সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশে আদিবাসী দিবস উদযাপনের অর্থবহ তাৎপর্য রয়েছে: একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মংসানু

৯ই আগস্ট, জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস, ২০২৩ উপলক্ষ্যে আইপিনিউজ এর পক্ষ থেকে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী-র নিকট থেকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আইপিনিউজের বিশেষ প্রতিনিধি সুলভ চাকমা। নীচে সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ আইপিনিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।

আইপিনিউজ: আপনাকে নমষ্কার। আইপিনিউজের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।

মংসানু চৌধুরীঃ
আপনাদেরকেও শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

আইপিনিউজ: আপনার শৈশব কোথায় এবং কীভাবে কেটেছে? আপনার শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন সম্পর্কে বলুন।

মংসানু চৌধুরীঃ
আমার শৈশব কেটেছে রামগড়ে ও মহালছড়িতে। মহালছড়ির সিঙ্গিনালা এম.ই. স্কুল থেকে ৬ষ্ট শ্রেণি পাশ করে ১৯৫৮ সনে রাঙ্গামাটি সরকারী বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯৬২ সনে সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (আজকের সময়ের এস.এস.সি) করি। তারপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করি যথাক্রমে ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সনে। ১৯৭৩ সনে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দিই। এরপর বিভিন্ন সময়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, সন্দ্বীপ, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, হাতিয়া সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছি। সর্বশেষ চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজ থেকে ২০০৪ সনের ৩১ ডিসেম্বর প্রফেসর পদে থেকে অবসর গ্রহণ করি।

আইপিনিউজ: একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার সার্বিক মান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

মংসানু চৌধুরীঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার মান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনাও এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ও জন-বৈচিত্রের নিরিখে ত্রুটিপূর্ণ। কোন অঞ্চলের শিক্ষার মানোন্ন্নয়নের জন্য ঐ অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যসূচক দিকগুলো বিবেচনায় আনা জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা রয়েছে তা পুরোপুরি বাংলাদেশের মূলধারার জনগোষ্ঠীর চতুর্পাাশ্বস্থ পরিবেশের চাহিদাকে অবলম্বন করে দাঁড় করানো হয়েছে। যে কারণে এ অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা তাদের ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের কারণে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থাপনা থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করতে পারছে না।

অন্যদিকে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে এখানকার অ-বাংলাভাষী শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা না বোঝার কারণে বিদ্যালয়ের পাঠ কাঙ্খিত মাত্রায় অনুসরণ করতে পারে না। বিদ্যালয়ে স্ব স্ব মাতৃভাষায় বিদ্যাভাসেরও কোন সুযোগ নেই। আবার প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যে পাঠক্রম অনুসরণ করা হয় তা মূলধারার জনগোষ্ঠীর জাগতিক, অধ্যাত্ম ও মননের চাহিদাকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয়ভাবে বলবৎকৃত পাঠক্রম, যেখানে সংখ্যাস্বল্প জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারার কোন প্রতিফলন নেই, অনুসরণ করে প্রস্তুতকৃত পাঠ্যবইসমূহ এখানকার অ-বাংলাভাষী শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন আকর্ষণ তৈরি করতে পারে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষায়াতনগুলোতে অনুসৃত শিক্ষাপঞ্জীতে পাহাড়ের ঋতুভিত্তিক কৃষিকাজ ও স্থানীয় লোকজঃ সামাজিক অনুষ্ঠান/পার্বনাদির জন্য কোন ছুটি না থাকায় এ সময়গুলোতে বিদ্যালয়ে পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের অনুপস্থিতির হার বেশি থাকে। তদুপরি এ অঞ্চলের দুর্গম যাতায়াতব্যবস্থা, মাঠ পর্যায়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম মনিটরিংএর অপ্রতুলতা/অনুপস্থিতি, কর্মস্থলে আবাসনের অভাব ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির অসচেতনার কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এতে শ্রেণি পাঠে বিঘ্ন ঘটে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে যে, ‘শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা এবং দেশের মূলধারার জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক আকাঙ্খাকে ধারন করে এমন একটি শিক্ষা কারিকুলাম বা পাঠক্রম প্রণীত হবে।’ এর ফলে জাতীয় শিক্ষানীতি দেশের প্রকৃত বহুত্ববাদী চরিত্রের স্বরূপ ও চাহিদা ধারনে পুরোপুরি সফল হতে পারে নি। একমুখী জাতীয় শিক্ষানীতির কারণে ভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের আত্মিক ও মননের উপযোগী শিক্ষাক্রম অনুসারে শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত থাকে। এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার মানের উপর।

সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার যে প্রশাসনিক কাঠামো তা দেশের বিশেষ করে সমতল অঞ্চলের প্রয়োজনকে মাথায় রেখে দাঁড় করানো হয়েছে। এ প্রশাসনিক কাঠামো পার্বত্য অঞ্চল ও এর জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রময়তা ও পারিপাশ্বিকতার অনিবার্য গুরুত্ব ও প্রয়োজনকে ধারন করতে সক্ষম হয় নি। তাই এখানকার শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে স্থানীয় প্রয়োজনের আলোকে বিন্যস্ত করা জরুরি।

এসব কিছুকে বিবেচনায় নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং একটি কার্যকরী শিক্ষা ব্যবস্থাপনা দাঁড় করানোর উপযোগী কৌশলপত্র প্রণয়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আইপিনিউজ: ৯ই আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রেক্ষাপটে দিবসটি উদযাপনের তাৎপর্য কি?

মংসানু চৌধুরীঃ
বাংলাদেশে আদিবাসী দিবস উদযাপনের অর্থবহ তাৎপর্য রয়েছে। কারণ ১৯৭২ সনের ২২ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে আদিবাসী ও ট্রাইবাল কনভেনশন ১০৭ অনুসমর্থন করেছিল। আদিবাসী ও ট্রাইবালদের এই সার্বিক উন্নয়ন তখনই নিশ্চিত করা যাবে যখন আদিবাসী ও ট্রাইবালদের উন্নয়নে একটি কার্যকরী কাঠামো দাঁড় করানোসহ তার জন্য একটি অর্থবহ সংলাপ ও আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। তদুপরি, শেষোক্ত জাতিগোষ্ঠীর অগ্রগতির স্বার্থে তাদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সমতার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। তবে, রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ ও নীতিনির্ধারক মহল দেশের আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর অভিপ্সা পূরণে এখনও যথেষ্ট সংবেদনশীল নয়, সেই কারণে দেশে আদিবাসী দিবস উদযাপনের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

আইপিনিউজ: এবছর আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য “Indigenous Youth as Agents of Change for Self-determination”। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর মূলসুর নির্ধারণ করেছে “আত্মিনয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি” । এবছরের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্যটি বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রেক্ষাপটে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

মংসানু চৌধুরীঃ
‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ বা পরিবর্তনের এজেন্ট হিসেবে সারা পৃথিবীতে তরুণরাই বরাবর অগ্রবাহিনী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। তারুণ্যের সম্মিলিত অগ্রাভিযানের মুখে কোন শক্তিই শেষাবধি টিকে থাকতে পারে নি। সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকার জগদ্দল পাথর তারুণ্যের অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে।

আজকে বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে, তার ভিত্তি তো দেশের তরুণ ও যুব সমাজই নির্মাণ করে দিয়েছে।

তৎকালীন স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর নির্বাচন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ৭ দফা আন্দোলন এবং সর্বশেষ ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থানে এদেশের ছাত্ররাই অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। তারাই প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের ভিত গড়ে দিয়েছিল। তরুণরা যে অসাধ্য সাধন করতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসে তার ভুরি ভুরি নজির রয়েছে।

অনুরূপভাবে, বাংলাদেশে আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার (United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples বা আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র এর ৪৬ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে) এর আন্দোলনে আদিবাসীরা তরুণরাই মূল ও সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

আইপিনিউজ: এখনো এদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় নি। এ প্রেক্ষিতে আপনার মন্তব্য কী?

মংসানু চৌধুরীঃ
আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিটি কোনরূপ আন্দোলন ছাড়া পূরণ হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, সরকার দেশে আদিবাসী আছে বলেই স্বীকার করে না।

আইপিনিউজ: বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক বাস্তবতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন আছে বলে মনে করেন?

