জাতীয়মতামত ও বিশ্লেষণ

বিচারহীনতার আবিমায় ব্র্যাকের ‘কমিউনিটি ট্যুরিজম-অতিথি’ কী আদৌ প্রাসঙ্গিক?

ব্র্যাকের কমিউনিটি ট্যুরিজমে মধুপুরের আদিবাসীদের অন্তুর্ভুক্তি আসলে কতটুকু?

যেখানে আদিবাসীদের ভূমির অধিকার এখনও নিশ্চিত হয়নি এবং বনবিভাগ কর্তৃক নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে মধুপুরের আদিবাসীরা সেখানে কমিউনিটি ট্যুরিজম কতটুকু প্রাসঙ্গিক?

মান্দি (গারো) আদিবাসী অধ্যুষিত মধুপুরে ব্র্যাক তাদের কমিউনিটি ট্যুরিজম প্রকল্প ‘অতিথি’-এর প্রচারণা শুরু করেছে গত ২০ মার্চ থেকে। তাদের ‘otithi-অতিথি’ নামে ফেইসবুক পেইজে ছবিসহ এই প্রকল্পের কথা জানা যায়, এছাড়াও ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্‌ নিজেও গত ২৭ মার্চ তার ফেইসবুক একাউন্টে এই পোস্ট শেয়ার করেন। 

মধুপুরের আবিমায় (পড়ুন মা-মাটি) রয়েছে ৫০টি আদিবাসী গ্রাম। এসকল গ্রামগুলোতে বাস করে মান্দি (গারো), কোচ, বর্মন আদিবাসীরা। তাদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠায় রয়েছে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। ইকোপার্ক ও ইকোট্যুরিজমের নামে আবিমার (পড়ুন মা-মাটি) আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ও অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে আত্মদান করেছেন মান্দি আদিবাসী বীর শহীদ পীরেন স্নাল ও আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বীর উৎপল নকরেক।  

২১ বছর হয়ে গেলেও ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি মধুপুরে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনে বনরক্ষীদের গুলিতে নিহত পীরেন স্নালের কোন বিচার পায়নি আবিমার আদিবাসীরা। এই বাস্তবতায়, যেখানে মধুপুরের আদিবাসীদের ভূমির অধিকার এখনও নিশ্চিত হয়নি এবং এখনও বনবিভাগ কর্তৃক নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে মধুপুরের আদিবাসীরা সেখানে কমিউনিটি ট্যুরিজম কতটুকু প্রাসঙ্গিক? সে বিষয়ে খতিয়ে দেখেছে আইপিনিউজবিডি— 

ইউনাইটেড কাউন্সিল অফ ইন্ডিজিনাস অর্গানাইজেসন্স অফ গ্রেটার ময়মনসিংহ (ইউসিজিএম) -এর সভাপতি অজয় এ মৃ-এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “আমি এই বিষয়ে ঠিক ওয়াকিবহাল নই। তবে কয়েকদিন আগে ফোনে এলাকার অনেকের সাথে যোগাযোগ হয় এব্যাপারে। তখন আমি জানতে পারি এই প্রকল্প শুরু হয়েছে এবং এইটা ব্র্যাকের। সপ্তাহ দুয়েক আগে (৩০ মার্চ, রবিবার) আমি পাশের গ্রামে গিয়েছিলাম কাজে এবং সেখানে জানতে পারি কমিউনিটির সাথে কোন ধরনের আলাপ আলোচনা হয়নি। এমনকি মধুপুরের যে মাতৃসংগঠন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ তার সাথেও ব্র্যাকের কোন ধরনের আলাপচারিতা হয়নি।” 

তিনি আরও বলেন, “আমি জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি এবং ইউনাইটেড কাউন্সিল অফ ইন্ডিজিনাস অর্গানাইজেসন্স অফ গ্রেটার ময়মনসিংহ (ইউসিজিএম) -এর সভাপতির দায়িত্বে আছি, আমার সাথেও কোনধরনের আলোচনা হয় নাই। এছাড়াও আমরা ইকোট্যুরিজম বা কমিউনিটি ট্যুরিজম আমাদের অঞ্চলে বিস্তার লাভ করুক তা চাই না এবং বরাবরই এর বিরোধিতা করে আসছি। আমাদের আদিবাসী গ্রামগুলোতে ইকোট্যুরিজম বা কমিউনিটি ট্যুরিজম ভালো কিছু বয়ে আনবে না। উল্টো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি পালনে এবং সোশ্যাল স্ট্রাকচারে তা ব্যাঘাত ঘটায়। ব্র্যাকের এই ধরনের উদ্যোগ ঠিক হয়নি।” 

