প্রসঙ্গ; পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের জীবন প্রবাহঃ মেকসুয়েল চাকমা
সবুজের সমারোহ, উচুঁ-নিচু পাহাড়, ঝরণা-ধারা, নাম না জানা হাজারো ফুল, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, চেঙ্গী, মাইনী আর কাচলং নদীর প্রবাহিত জলের পাড়ে ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এই তিন জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম; এলাকার আয়তন প্রায় ৫০৯৮ বর্গমাইল। এর প্রাকৃতিক গঠন এবং সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো দেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে ঐতিহ্যগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেন প্রকৃতি স্বর্গীয় দৃশ্য হাতছানি দিয়ে ডাকে মর্তের মানুষকে। কিন্তু বেড়ার অন্তরালে আজও পাহাড়ি আদিবাসীদের রয়েছে দুঃখ, কান্না, অধিকার না পাওয়ার কষ্ট-যন্ত্রণা। দেশের মূলস্রোতের জীবন থেকে এ অঞ্চলে আলাদা ভাষাভাষি ১২(বার) টি জাতির বসবাস, এরা – চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, চাক, মুরং, পাংখো, বম, লুসাই এবং বনযোগী। ধর্মের দিক থেকে তারা কেউ মুসলিম নন । প্রধান অংশ বৌদ্ধ এবং বাকীরা হিন্দু, খ্রীস্টান এবং প্রকৃতি পূজারি বা প্রকৃতির সাথে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ । মূল স্রোতের জনসংখ্যা থেকে ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারায় অভ্যস্ত এই জাতি সমূহের পাশাপাশি অবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেছে অভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং জীবিকার প্রচলন পদ্ধতি। আদিকাল থেকে জীবিকার প্রধান পেশা হলো জুম চাষ। জুম চাষ হলো পাহাড়ে ফসল উৎপাদনের একটি পদ্ধতি, যেখানে একসাথে অনেক ফসল আবাদ করা হয়, যেমন-ধান, ভুট্টা, বেগুন, কুমড়া, মরিচ ইত্যাদি । এই জুম চাষকে অবলম্বন করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে । এই চাষ পদ্ধতি আদিবাসীদের অনেকটা ঐতিহ্যের সাথে জড়িত, জীবনের প্রতীক, রক্তের সাথে মিশে আছে । এ কারণে পাহাড়ি আদিবাসীরা নিজেদেরকে জুম্ম পরিচয় দিতে পছন্দ করে। এমন একটা সময় ছিল তারা তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সবকিছু জুমচাষের মাধ্যমে উৎপাদন করতে পরতো, শুধুমাত্র লবণ ও তেলের জন্য তাদের বাজারের উপর নির্ভর করতে হতো। নিজেদের পোশাক পরিচ্ছদ ও নিজেরা তৈরি করতো । যেহেতু পার্বত্যঞ্চলে এক সময়ে লোকসংখ্যা খুবই কম ছিল, তাই জুম চাষের জন্য পাহাড়ি এলাকার ও অভাব ছিল না । একটা জুম একবার চাষ করলে তারা যথেষ্ট ফসল যোগান পেতো । তবে তারা সমতল ভূমিতেও চাষাবাদ করতে পারদর্শী ।
সময়ের আবর্তে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে । তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখা বৃদ্ধি পায় দুইভাবে- ক) প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিকভাবে এবং খ) কৃত্রিমভাবে।কৃত্রিমভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে সমস্যা । আর এই সমস্যা শুধু মাত্র সংখ্যার সমস্যা নয় । এটি যতটা না জনকল্যাণ ও উন্নয়নের সমস্যা তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক সমস্যা । যদি উন্নয়ন বলতে জনগণের জীবনমান, তাদের উপার্জন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সার্বিক কল্যাণ বুঝায় এবং যদি উন্নয়ন বলতে জনগণের আত্মসম্মান, মর্যাদা এবং পছন্দের স্বাধীনতা বুঝায় । তাহলে সমস্যা সংকুল পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগণের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তাদের স্বাতন্ত্রতাবোধ সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্নবোধক (?) করে রাখা হয়েছে । রাজনৈতিক সমস্যাকে বার বার ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়। যার ফলশ্রতিতে উহ্য থেকে যায় তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি । পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সংখ্যানুপাত পাহাড়ি আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে বেসরকারিভাবে বাঙালিরাই বেশি, যারা সেটেলার বাঙালিই হিসেবেই অধিক পরিচিত । অথচ সেখানে ১৯৪৭ সালে ৯৮ ভাগ পাহাড়ি আদিবাসী এবং মাত্র ২ ভাগ বাঙালি বাস করতো । ১৯৫১ ও ১৯৬১ সালে বাঙালি জনসংখ্যাউন্নীত হয় যথাক্রমে ৯ ভাগে ও ১২ ভাগে । বলতে গেলে আশির দশক পর্যন্ত পাহাড়ি আদিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ বর্তমানে জনসংখ্যার অবস্থান উল্টোপিঠে চরম পরিহাসে ! অনুপাত ও সংখ্যায় সেটেলার বাঙ্গালিরা অধিকাংশ আসে নতুন পরিবেশ পরিস্থিতির সুযোগে অনেকটা রাজনৈতিক