বান্দরবানে ভূমি বেদখলের অন্যতম শিকার ম্রো জনগোষ্ঠী : সংকটের মুখে তাদের জীবনজীবিকা ও আবাসভূমি: চিংলামং চাক
বান্দরবান জেলার সদর উপজেলার চিম্বুক, সুয়ালক ও টংকাবতি ইউনিয়ন, লামা উপজেলার সরই, ফাঁসিয়াখালী ও রূপসী ইউনিয়ন এবং আলিদকম-থানচি সড়কের ক্রাউডং পাহাড়ে চিরায়ত জায়গা-জমি রাবার প্লান্টেশনের নামে বহিরাগতদের কাছে ইজারা প্রদান, সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রভাবশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানী কর্তৃক ম্রো জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার ভূমি জবরদখল করা হয়েছে। চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলা থেকে লামা উপজেলায় ঢুকার পর ফাস্যাখালী ইউনিয়ন অন্তর্গত লামার মেইন রাস্তার দুই পার্শ্বে দিগন্ত বিস্তৃত এলাকায় যে রাবার বাগান চোখে পড়ে তার অধিকাংশই ছিল ম্রো জনগোষ্ঠীর জুমভূমি ও আবাসস্থল। পাইকারীভাবে ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদের ফলে তাদের বাস্তুভিটা ও আবাদী জমি সংকুচিত হয়ে পড়ছে। জীবন-জীবিকার উপর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। সীমিত হয়ে পড়েছে তাদের জীবন-জীবিকার জন্য একমাত্র অবলম্বন জুম চাষের জন্য পাহাড়ভূমি।
উল্লেখ্য যে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে ম্রো আদিবাসীদের একমাত্র জনপদ বান্দরবান পার্বত্য জেলা। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের পূর্বে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ভার্য্যাতলী মৌজায় কিছু ম্রো পরিবারের বসতি ছিল। কাপ্তাই বাঁধের কারণে উচ্ছেদ হয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় স্থানান্তরিত হয়। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুসারে বান্দরবান জেলায় ম্রো জনসংখ্যা ৩৮,০২১ জন। কিন্তু ম্রো সোসিয়েল কাউন্সিলের ভাষ্যমতে ম্রো জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি। ১৯৯৫ সালে ম্রো সোস্যাল কাউন্সিল কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে ম্রো জাতির জনসংখ্যা ৫৯,৭৪৮ জন বলে জানা যায়।
বান্দরবান পার্বত্য জেলায় জনসংখ্যা দিক দিয়ে ম্রো জনগোষ্ঠী দ্বিতীয় হলেও শিক্ষা-দীক্ষায় অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন জুমচাষ। লাঙ্গলের চাষাবাদের জমি তাদের নেই বললেই চলে। বান্দরবান সদর উপজেলা চিম্বুক পাহাড়কে কেন্দ্র করে তাদের আবাসভূমি। টংকাবতী ইউনিয়ন হচ্ছে ম্রোদের প্রধানতম আবাসভূমি। টংকাবতী ইউনিয়নে ম্রো জনগোষ্ঠী ব্যতীত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর গ্রাম মাত্র দুটি। বিশেষ মহল ও প্রভাবশালী ভূমিদুস্যুদের ষড়যন্ত্রের কারণে ম্রো আদিবাসীরা নিজস্ব আবাসভূমি হতে উচ্ছেদ হয়ে আজ তাদের অস্তিত্ব বিপন্নের পথে। চিম্বুক পাহাড় ও পার্শ্ববর্তী সুয়ালক ইউনিয়নে ম্রো আদিবাসীদের শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসা আবাসভূমি ও জুম ভূমির উপর নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র, আর্টিলারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ওয়াই জংশন সেনা ছাউনি, বন বিভাগ ও বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যত্রতত্র ভূমি বেদখলের কারণে অনেক ম্রো আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে পড়ে এবং বর্তমানেও উচ্ছেদের হুমকির মুখে তারা অনিশ্চিত ও নিরাপত্তাহীন জীবন অতিবাহিত করছে।
যে সমস্ত এলাকা থেকে ম্রোরা উচ্ছেদের শিকার
