জাতীয়

ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

আইপিনিউজ ডেস্ক (ঢাকা):  আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৫- উপলক্ষ্যে গত ১১ আগস্ট, ২০২৫ বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক কর্তৃক ঢাকাস্থ আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য হ্লাম্রাচিং চৌধুরী রনির সঞ্চালনায় এবং সহ-সভাপতি লালসা চাকমা’র সভাপতিত্বে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির, দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক আবু সাঈদ খান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসী ও নেটওয়ার্কিং পরিচালক জনা গোস্বামী, সিভিক এনগেজমেন্ট ফান্ডের নাগরিকতা প্রজেক্টের ডেপুটি টীম লিডার ক্যাথরিনা কুনিগ এবং বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সহ-সাধারণ সম্পাদক হেলেনা তালাং হিরামন প্রমুখ। সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ইয়ুৎ এন্ড সোশ্যাল কোহেসন প্রোগ্রামের প্রধান ওয়াসির রহমান তন্ময়।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ইয়ুৎ এন্ড সোশ্যাল কোহেসন প্রোগ্রামের প্রধান ওয়াসিউর রহমান তন্ময় সবাইকে আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আদিবাসী নারীসহ প্রান্তিক আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যহত থাকবে।

শুভেচ্ছা বক্তব্যের পরে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সহ-সাধারণ সম্পাদক হেলেনা তালাং হিরামন বলেন, সিলেটের খারিয়া আদিবাসী এবং পাত্র আদিবাসীদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতিনীতি, সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া। আজকের আদিবাসী দিবসের যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলা হয়েছে সে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগের মাধ্যমেই কেবল আদিবাসীদের এ হারিয়ে যাওয়া ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতিনীতি, সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক ও যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে।

দৈনিক আমাদের সময়-এর সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আদিবাসী জনগোষ্টীদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করা জরুরী। কেননা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে তথ্যগুলো উপস্থাপন করে সেগুলো মানুষের দেওয়া ডাটাসেটগুলো থেকে সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে আদিবাসীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন জরুরী। এবং এক্ষেত্রে সকলকে আরো অধিক সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুধুমাত্র আদিবাসীদের কাছেই রয়ে গেছে। এ সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য সংখ্যাগরিষ্ট মানুষদের সম্পৃক্ত করে আন্দোলন পরিচালনা করে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, পাহাড় এবং সমতলের মানুষের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচীতে আদিবাসীদের অধিকারের লড়াইটি এখনো অনুপস্থিত। তথাপি আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে আরো বেগবান করতে হলে আদিবাসীদেরকে মূল ধারার সাথে যুক্ত হয়ে লড়াই চালিয়ে নিতে হবে। আদিবাসী-বাঙালী, সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সমন্বয়ের মাধ্যমেই কেবল আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন বেগবান হবে বলেও তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।