প্ররোচনায়, সরকারি প্রলোভন, উৎসাহ ও উদ্যোগে । এরা বিভিন্ন কৌশলে একদিকে যেমন সরকারের বরাদ্দকৃত সুযোগসহ নির্দিষ্ট পরিমাণের জমি দখলে সক্ষম হয় অন্যদিকে সহজ-সরল পাহাড়ি আদিবাসীদের নিকট থেকে বিভিন্ন কুট পন্থা অবলম্বন করে, জোরপূর্বক এবং অনেকটা প্রভাব খাটিয়ে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জমি দখল করে নিচ্ছে। সরকারি প্রশাসনের কাছে এ ব্যাপারে আাইনগত সাহায্য চাওয়া হলে ও কোন লাভ হয় না। আইন নামক বস্তুটি থেকেও না থাকার মতো। এ কারণে একমাত্র চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল অনেক নিরীহ আদিবাসী পাহাড়ি সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে এবং বাঙালিদের (সেটেলারদের) দ্বারা বন উজারের ফলে পাহাড়ি বনভূমিগুলো মাত্রাতিরিক্ত হারে দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে । এতে জীব বৈচিত্র্যের সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে পুরো পার্বত্যঞ্চল। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় । এতে প্রায় এক লক্ষ আদিবাসী পাহাড়ি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে । চাষযোগ্য জমির ৫৪ হাজার একর জমি পানিতে ডুবে যায়, যে জমি এখনও পানিতে নিমজ্জিত। সে সময়ে জীবিকার তাগিদে হাজার হাজার আদিবাসী পরিবারসহ দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। যারা বর্তমানে মিয়ানমারে এবং ভারতের কয়েকটি রাজ্যে মানবেতর জীবন যাপন করছে। উল্লেখ্য, তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার এন, এ, লেভিলেট ও চাকমা রাজাত্রিদিব রায় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করেন – ২৬/৯/৫৫ ইং তারিখ রাঙ্গামাটি স্মারক নং ৩৬৯৭ । চুক্তি ছিল যে, ১২৫টি মৌজার জনসাধারণ এ জলবিদ্যুৎ এলাকা থেকে উদ্বাস্ত হবে এবং তাদের সঠিক জীবন যাপনে পুনর্বাসন করা হবে । কিন্তু তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত নাহওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা হুমকি হয়ে দেখা দেয় ।পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান চাষযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ২৩ হাজার একর বা তারও কম ।
অথচ ৭০ দশকের শেষ দিকে তৎকালীন সামরিক প্রধান মরহুম জিয়াউর রহমান সমতল এলাকা থেকে সেটেলার বাঙালিদের এনে সরকারভিাবে পুনর্বাসন করেন এবং আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বিষবাষ্প রোপন করে দেন।তখন থেকে আদিবাসীদের ওপর শুরু হয় চরম পর্যায়ে অত্যাচার, গণহত্যা, ধর্ষণ, গুম, জেল-জুলুম, নির্যাতন প্রভৃতি (সেনাবাহিনীর দাবানল-অপারেশন রয়েছে প্রতিনিয়ত) । এর মধ্যে আদিবাসীদের নৃশংসভাবে বেশ কয়েকবার গণহত্যার শিকার হতে হয়- ১৯৮০ সালে কাউখালী কলমপতি গণহত্যা, ১৯৮৪ সালে ভূষণছড়া গণহত্যা, ১৯৮৯ সালে লংগদু গণহত্যা, ১৯৯২ লোগাং গণহত্যা, ১৯৯৩ সালে নানিয়ারচর গণহত্যা উল্লেখযোগ্য। শাসকের পরিবর্তন ঘটে কিন্তু আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন থেমে থাকেনা । অত্যাচার, নিপীড়নসহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে ১৯৮৬ সালে প্রায় পঞ্চাশ হাজার আদিবাসী শরনণার্থী হিসেবে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হয়। যার কারণে বাঙালিদের (সেটেলারদের) দ্বারা বেদখল হয়ে যায় আদিবাসীদের অনেক ঐতিহ্যগত ভূমি। শান্তিবাহিনী প্রায় দুই যুগের সশস্ত্র আন্দোলনের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে বহু আকাঙ্খিত শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির ১৮ বছর পরও এই শান্তিচুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি । যার কারণে সরকারের ঘোষণা সত্ত্বেও ভারত থেকে ফেরৎ আদিবাসী শরণার্থীরা তাদের জমি আজ পর্যন্ত ফেরত পায়নি। এটা খুবই দুঃখজনক ও হতাশাজনক; শান্তিচুক্তিকে অবজ্ঞা করার মতো । অথচ এই চুক্তির ফলে ১৯৯৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। পার্বত্য আদিবাসীরা সরকারের কাছ থেকে শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করে । পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের মূলজীবিকা এখনো চাষাবাদ। তবে রাঙ্গমাটি এলাকায় কাপ্তাই বাঁধের ফলে আবাদী জমি জলমগ্ন হওয়ায় এখানে আদিবাসীদের জীবিকা প্রবাহ আরো কঠিন। দূর্গম পাহাড়িএলাকায় আদিবাসীদের চিত্র আরো করুণ, বিশেষ করে পার্বত্য বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি দুর্গম এলাকায় অনেকেই জানে না কখন সরকারের পরিবর্তন ঘটছে ! কারণ সরকার পরিবর্তন হয় বটে কিন্তু তাদের জীবনের কোন পরিবর্তন না । উপেক্ষিত থেকে যায় রাষ্ট্রের নিকট তাদের জীবন প্রবাহ !