মংসানু চৌধুরীঃ
দেশের চলমান প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও মানবাধিকারের অবস্থা খুব যে ভাল তা কিন্তু নয়। দেশের সর্বত্র বাক্ স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতা সংকুচিত। এ ধরনের আবহে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভাল থাকতে পারে না।

আইপিনিউজ: বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কি কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে? বাংলাদেশের আদিবাসীদের মৌলিক সমস্যা গুলো কি কি? এসকল সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রের করণীয় কি হতে পারে?

মংসানু চৌধুরীঃ
অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপরাপর নাগরিকেরা যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন, আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদেরকেও একই ধরনের প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হয়। তাছাড়াও দেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী হিসেবে এরা বরাবরই ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকে। ফলে বৃহৎ প্রতিবেশীদের দ্বারা তাদেরকে প্রতিনিয়তই শোষন, বঞ্চনার শিকার হতে হয়। পূঁজিবাদী সমাজ কাঠামোতে সংখ্যালঘু হওয়াটা একটা অভিশাপ।

একটি জাতিগোষ্ঠী সংখ্যায় যতই ছোট হোক, তাদেরও যে নিজস্ব সমাজব্যবস্থা রয়েছে, আশা-আকাঙ্খা রয়েছে, বৃহৎ প্রতিবেশীর ন্যায় তাদের নিজেদের মতো করে বসবাসের অধিকার রয়েছে, তা সরকারকে মানতে হবে এবং আদিবাসী ও ট্রাইবালদের স্বতন্ত্র সত্তাকে সংরক্ষণ করে তাদেরকে বেঁচে থাকার সুযোগ দানের জন্য সরকারকে বহুত্ববাদী আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আইপিনিউজ: এদেশের আদিবাসীদের সংগ্রামে কি কি অর্জন রয়েছে?

মংসানু চৌধুরীঃ
আদিবাসীদের সংগ্রামের ফলে দেশের সংবিধানে একটি নতুন অনুচ্ছেদ ২৩(ক)সংযুক্ত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি, জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা হবে। আদিবাসীদের সংগ্রামের অর্জন শুধু এটুকুই।

আইপিনিউজ: ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো পূর্ণাঙ্গ রুপে বাস্তবায়িত হয় নি বলে চুক্তি স্বাক্ষরকারী একটি পক্ষের অভিযোগ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কোন কোন বিষয়গুলি এখনো বাস্তবায়ন হয় নি? চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত?

মংসানু চৌধুরীঃ
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (এরপর থেকে কেবল ‘চুক্তি’ হিসেবে উল্লেখিত হবে) ১৯৯৭ অনুসারে যে সব বিষয় পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে হস্তান্তরিত হওয়ার কথা তার মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনও হস্তান্তরিত হয় নি। চুক্তির অভিপ্রায় অনুসারে সীমিত স্ব-শাসিত জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। যেমন,

(ক) চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ‘‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল ” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ এখনও পর্যন্ত গৃহীত হয় নি। উপরন্তু, প্রতিনিয়ত প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার লঙ্ঘন করে অবিরাম বহিরাগতদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে, তাদের কাছে জমি বন্দোবস্তি দেয়া হচ্ছে।

(খ) এখনও সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), বন, পরিবেশ জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয় নি। ফলে, ৩ জেলা পরিষদ ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। এগুলো পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ‘পোস্ট বক্স’ ছাড়া আর কিছু নয়।

(গ) আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহে এখনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচনী বিধিমালা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের অন্তর্ভূক্তিতে নির্বাচনের জন্য একটি ভোটার তালিকা এখনও প্রণয়ন করা হয় নি। বর্তমানে জেলা পরিষদসমূহ ক্ষমতাসীন দলের দলীয় কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এতে এগুলো ক্ষমতাসীন দলের দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রকারান্তরে এগুলো ক্ষমতাসীন দলের দলীয় কর্মীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে।

(ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা হচ্ছে ভূমি-বিরোধ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিধান অনুসারে একটি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হয়েছে। অনেক টালবাহার পর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আইনটিও চুড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখনও একটি ভূমি সমস্যারও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে ভূমি কমিশন কোন সভায় মিলিত হতে পারছে না সেটেলার বাঙালিদের সংগঠন কর্তৃক সৃষ্ট হরতাল, অবরোধসহ নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে। কিন্তু একটি সরকারি কমিশন এক শ্রেণির মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বাধার কারণে সভায় মিলিত হতে পারবে না, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই কমিশন নির্ধারিত সভায় মিলিত হতে পারছে না।

(ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের তাদের নিজস্ব জমি ও বাস্তুভিটায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এখনও ঝুলে আছে। বাঙালি সেটেলার পরিবারেরা বিগত ৪০ বছর ধরে সরকারি রেশন পেয়ে চলেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারেরা এখনও সরকারের তরফ থেকে এক দানা চাউলও সাহায্য হিসেবে পায় নি। ফলে এসব উদ্বাস্তু পরিবারেরা পরের জায়গা-জমিতে মানবেতর জীবন যাপন করে চলেছে।
(চ) চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো পর্যায়ক্রমে গুটিয়ে আনা হবে। কিন্তু ক্যাম্পগুলোর সিংহভাগ এখনও যথাস্থানে বহাল রয়েছে। বরঞ্চ এযাবৎ পর্যন্ত গুটানো ক্যাম্পগুলির কোন কোনটি আবার পুনর্বহাল করার উদ্যোগ চলমান রয়েছে।

(ছ) চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বহিরাগতদের কাছ দেয়া জমির লীজ এখনও বাতিল করা হয় নি।

(জ) সরকারি/স্বায়ত্বশাসিত/আধা-স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমুহে নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। পরিবর্তে বহিরাগতরাই অগ্রাধিকার পেয়ে চলেছে।

(ঞ) পার্বত্য চট্টগ্রাম সংস্লিষ্ট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনসমূহ চুক্তি অনুযায়ী এখনও সংশোধিত হয় নি। অনুরূপভাবে, ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারের ‘চার্টার অব ডিউটিজ’ এরও সংশোধন হয় নি।

(ঝ) প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাঙালি সেটেলার পরিবারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে যদি আন্তরিক হন তাহলে কালবিলম্ব না করে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ (স্থানীয়) জেলা পরিষদসমুহে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হস্তান্তর করা জরুরি।

আইপিনিউজ: পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মংসানু চৌধুরীঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেও ভাল নেই। এর চাইতে চুক্তিপূর্ব সময়টাই তুলনামূলকভাবে ভাল ছিল বলা চলে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’এর আওতায় এক ধরনের সেনা শাসন চলছে যা সমতলে দৃশ্যমান নয়। চুক্তি অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে আনার কথা থাকলেও বাস্তবে প্রায় তিন-চতর্থাংশ ক্যাম্প এখনও রয়ে গেছে। বরঞ্চ গুটিয়ে নেওয়া ক্যাম্পগুলোকে পুনস্থাপনের উদ্যোগ চলতে দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাচলের স্বাধীনতা আছে সেটা বলা যাবে না। কারণ রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রচুর চেকপোস্ট রয়েছে যেখানে তল্লাশি ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।

এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে কতিপয় সশস্ত্র গ্রুপের উত্থান ঘটেছে যাদের কার্যক্রম দীর্ঘকাল ধরে চলতে দেখা যায়। এলাকায় থেকে থেকে সেনা অপারেশন চলে কিন্তু এদের কার্যক্রম বন্ধ হতে দেখা যায়না। মাঝখানে নিরীহ গ্রামবাসীর ভোগান্তি বাড়ে। সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’এর মতো সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে আন্ত-সংঘাতের ফলে এ অঞ্চল আরও অস্থিতিশীল ও নাজুক হয়ে আছে। এছাড়াও এরা প্রতিনিয়ত জনগণের কাছ থেকে অবাধে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ বাধা দেয়ার নেই। এদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। তদুপরি বহিরাগতদের দ্বারা ভূমির উপর আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। এর ফলে ভূমি বিরোধ ক্রমশ জটিলাকার ধারন করছে। মোটের উপর পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের অস্থিরতা ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

Back to top button