এক. ম্রো অধিবাসীরা সবচেয়ে বড় উচ্ছেদের শিকার হয়েছে বান্দরবান সদর উপজেলাধীন সুয়ালক ইউনিয়নে। ২০০০ সালে সেনাবাহিনীর আর্টিলারী (গোলন্দাজ ও পদাতিক) প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য ১৯,০০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের ফলে দেওয়াই হেডম্যান পাড়াসহ ২০টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবার ম্রো উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়েছে। জমির পরিবর্তে জমিতে পুনর্বাসন না করে ম্রো গ্রামবাসীদেরকে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। সেসময় জনসংহতি সমিতিসহ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ গ্রহণ না করার জন্য বলা হলেও সেনাবাহিনী জোর করে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করতে বাধ্য করে। সেই সাথে তৎকালীন এমপি, তৎকালীন সুয়ালক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সুয়ালক মৌজার হেডম্যানসহ সরকারের বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে পড়ে ম্রো গ্রামবাসীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ নিতে বাধ্য হয়। শত শত ম্রো পরিবার বাপ-দাদার বসতভিটা ও আবাদী জমি ফেলে অধিকতর দুর্গম টংকাবতী এলাকায় পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। ম্রোদের জায়গা কেড়ে নিয়ে বর্তমানে সেনাবাহিনী উক্ত জায়গা-জমি স্থানীয় বাঙালিদেরকে বাগান চাষ, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগী পালনের জন্য লীজ প্রদান করে থাকে। অপরদিকে সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণ চলাকালে এলোপাতাড়ি গোলা বর্ষণের আঘাতে এক ম্রো শিশুসহ অনেক ম্রো আহত হয়েছে যা জনসাধারণের স্বাভাবিক চলাচলেও এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
দুই. সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থাপিত ও পরিচালিত বান্দরবানের ‘নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র’ এর দখলে রাখা ৭৬ একর ভূমি ছিল ম্রো জনগোষ্ঠীর বাস্তুভিটা ও জুম ভূমি। এই বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্রের ফলে মারমাসহ ম্রোদের ৬টি গ্রামের কমপক্ষে ২০০ পরিবারের ১৫০০ গ্রামবাসী তাদের স্ব স্ব আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়। ম্রোদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে এবং তাদের সম্মতি ব্যতীত জোর করে এসব জমি কেড়ে নেয়া হয়। কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়া ম্রো জনগোষ্ঠীকে এলাকা ছেড়ে চলে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের কথা তো অনেক দূরে। আরও অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনী কর্তৃক রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, শপিং সেন্টার ইত্যাদি স্থাপনের জন্য চিম্বুক পাহাড়ের ডলা ম্রো পাড়া (জীবন নগর), কাপ্রু ম্রো পাড়া (নীলগিরি), চন্দ্র পাহাড় (নাইক তং), চিম্বুক ষোল মাইল, ওয়াই জংশন (১২ মাইল), রুমার কেওক্রাডং পাহাড়ের কেওক্রাডং চূড়া ইত্যাদি এলাকায় বসবাসরত হতদরিদ্র ও সার্বিকভাবে অনগ্রসর ম্রোদের বিপুল পরিমাণ জুমভূমি বেদখল করা হয়েছে। সেনাবাহিনী খুঁটি গেড়ে কথিত জীবননগর ও চন্দ্র পাহাড় এলাকায় কমপক্ষে ১,১০০ একর বিস্তৃত জুমভূমি দখল করে রেখেছে। ম্রো গ্রামবাসীদেরকে সেসমস্ত জায়গায় জুম চাষ করতে বাধা দিচ্ছে। বিশেষ করে জীবননগর নামে নামকরণ করা সেপ্রু পাড়ায় ৩ গ্রামের ১২৯টি ম্রো পরিবার উচ্ছেদ হয়ে পড়েছে।
তিন. লামা উপজেলার সাঙ্গু মৌজায় লাদেন বাহিনী কর্তৃক ২০১৫ সালে ৫০০ একরের অধিক ভূমি জবরদখলের ফলে উচ্ছেদের শিকার তিনটি আদিবাসী গ্রামের মধ্যে আমতলি ম্রো পাড়া নামে একটি ম্রো গ্রাম ছিল। উক্ত আমতলী পাড়ার ২২টি ম্রো পরিবার উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়েছে। ম্রো গ্রামবাসীরা তাদের গ্রামটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।