আবিমায় ব্র্যাকের কমিউনিটি ট্যুরিজম উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন? — প্রশ্ন করা হলে, গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিল বলেন, “প্রথমত, সারা বিশ্বে যেভাবে ইকোট্যুরিজম বা কমিউনিটি ট্যুরিজম হয় তার তুলনায় বাংলাদেশে এর বিস্তার খুবই সামান্য। উপরন্তু, আবিমার (মধুপুর) আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসের কারণে এধরনের উদ্যোগ সত্যিকার অর্থে অপ্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয়ত, যে জায়গায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেখানের আদিবাসী কমিউনিটির সাথে কোন ধরনের আলাপ হয় নাই। ব্র্যাক হুট করেই এটা বাস্তবায়ন করেছে। এই একই জায়গায় মোল্লা সাগর নামে এক লোক সে গ্রামের বাবুল নকরেকের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে এই ধরনের হোম স্টে বা কটেজ চালাচ্ছিলেন। আমি এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করি এবং আমরা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন— বাগাছাস, গাসু, জিএসএফ মিলে সেই উদ্যোগকে থামিয়ে দেই। মূলত মোল্লা সাগরের সেই স্থাপনাটিতেই ব্র্যাক তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে শুধু কমিউনিটি ট্যুরিজম তকমা সাথে লাগিয়ে দিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা ব্র্যাকের এই উদ্যোগের সমালোচনা করি এবং এধরনের প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। আমরা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন মিলে বসছি এবং এব্যাপারে আমাদের সাংগঠনিক বিবৃতি শীঘ্রই জানাচ্ছি। আগে আবিমার আদিবাসী সন্তানদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক, তার আগে এধরনের কোন প্রকল্প আমরা মধুপুরের মাটিতে হতে দিতে পারিনা।”

তিনি জোর গলায় বলেন, “আমরা গজনী অবকাশ কেন্দ্রের কথা জানি, অবকাশ কেন্দ্রের ভেতরে যে কয়েকটি গারো পরিবার বসবাস করে তাদের কথা জানি। একবার গজনীতে আমার এক বৃদ্ধের সাথে দেখা হয়েছিল। তিনি কাঠ কাটছিলেন, তাকে জিজ্ঞেস করি— এই বৃদ্ধ বয়সে কেন সে এই কাজ করছে? তার কি ছেলে মেয়ে কেউ নেই? তিনি উত্তর দেন– কোন পর্যটকের নাকি মোবাইল হারিয়েছে আর তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে — এই হলো আমাদের প্রাপ্তি পর্যটন থেকে। আমরা সাজেকের কথা জানি, এসমস্ত জায়গায় কত শান্তিতে আদিবাসীরা থাকে! আর তাদের জীবনে কত অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে! তা আমাদের আর না বোঝালেও চলবে।” 

স্থানীয়দের একাধিক সূত্র জানায়, এই একই জায়গায় স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে  ব্যক্তিমালিকানায় ‘আবিমা আর্ট স্পেস’ — নামে একটি কটেজ/হোম স্টে চালু ছিল, যা নিয়ে স্থানীয়রা এর আগেও প্রতিবাদ করে। বর্তমানে বিতর্কিত সেই একই জায়গায় ব্রাকের এই নতুন প্রকল্প চালু হয়েছে। এবং যে স্থানে এই প্রকল্পটি চালু করা হয়েছে তার পাশে বসবাসরত পরিবারদের এবং গ্রামবাসীদের এই প্রকল্পের কারণে সমস্যা হচ্ছে।  

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ব্র্যাকের এই প্রকল্প সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না। 

মুঠোফোনে ব্র্যাকের ‘otithi-অতিথি’ এর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টার করা হলেও কোন ধরনের সাড়া পাওয়া যায়নি। 

ব্র্যাকের এই ‘otithi-অতিথি’ প্রকল্পের ওয়েবসাইটে কমিউনিটি ট্যুরিজম কীভাবে কমিউনিটিকে উপকৃত করবে সে বিষয়ে অনেক তথ্য ও বিস্তর আলাপ থাকলেও মধুপুরে বসবাসরত আদিবাসী ও আদিবাসী সংগঠনসমূহের সাথে যোগাযোগ করে দেখা যায় যে, তারা এই বিষয়ে ঠিক জানেন না। কী প্রক্রিয়ায় মধুপুরের আদিবাসীরা উপকৃত হবেন? এবং ক্ষতির তুলনায় উপকৃত হবার সম্ভাবনা কতটুকু? এসব তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এমনকি গ্রামবাসীদেরকেও যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করা হয়নি— কোন প্রকার প্রকল্প অবহতিকরণ কার্যক্রম ও অন্তর্ভুক্তির রূপরেখা নেওয়া হয়নি। তাহলে, প্রশ্ন থেকেই যায়— ব্র্যাকের কমিউনিটি ট্যুরিজমের এই প্রকল্পে মধুপুরের আদিবাসীদের অন্তুর্ভুক্তি আসলে কতটুকু? 

Back to top button