হামলার নেতৃত্ব দিয়েছেন বিরলের বটহাটনিবাসী বহুজাতিক বিষ কোম্পানির ডিলার মো. কামরুজ্জামান, কাজীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. কাফি এবং হাইব্রিড ভূট্টা ও গম ব্যবসায়ী মো. কিবরিয়া। তারা প্রায় ৬০-৭০ জন বাঙালি পুরুষকে এই হামলায় ব্যবহার করেছেন। এই ঘটনায় পুলিশ মো. কিবরিয়াকে আটক করেছে।

কেন এই হামলা? সেই ভূমি নিয়েই এই বিরোধ। কড়া গ্রামের ৭১ শতাংশ কড়াদের চাষের জমি দীর্ঘদিন ধরে জোরপূর্বক দখল করতে চেয়েছে বাঙালি দখলদাররা। এই জমিনে কড়ারা ধান আবাদ করেন। মৌসুমে বেগুন, আলু, মরিচ, টমেটো নানা সব্জি আবাদ করেন। কিন্তু এখন এই জমি অনাবাদী পড়ে আছে। মূলত এই জমির মালিকানা সাতল কড়াদের। উত্তরাধিকারসূত্রে সাতল কড়া এই জমির মালিকানা বহন করে চলেছেন। সাতল কড়ার সাথে রতন কড়ার বিয়ে হলে তারা এই জমি সামাজিক নিয়েমে আবাদ করেছেন। সাতল কড়াদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রায় ৩ বিঘা (৪৮ শতক=১ বিঘা) জমির প্রায়টাই এখন বাঙালিদের জবরদখলে।

কেবলমাত্র সাতল কড়াদের পরিবার নয়, কড়া গ্রামের সকলের উত্তরাধিকার জমিই আজ বাঙালি ভূমিদখলের অব্যর্থ নিশানা। কড়ারা কোথাও কোনো বিচার পাননি। মুক্তিযোদ্ধা থপাল কড়াদের প্রায় ৫ বিঘা এবং মুক্তিযোদ্ধা কিনা কড়ার ৭ বিঘা জমিও আজ জবরদখল হয়েছে। একইভাবে কামান কড়ার ২ বিঘা, যগেন কড়ার ৩ বিঘা, কেদু কড়ার ৫ বিঘা, কৃষ্ণ কড়ার ৪ বিঘা, রঞ্জন কড়ার ৪ বিঘা, বিমান কড়ার ৩ বিঘা, কাটমার কড়ার ২ বিঘা, কাইচাল কড়ার ২ বিঘা, রতন কড়া ৩ বিঘা, অঞ্জল কড়ার ৪ বিঘা, বাবা কড়ার ২ বিঘা, গোপেন কড়ার ২ বিঘা, সমারু কড়ার ২ বিঘা, মানিক কড়ার ২ বিঘা, শুনিয়া কড়ার ৫ বিঘা জমি বাঙালিরা নানাভাবে নানাসময়ে জোরজবরদস্তি করে বেদখল করেছে। একটা সময় হালজায় ও রাঙ্গন-ঝিনাইকুড়ি মৌজার প্রায় ৫২ একর (১ একর=৯৬ শতক) জমি ছিল কড়াদের। এর ভেতর অধিকাংশই কড়াদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পত্তনী জমি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে কড়াদের প্রায় ৪৫ একর জমিই জবরদখল হয়ে গেছে। কোনোমতে টিকে থাকা মাত্র ৫ একর জমি নিয়েই কড়াদের নিরন্তর সামাল দিতে হচ্ছে বাঙালি হামলা।

দেশের আদিবাসী জনগণ আজ কার্যত ভূমিহীন। রায় ও অন্যান্যরা (২০০৭) বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের উপর পরিচালিত শিক্ষা ও ভূমি বিষয়ক বেশকিছু প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, সমতল এলাকার আদিবাসীরা বিচ্ছন্ন ও বিক্ষপ্তভাবে সমতল এলাকার বিভিন্ন জেলায় বসবাস, সংখ্যালঘিষ্ঠতা এবং নানা শোষণ ও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এখনও প্রান্তিকপর্যায়ে রয়েছেন। নিজের জমির রেকর্ড রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রভাবশালীদের নজরে পড়ে উক্ত জমি জবরদস্তি দখল হচ্ছে এবং অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে জালিয়াতি করে অনেকে তাদের জমি দখল করেছে। আর এভাবে জমির মালিকানা থেকে দিন দিন আদিবাসীদের নাম মুছে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের উপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় আখতার (২০০৪) জানিয়েছেন, বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহালী, পাহান, রবিদাস, পাহাড়ি, সিং, রাজোয়ার আদিবাসীরা ক্রমান্বয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সাঁওতাল, রাজবংশী, মাহালী, কোচ আদিবাসীদের ভেতর পরিচালিত এক সমীক্ষায় কামাল (২০০০) জানিয়েছেন, অধিকাংশ আদিবাসীরাই নিজস্ব ভূমি হারিয়েছেন। প্রায় ৪২ শতাংশের কোনো জমি ও বসতভিটা নেই। উত্তরবঙ্গের সকল আদিবাসীদের জীবনই আজ ভূমিবিরোধ ও ভূসম্পদকেন্দ্রিক চূড়ান্ত সংঘর্ষের প্রান্তসীমায় টলছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন ও নীতি আদিবাসী ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে। সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী ভূমি ও জীবনের নিশ্চয়তার ওয়াদা করেছিল। কিন্তু কেন স্থানীয়ভাবে এসব দেখার কেউ নেই। বিরলের হালজায় কড়া গ্রামটি কী বাংলাদেশের বাইরের কোনো গ্রাম? এটি কী দুনিয়ার বাইরের কোনো ভূখন্ড? কীভাবে স্বাধীনতার মাসে এটি সম্ভব হয়? আশা করবো বিরলের কড়াদের গ্রামে আক্রমন ও হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে। দ্রুত আহতদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিবে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন। কড়া গ্রামের ভূমি ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে আরো সাহসী হতে হবে।

আদিবাসী কড়াদের আছে এক অরণ্য সভ্যতার অবিস্মরণীয় জ্ঞানভান্ডার। কড়ারা দেশ ও সভ্যতা বিনির্মাণে দারুণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত অধিপতি ইতিহাসে কড়াদের বিজয়গাথা লেখা হয়নি আজো। মুক্তিযোদ্ধা সাতান কড়া, থপাল কড়া কী কিনা কড়ারা আজ ভূমিহীন দিনমজুর। মাত্র দুই মাস হয়েছে বাচ্চাটার। বাবা প্রশ্ন কড়া ও মা রীতা কড়া এখনো এই বাচ্চার নাম রাখতে পারেননি। ৬ মার্চ হামলার দিনে এই অবুঝ বাচ্চাকে হামলাকারীরা হাতে তুলে নিয়ে আছড়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারা হুমকী দিয়ে গেছে যদি কড়ারা এই জায়গা জমি ছেড়ে দিয়ে চলে না যায় তবে নারী-পুরুষ, শিশু-প্রবীণ সকলকে মেরে উচ্ছেদ করা হবে। এই মুহুর্তে রাষ্ট্রকে কড়াদের পাশে দরদ ও নিরাপত্তার বলয় নিয়ে দাঁড়ানো জরুরি। এই বাঙালি জাত্যাভিমানী রাষ্ট্র কী কড়াদের আজন্ম আহাজারি টের পাওয়ার সাহস করবে?
………………………….
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক।

Back to top button