শিক্ষা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার। শিক্ষা ছাড়া মানুষ পুরোপুরি অন্ধ। ১৮৬২ সালের অক্টোবর থেকে চন্দ্রঘোনা আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার যাত্রাশুরু । পরে ১৮৬৯ সালে স্কুলটি রাঙ্গামাটি জেলা সদরে স্থানান্তর করা হয় এবং ১৮৯০ সালে এটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়। এ সময় থেকে অনেকাংশে শিক্ষার আলো পার্বত্যঞ্চলে জ্বলা শুরু হয় । কিন্তু এখনো পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের শিক্ষার হার দেশের মূলস্রোতের বাঙালি জনসংখ্যা থেকে অনেক অনেক কম। আগের চেয়ে কিছুটা শিক্ষার হার বাড়ার ফলে সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছুসংখ্যক আদিবাসী পাহাড়ি চাকুরিজীবি শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে, কিন্তু তার সংখ্যা নগণ্য বটে । তবে সরকারের ঘোষিত আদিবাসী কোটা সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় আদিবাসীরা অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদের রোষানলে তৃতীয় বিশ্ব আজ অনেকটা স্তব্দ । আর সেই রোষানল হতে রেহাই পায়নি পার্বত্যের পাহাড়ি আদিবাসীরাও। শাসকগোষ্ঠীর অমানবিক নির্যাতন প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের মানবাধিকারকে লংঘিত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মনে রাখতে হবে- ব্রিটিশ শাসনের কাছে মাথা নত না করা জাতি হচ্ছে “জুম্মজাতি” । জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে প্রয়োজনে যেকোন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর নিজেদের অধিকার কোন দাতা সংস্থা বা কোন গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে দিবে না; এমনকি ইতিহাসে এমন কোন নজির নেই । তাই দাতা সংস্থা নির্ভর না হয়ে স্বনির্ভর হয়ে কাজ করার মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আদিবাসীদের কাছে আর্বিভাব হয়েছিলেন জুম্ম জাতির অগ্রদূত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, যার আদর্শের প্রতিটি বিন্দু পার্বত্য আদিবাসীর অধিকারের জন্য সর্বদা অনুপ্রাণিত ছিল, আছে, থাকবে ।যার ছিলো না কোন ক্ষমতার লোভ, সম্পত্তির লোভ, নিজ স্বার্থের লোভ । ছিলো শুধু জুম্মজাতির অস্তিত্ত্ব রক্ষার্থে, জুম্মজাতির অধিকার আদায়ে নিবেদিত লড়াকু প্রাণ। তার মহান আদর্শ ও অনুপ্রেরণাগুলো কাজে লাগিয়ে পার্বত্য আদিবাসীদের এক হতে হবে। সময় এসেছে নিজের মুখ আয়নায় দেখার। বর্তমান সরকারেরও উচিত আদিবাসীদের অধিকারগুলো গোলক ধাধায় সীমাবদ্ধ না রেখে শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ঐতিহাসিক অস্তিত্বরক্ষার্থে, আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া । মৌলিক মানবাধিকারগুলো সুনজরে দেখা এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক নিরাপত্তা দিয়ে বর্তমান সরকারের সুবিবেক উদয় হোক এটাই পার্বত্য আদিবাসীদের কামনা।
মেকসুয়েল চাকমা, আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মী