চার. লামা উপজেলাধীন সরই ইউনিয়নের এলাকায় ডলুছড়ি, লুলেইন ও বমু মৌজায় ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ নামে জাতীয় পর্যায়ের একটি এনজিও কর্তৃক ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আনুমানিক ২০০০ একরের মতো যে বিস্তর এলাকা জবরদখল করা হয়েছে সেসব জায়গা-জমি ছিল মূলত ম্রো গ্রামবাসীর জুম ভূমি। লামায় কোয়ান্টাম সংস্থা কর্তৃক ভূমি বেদখলের কারণে এলাকার ২৫০ পরিবার ম্রো গ্রামবাসীরা জুম চাষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়েছে।
কতিপয় স্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় অর্থের বিনিময়ে কোয়ান্টাম কর্তৃক পাহাড়িদের জমি দখল করে চলেছে। ব্যক্তি নামে জমি ক্রয় করে কোয়ান্টামের জন্য দানকবলা করে হস্তান্তর করা হয় বলে জানা যায়। তবে অবৈধভাবে ক্রয়কৃত জমির পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি জমি প্রভাব খাটিয়ে ও জোর জবরদস্তি করে দখল করা হয়েছে বলে জানা যায়। যেমন জনৈক ম্রো পরিবারের ৩.০ একর জমিসহ আরো অনেকের ভূমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এসব জায়গাজমি ক্রয় করার ক্ষেত্রে বা মালিকানা লাভের ক্ষেত্রে আইন মোতাবেক বান্দরবান জেলা পরিষদের র্প্বূানুমোদন নেয়ার বিধান মানা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা থেকে দেখতে আসা অনেক প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে কোয়ান্টাম স্কুল ও কলেজের আশেপাশে এলাকায় জায়গা ক্রয় করতে উৎসাহিত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে অতি সুক্ষ্মভাবে বহিরাগত কর্তৃক জমি দখল এবং ম্রোদেরকে তাদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হচ্ছে।
উচ্ছেদের হুমকির মুখে ম্রো গ্রামসমূহ
এক. রুমা উপজেলাধীন রুমা সেনা গ্যারিসনের ৯,৫৬০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াধীন থাকায় পলি মৌজা, গালেঙ্গা মৌজা, সেঙ্গুম মৌজা ও পানতলা মৌজার তিন শতাধিক ম্রো আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে এবং হুমকির মুখে দিনাতিপাত করছে। ১৯৭৭ সালে রুমা গ্যারিসনের জন্য পলি মৌজার ১৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এতে অনেক জুম্ম পরিবার উচ্ছেদ হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে গালেঙ্গা মৌজা, সেঙ্গুম মৌজা ও পানতলা মৌজায় আরো ৯,৫৬০ একর ভূমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যা এখনো প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে। ৯,৫৬০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হলে ৬৫৫টি আদিবাসী পরিবারের ৪,৩১৫ জন জুম্ম গ্রামবাসী স্ব স্ব জায়গা-জমি চিরতরে উচ্ছেদ হয়ে পড়বে যার মধ্যে তিন শতাধিক পরিবার হচ্ছে ম্রো গ্রামবাসী। (সূত্র: বান্দরবারে ভূমি বেদখল : দু’ হাজারের অধিক অবৈধ, চিংলামং চাক চাক, জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন নং ৩৫, ১০ নভেম্বর ২০১৫)।
দুই. লামা উপজেলাধীন সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার নতুন পাড়া, ঢেঁকিছড়া পাড়া ও নোয়া পাড়ায় লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্তৃক ইজারার নামে ১,৬০০ একর জায়গা দখলের ফলে এলাকার তিনটি গ্রামের শত শত পরিবার ম্রো গ্রামবাসী উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে। ম্রো পরিবারগুলো তাদের দীর্ঘ বৎসরের ভোগদখলীয় জুম ভূমিতে জুম কাটতে গেলে লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লি:-এর ম্যানাজার মো: আরিফ-এর নেতৃত্বে ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা জুম চাষে বাধাদান করে থাকে। ম্রো গ্রামবাসীদেরকে হত্যা ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে বলেও তারা হুমকি প্রদান করে আসছে। নতুন পাড়ার কার্বারী লাজপং ম্রো’কে লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা মারধর করে এবং ক্যজ পাড়ার পুলিশ ফাঁড়িতে তার বিরুদ্ধে আপত্তি প্রদান করে। এই ব্যাপারে জুম চাষী কাইংপ্রে ম্রো ও অন্যান্য গ্রামবাসীরা লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লি: এর বিরুদ্ধে গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখ প্রশাসনের নিকট আবেদন নিবেদন করেও কোন ধরনের সুরাহা বা প্রতিকার পায়নি।