সিভিক এনগেজমেন্ট ফান্ডের নাগরিক প্রজেক্টের ডেপুটি টীম লিডার ক্যাথরিনা কুনিগ সবাইকে আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ অনেককিছুই নির্ধারণ করে দিতে ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আরো কিভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায় সে জন্য সকলকে মিলে কাজ করে যেতে হবে। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রান্তিক আদিবাসীদেরকে কিভাবে আরো অন্তর্ভূক্ত করা যায় তার জন্য কাজ করে যেতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসী ও নেটওয়ার্কিং পরিচালক জনা গোস্বামী বলেন, আদিবাসী নারীরা একদিকে আদিবাসী হিসেবে প্রান্তিক অন্যদিকে নারী হিসেবে আরো বেশী প্রান্তিক। এখন এ প্রান্তিক আদিবাসী নারীদের সংগ্রামকে তুলে ধরা এবং স্বীকৃতি দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা আরো অধিক আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদেরকে প্রতিনিয়ত নিজভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আদিবাসী নারীরা আরো বেশী সহিংসতার শিকার। তিনি আরো বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনে আদিবাসী নারী যুক্ত করা হলেও ঐক্যমত্য কমিশনের আলোচনায় নারী এবং আদিবাসীদের কথা উঠে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও আদিবাসী নারীর ভূমিকা রয়েছে। কাঁকন বিবিসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারীরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, সম্প্রদায় ও লিঙ্গসহ সকলকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী নারী সমাজ বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কায়দায় বৈষম্যের শিকার হয়। তারা নারী হিসেবে, আদিবাসী হিসেবে, আদিবাসী নারী হিসেবে, এবং দরিদ্র নারী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হয়। তিনি বলেন, নারী শুধুমাত্র ভূমি, কৃষি, নদী, বন, পাহাড় পর্বত রক্ষা নয় বরং সন্তান পালন, পরিবার সামলানোসহ ঐতিহ্য-সংস্কৃতি লালন ও সংরক্ষণে অতুলনীয় অবদান রাখে। তাদের এ অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। তিনি বলেন, আজকে পুরুষেরা যদি নারীদের অবদানকে স্বীকার করে মানুষের মর্যাদা দিতো তাহলে আলাদা করে নারীদের বিষয়ে কথা বলতে হতো না। তিনি এ প্রবল প্রতিপত্তিশালী পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে এখনো অবধি আদিবাসী গারো এবং খাসিয়া জনগোষ্ঠীরা যে নারীদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছে তার প্রশংসা করেন। তিনি আরো বলেন, ধন-সম্পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে, সামাজিক বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। আদিবাসী নারীদের সংগঠনগুলোকে আরো অধিক আকারে শক্তিশালী করতে হবে। বৃহত্তর বাঙালী সমাজকে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আরো বেশী সম্পৃক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে মূল ধারার বাঙালী বন্ধুসহ সকল প্রগতিশীল মানুষদের আরো বেশী এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বলেন, আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি আমাদের মন থেকে উপলব্দি করতে হবে। নারী, পুরষ, আদিবাসী, বাঙালী এ বৈচিত্র্যতাকে স্বীকার করে আমাদের সামনে আগাতে হবে। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস পালন করতে সমস্যা কোথায়? আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলছি কিন্তু আমরা বিজ্ঞান শিক্ষায় কতটুকু এগিয়ে গিয়েছি তাও বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র নারীরা কেন আন্দোলন করবে, পুরুষদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। সকল প্রকার প্রতিবন্ধতাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আমরা যেন পরস্পরের হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তার চেষ্টা করে যেতে হবে বলেও সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

মানবাধিকার কর্মী ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির সবাইকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, সরকার জাতিসংঘের অনেকগুলো দিবস পালন করলেও আদিবাসী দিবস পালন করতে পারে না। অন্যান্য কনভেনশনগুলোতে অনুস্বাক্ষর করলেও আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি যে কনভেনশনের রয়েছে সে আইএলও ১০৭-এ অনুস্বাক্ষর করেনি। তিনি বলেন, রাষ্ট্র বহুত্ববাদকে ভয় পায়। তারা আদিবাসী নারীদেরকে ভয় পায়। আদিবাসীদের একতাকে ভয় পায়। সেজন্য তারা কেবল এক ধর্ম, এক ভাষা, এক জাতির রাষ্ট্র চায়। কিন্তু বৈচিত্র্যতাকে অস্বীকার করে কি রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারবে? তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের আগে এবং জুলাই পরবর্তী সময়েও রাষ্ট্র আদিবাসীদেরকে স্বীকৃতি দেয়নি। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখন অবধি চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম ঠিকমতো আগাচ্ছে না। ভূমি কমিশন স্থবির হয়ে আছে। তিনি আদিবাসীদের সুরক্ষা করার জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠন করার কথা বলেন যেখানে আদিবাসী নারীদেরও স্থান থাকবে।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি লালসা চাকমা তার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা মনে করেছিলাম রাষ্ট্র আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে। বিশেষ করে যে তরুণ প্রজন্ম জুলাই অভ্যুত্থানকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো তারা সে সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু অভ্যুত্থানের এক বছর পরে এসে আদিবাসীদের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে রাখা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়ও আদিবাসীদেরকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ বিষয়গুলোকে আরো সতর্কতার সহিত দেখতে হবে বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।

সভাপতির সমাপনী বক্তব্যের পরে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন আদিবাসী নারী গানের দল এফ মাইনর, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক দল আরফি, ত্রিপুরা, ওরাঁও, বম, খাসি, গারো সাংস্কৃতিক দল ও অন্যান্য আদিবাসী শিল্পীবৃন্দ।

Back to top button