বিগত আশি দশকে রাবার প্লান্টেশন ও হর্টিকালাচারের জন্য লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের নামে প্রতি প্লটে ২৫ একর করে ৬৪টি প্লটে মোট ১,৬০০ একর জায়গা ইজারা নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। ইজারা নেয়ার পর সেই জমিতে কোন বাগান-বাগিচা গড়ে তোলা হয়নি। গত বছর (২০১৬ সাল) থেকে ম্রো ও ত্রিপুরা অধিবাসী উচ্ছেদ করে সেই জমিতে রাবার বাগান তোলা হয়েছে বলে জানা যায়। উক্ত জমিগুলো হচ্ছে জুম্মদের প্রথাগতভাবে পরিচালিত মৌজা ভূমি ও জুম ভূমি।
তিন. আলিকদম উপজেলার আলিকদম হতে থানচি সড়কের মধ্যখানে ঐতিহ্যবাহী ক্রাউডং পাহাড়ে (সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি ভাষায় অনুবাদ করে নামকরণ করা হয় ‘ডিম পাহাড়’) ২০১৫ সালে সেনাবাহিনীর অধীনে পর্যটন কেন্দ্রে স্থাপনের জন্য প্রায় ৫০০ একর ভূমি বেদখলের কারণে ১২টি গ্রামের ২০৫ পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে। আলিকদম উপজেলার সাঙ্গু মৌজা ও তৈনফা মৌজা এবং থানচি উপজেলার নাইক্ষ্যং মৌজার প্রায় ৫০০ একর জায়গা এই পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় নেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। গত ১৪ জুলাই ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ সড়কটি উদ্বোধন করার পর বর্তমানে সেনাবাহিনী আলিকদম-থানচি সড়কের ১৯ কিলোমিটার থেকে ২৩ কিলোমিটার পর্যন্ত ক্রাউডং পাহাড়ের প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার ব্যাপী এলাকায় ‘সংরক্ষিত প্রশিক্ষণ এলাকা’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। জানা গেছে, বান্দরবান জেলার আলিকদম-থানচি মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকায় ১৫০টি পরিবারের অন্তত ৫০০ জন লোক নিরাপত্তাতার অভাবে মায়ানমারে দেশান্তরিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এক কথায় বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বিশেষ মহল ও বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমি বেদখলের কারণে অন্যান্য আদিবাসী মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, বম ও চাক আদিবাসীরাও উচ্ছেদের শিকার হলেও তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি উচ্ছেদ হয়েছে ম্রো জনগোষ্ঠী। মানবিক কারণে যেখানে ম্রো আদিবাসীদের ভূমি হারানোর বেদনা ও উচ্ছেদের যন্ত্রণা প্রশমনে সহানুভূমি ও সমবেদনা জানানোর কথা, তার বিপরীতে বিশেষ মহল ও প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিরা ম্রো আদিবাসীদের উপর ষড়যন্ত্র চাপিয়ে দিচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, লামা উপজেলার লুলেইন মৌজার ২৫০টি ম্রো পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি; লামায় জনৈক লাদেন গ্রুপ কর্তৃক ফাস্যাখালি ইউনিয়নের ৭৫টি ম্রো, ত্রিপুরা, মারমা ও স্থায়ী বাঙালি পরিবার উচ্ছেদ করে ১৭৫ একর জায়গা জবরদখল এবং আরো ২২১টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি; মুজিবুল হক গং কর্তৃক মারমা গ্রামবাসীর উপর হামলা চালিয়ে লামা উপজেলার রূপসী ইউনিয়নে প্রায় ৫০০ একর জায়গা দখলের অপচেষ্টা; আলিকদম উপজেলায় বদিউল আলম নামে জনৈক প্রভাবশালী কর্তৃক ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা পরিবারের প্রায় ১,০০০ একর রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জমি জবরদখল ইত্যাদি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যা রাষ্ট্রযন্ত্রের মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জবরদখলের ক্ষেত্রে মাৎস্যন্যায়ের অবস্থার চিত্র ফুটে উঠে।
উল্লেখ্য যে, রাবার প্লান্টেশন ও হর্টিকালচারের নামে বান্দরবান পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নয় এমন ব্যক্তির নিকট দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে হাজার হাজার একর ভূমি লীজ দেওয়া হয়েছে। লীজ গ্রহণকারীদের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নানা প্রভাবশালী গোষ্ঠী রয়েছে। লীজ প্রদত্ত ভূমির মধ্যে রয়েছে আদিবাসী জুমচাষীদের প্রথাগত জুমভূমি। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে জুম্মদের রেকর্ডীয় ও ভোগদলীয় ভূমিও রয়েছে। এর ফলে শত শত জুম্ম অধিবাসী তাদের জুম ক্ষেত্র হারিয়ে ফেলছে এবং নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে। বান্দরবান সদর, লামা, আলিকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় সমতল জেলার অধিবাসীদের নিকট সর্বমোট ১৬০৫টি রাবার প্লট ও হর্টিকালচার প্লট-এর বিপরীতে প্লটপ্রতি পঁচিশ একর করে ৪০,০৭৭ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণ এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের নামে বান্দরবান জেলায় প্রায় ৭২,০০০ একর জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অধিকন্তু রিজার্ভ ফরেস্ট গঠনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯০-১৯৯৮ সালে বিভিন্ন গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২,১৮,০০০ একর জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করে যার মধ্যে কেবলমাত্র বান্দরবান জেলায় ছিল ১,১৮,০০০ একর।
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ইজারা বাতিল ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুনর্বহাল
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে রাবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য অউপজাতীয় ও অস্থানীয় ব্যক্তিদের নিকট প্রদত্ত জমি লীজের মধ্যে যারা বিগত দশ বছরের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেন নাই বা জমি সঠিক ব্যবহার করেন নাই সেসকল জমির বন্দোবস্ত বাতিল করার বিধার রয়েছে। ২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বান্দরবান জেলায় অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ইজারার মধ্যে যে সমস্ত ভূমিতে এখনো চুক্তি মোতাবেক কোন রাবার বাগান ও উদ্যান চাষ করা হয়নি সেসমস্ত ইজারা বাতিলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তৎসময়ে বান্দরবান সদর, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় যেসব লীজ গ্রহীতাগণ বাগান সৃজন করে নাই তাদের বিষয়ে সরেজমিনে তদন্তক্রমে প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে বাগান সৃজিত না করে চুক্তি পত্রের শর্ত লঙ্ঘিত করার কারণে ৫৯৩টি প্লট বাতিল করা হয়।
কিন্তু বান্দরবান পার্বত্য জেলা প্রশাসন দুর্নীতির মাধ্যমে ও নিরাপত্তা বাহিনী যোগসাজশে লীজ বাতিলের দু’ মাসের মাথায় বাতিলকৃত প্লটগুলোর মধ্যে অধিকাংশ প্লট পুনরায় বহাল করা হয়। অন্যদিকে অবশিষ্ট প্লট কাগজে কলমে বাতিল করা হলেও উক্ত ভূমি প্লট মালিকদের দখলে রয়েছে। পক্ষান্তরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া, ভূমি কমিশন আইন সংশোধন না হওয়া, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া এবং পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী লীজ বাতিল না হওয়ার কারণে অস্থানীয় ও বহিরাগত বাঙালিরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ও যোগসাজসে ইজারা ভূমির নামে হাজার হাজার একর ভূমি জবরদখল করে চলেছে এবং উক্ত জায়গা-জমি থেকে জুম্মদের চলে যেতে হুমকি দিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় ভাড়াটিয়া বহিরাগত বাঙালি শ্রমিকদের লেলিয়ে দিয়ে জুম্ম গ্রামবাসীর উপর হামলাও চালিয়েছে। ফলত আদিবাসী ম্রো গ্রামবাসীসহ জুম্মরা শংকিত ও উদ্বিগ্নাবস্থায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ
বান্দরবান জেলায় পাইকারীভাবে ভূমি জবরদখল এবং একের পর এক জুম্ম গ্রাম উচ্ছেদের প্রেক্ষিতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বান্দরবান জেলা শহরে রাজার মাঠে এক বিশাল ভূমি অধিকার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অন্যান্যের মধ্যে চিম্বুক, সুয়ালক, টংকাবতী ইত্যাদি এলাকা থেকে শত শত ম্রো জনগোষ্ঠীর লোক অংশগ্রহণ করে। সমাবেশে বিশেষ করে ম্রো অধ্যুষিত এলাকায় পাইকারীভাবে ভূমি জবরদখল এবং ভূমি থেকে ম্রোদের উচ্ছেদের কথা উত্থাপিত হয়। ২০০৪ সালে চিম্বুক পাহাড়ে বন বিভাগের ইকো-পার্ক স্থাপন ও সেনাবাহিনী নিরাপত্তা বেষ্টনীর নামে ব্যাপক এলাকা চিহ্ন দিয়ে দখল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই এলাকায় কমপক্ষে ২৫০ ম্রো পরিবারকে জুমচাষে বাধা প্রদান করতে থাকে বন বিভাগ ও সেনাবাহিনী। তারই প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ২০০৬ জনসংহতি সমিতির সহযোগিতায় চিম্বুক এলাকায় ম্রোদের এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশের প্রাক্কালে ম্রো গ্রামবাসী কর্তৃক টাঙানো কমপক্ষে ১০টি ব্যানার সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। ম্রো অধিবাসীসহ স্থানীয় জুম্ম জনগণের প্রবল প্রতিবাদের মুখে ইকো-পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে বন বিভাগ সরে গেলেও নিরাপত্তা বেষ্টনীর নামে শত শত একর ম্রোদের জুমভূমি সেনাবাহিনী এখনো দখল করে রেখেছে।
জরুরী অবস্থার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান তথা জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে টংকাবতী এলাকায় ম্রো জনগোষ্ঠী নিয়ে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কয়েক বার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি (বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী) রাশেদ খান মেমন, জাসদের সভাপতি (বর্তমানে তথ্য মন্ত্রী) হাসানুল হক ইনু, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যোগ দিয়েছিলেন। এসব সমাবেশে ভূমি জবরদখলকারীদের প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে ম্রো গ্রামবাসী শপথ নিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে বান্দরবান জেলা প্রশাসক, আলিকদম সেনা জোন, আলিকদম উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রমুখ সিভিল ও সামরিক প্রশাসনের ছত্রছায়ায় আলিকদম উপজেলায় বদিউল আলম নামে জনৈক প্রভাবশালী কর্তৃক ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা পরিবারের প্রায় ১,০০০ একর রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জমি জবরদখলের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেও কোন প্রতিবিধান না পেলে বদিউল আলম গং-এর ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে অন্যান্য জনগোষ্ঠীসহ ম্রো গ্রামবাসীরা সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ করতে থাকে এবং একপর্যায়ে বদিউল আলম গং কর্তৃক ভূমি জবরদখল কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। সেসময় ম্রো জনগোষ্ঠীর ভূমি রক্ষায় ক্ষমতাসীন স্থানীয় নেতৃত্বের কেউ এগিয়ে আসেনি।
অপরদিকে ফাস্যাখালী ইউনিয়নের সাঙ্গু মৌজায় মো: আনিসুর রহমান ওরফে লাদেন-এর নেতৃত্বে কথিত লাদেন গ্রুপ কর্তৃক, সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজায় লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্তৃক এবং ডলুছড়ি, লুলেইন ও বমু মৌজায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃক ম্রো অধ্যুষিত এলাকার হাজার হাজার একর জমি জবরদখলের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করেও ম্রোরা কোন সুবিচার পায়নি। সর্বশেষ গত ২১ মে ২০১৪ এই ভূমি আগ্রাসনের প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন মৌজার বিভিন্ন গ্রামের ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা ২৭০ জন স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ স্থানীয় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে অনুলিপি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে প্রেরণ করে। কিন্তু আজ অবধি সরকার ভূমি বেদখলকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, ক্ষমতাসীন স্থানীয় নেতৃত্ব ভূমি বেদখলকারীদের পক্ষাবলম্বন করে ভূমি বেদখলের শিকার জুম্ম জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে হয়রানি করে থাকে।
যেমন গত ২৯ মে ২০১৫ লামা উপজেলায় পাঁচ জুম্ম গ্রামে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে আদিবাসী ম্রো ও মারমা গ্রামবাসীরা বাধা দিলে তখন গাজী রাবার প্লান্টেশনের শ্রমিকরা জুম্মদের উপর হামলা করে। ঘটনার পরবর্তীতে কোম্পানী উল্টো জুম্মদের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে এবং তারই প্রেক্ষিতে ৩০ মে ২০১৫ লামা উপজেলার রূপসী ইউনিয়নের রূপসী পুরাতন পাড়ার কার্বারী (গ্রাম প্রধান) কই হ্লা চিং মারমাকে আটক করা হয়। রূপসী পুরাতন মারমা পাড়ায় ৩০ পরিবার, চিং কুং ম্রো পাড়ায় ৩০ পরিবার, কোনাউ ম্রো পাড়ায় ২৫ পরিবার, নোয়া মারমা পাড়ায় ১৫ পরিবার এবং সদর উপজেলাধীন সিং কুং মারমা পাড়ায় ১৫ পরিবার তাদের চিরায়ত বসতভিটা ও ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্কে বসবাস করছে। একই কারণে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বান্দরবান জেলাধীন আলিকদম উপজেলার আলিকদম ইউনিয়নে পুঁজিখাল মংপাইং খয় কার্বারী পাড়ায় কার্বারীর ছেলে টোটুল ম্রোকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে বেদম মারধর করেছে আলিকদম জোনের সেনাসদস্যরা। আরো জানা যায় যে, গত ২১ মার্চ ২০১৭ আলিকদম জোন আওয়াধীন লামা চম্পাতলী সেনা ক্যাম্পের সেনারা লুলাইন মৌজার হেডম্যান শিংপাত ম্রোকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তিনি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এভাবেই আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন স্থানীয় নেতৃত্ব গোড়া থেকেই অবৈধ ইজারাদার ও ভূমিদস্যুদের রক্ষায় উঠেপড়ে লেগেছে।
একই কারণে গত ৬ মে ২০১৭ বান্দরবান জেলার লামায় বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাহাড়িদের ভূমি বেদখল ও আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদের অভিযোগ বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত এবং তথ্য সংগ্রহ করতে ঐক্যন্যাপের সভাপতি ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও নোমান আহমেদ খানের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে আগত একটি নাগরিক প্রতিনিধিদলকে সেনাবাহিনী কর্তৃক লামা ও বান্দরবান সদরে ঢুকতে দেয়নি। ম্রো জনগোষ্ঠীসহ লামায় জুম্মদের তাদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ ও ভূমি জবরদখলের ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই নাগরিক প্রতিনিধিদলকে বান্দরবানে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছিল বলে বলা যায়। এমনকি বহিরাগত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিশেষত ম্রো জনগোষ্ঠীর ভূমি বেদখল ও পাহাড়ি গ্রাম উচ্ছেদকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলকে দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন স্থানীয় নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় সেটেলার বাঙালি এবং সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল কতিপয় ম্রো কর্তৃক এক অবরোধের নাটক করা হয়েছিল। ম্রোদের বর্তমান অবস্থা পরিদর্শনে আসা ঢাকার নাগরিক প্রতিনিধিদলকে ম্রো গ্রামবাসীরাই তাড়িয়ে দিয়েছে বলে স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষের মদদে এই সুবিধাবাদী কায়েমী গোষ্ঠী অপপ্রচার করেছে। অপরদিকে নাগরিক প্রতিনিধিদলকে বাধাদানের বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিবাদে ঝড় উঠলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সেনাবাহিনী জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পৃক্ত ম্রো সদস্যসহ ম্রোদের ভূমি অধিকার নিয়ে সোচ্চার ম্রোদেরকে আলিকদম জোনে ডেকে নিয়ে নানা ধরনের হুমকি ও হয়রানি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
শুধু তাই নয়, এসব অপকর্ম ধামাচাপা দিতে এবং ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে গত ৩ মে ২০১৭ বান্দরবান সদরে এবং তার পরে গত ৮ মে ২০১৭ লামায় জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মদদে আলিকদম মুরুং কল্যাণ সংসদের নামে তথাকথিত মুরুং বাহিনীর কম্যান্ডার মেনদন ম্রো ও কথিত মুরুং কমপ্লেক্সের পরিচালক ইয়াংলক ম্রো নেতৃত্বে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত করা হয়েছে। সাধারণ ম্রো জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ম্রো যুব সমাজ সেনাবাহিনী তথা শাসকশ্রেণির এই চক্রান্তকে ঘৃনাভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ম্রোদের প্রতি এতই যদি দরদ থাকে তাহলে কেন ম্রোদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি উদ্ধার করে দিচ্ছেন না বা বেদখলের মুখে থাকা জায়গা-জমি রক্ষা করে দিচ্ছেন না- সেনা কর্তৃপক্ষের মুখে এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে ম্রো যুবকরা, যা সেনা কর্তৃপক্ষ কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।
এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন ম্রো জাতি একদিকে ব্যাপক ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে শাসক মহলের কায়েমী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে চরম সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে তাদের জীবন-জীবিকার অস্তিত্ব ও আবাসভূমি। তাই শাসকমহলের যারা ম্রো জনগোষ্ঠীর ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের প্রক্রিয়া মদদ দিচ্ছে এবং শাসকশ্রেণির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে যারা দালালি করে ম্রো জনগোষ্ঠীসহ জুম্মদের ক্ষতিসাধন ও বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করছে, তাদের সম্পর্কে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়ানোর জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিশেষ করে সচেতন শিক্ষিত ম্রো যুব সমাজকে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিপন্ন ম্রো জনগোষ্ঠীর ভূমি ও জীবন-জীবিকার অধিকার সুরক্ষায় ম্রো জনগোষ্ঠীসহ ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের শিকার সকল পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং সেই সাথে দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল নাগরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে আরো জোরালো ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি ম্রোদের ভূমি সমস্যা নিরসনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এবং অবৈধ লীজ বাতিল করার জন্য সরকারকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
চিংলা মং চাক; সদস্য, কার্যকরী কমিটি, আদিবাসী ফোরাম।