মতামত ও বিশ্লেষণ

প্রধানমন্ত্রী বরাবর জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রদত্ত স্মারকলিপি

বরাবর
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
মাধ্যম: জেলা প্রশাসক, রাজশাহী।
বিষয় : স্মারকলিপি।
জনাব,
সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৫নং সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ ও চকরহিমাপুর মৌজার ১৮৪২.৩০ একর ভূমি ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলের’ জন্য রিক্যুইজিশনের নামে কেড়ে নেয় তৎকালিন পূর্ব-পাকিস্থান সরকার। এলাকাটি সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম নামে পরিচিত। রিক্যুইজিশনের ফলে ১৫টি আদিবাসী গ্রাম ও ৫টি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ হয়। কথা ছিল রিক্যুইজিশনের নামে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া এই জমিনে আখ চাষ হবে। আখ ভিন্ন অন্য কোনো ফসল চাষ করা হলে বা চিনিকলের উদ্দেশ্যর সাথে সম্পর্কহীন কোনোকিছু করা হলে কেড়ে নেয়া এসব জমি আবারো ভূমি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। রিকুইজেশনের পর বেশ কিছু জমিনে আখ চাষ হয় এবং আখ ব্যবহার করে চিনিও উৎপাদিত হয়। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনার দরুণ ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নানা সময় একবার চালু হয়, আবার বন্ধ হয় এভাবেই চলতে থাকে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। রিক্যুইজিশনের চুক্তি লংঘন করে কেবলমাত্র আখচাষের জন্য বরাদ্দকৃত জমিতে ধান, গম, সরিষা ও আলু, তামাক ও হাইব্রিড ভূট্টা চাষ শুরু হয়। জন্মমাটি থেকে উদ্বাস্তু আদিবাসী ও বাঙালিরা পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আনে। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সনের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকা সরেজমিন তদন্ত করেন। তদন্তকালে তারা উল্লিখিত জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টিকুমড়ার আবাদ দেখতে পান। কিন্তু গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ১০ মে ২০১৬ তারিখে উক্ত ভূমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন সরকার বরাবর। বাপ-দাদার জমিনে অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে আদিবাসী-বাঙালি ভূমিহীনদের তৈরি হয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন ভূমিহীনদের সংগ্রামে হামলা-মামলার বাহাদুরি চালাচ্ছে। আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে প্রশাসন, নিহত ৩ জন ও আহত অনেক নারী পুরুষ। কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন আন্দোলনকারী নামে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দিয়েছে। ১৯৬২ থেকে ২০১৮, দীর্ঘ ৫৬ বছর ধরে চিনি উৎপাদনের অজুহাতে রাষ্ট্র সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমিউদ্বাস্তু হাজারো মানুষের সাথে বর্ণবাদী অন্যায় করে চলেছে। ঘটনাটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান, মানবিকতা ও আইন সবকিছুই লংঘন করে চলেছে। দ্রুত এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার জরুরি।
প্রিয় জননেত্রী, সুগার মিলের কারণে রিক্যুইজিশনের নামে কেড়ে নেয়া বাপ-দাদার জমিতে অধিকার ফেরত পাওয়ার দাবিতে সংগঠিত আমাদের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের এই আন্দোলন নিছক ভূমি রক্ষার আন্দোলনই নয়। এই আন্দোলন দেশের সংবিধান ও বিচারব্যবস্থার প্রতি গণমানুষের আস্থা ও বিশ্বাস মজবুতের লড়াই। আমরা বিশ্বাস করি সরকার এই আন্দোলনের দাবি ও বিবেচনাকে গুরুত্ব দিবে এবং ভূমিবঞ্চিত আদিবাসী ও বাঙালিদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। রিক্যুইজিশন কৃত জমি ভূমিবঞ্চিতদের মাঝে আইনতভাবে ফিরিয়ে দিয়ে সরকার গণতান্ত্রিক চর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে আমরা এই বিশ্বাস করি। আমাদের শেষ আশ্রয় ও ভরসাস্থল আপনি, আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে আপনিই এই সংকট থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারেন। আমরা বারবার নানাভাবে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সরকারের কাছে আমাদের ন্যায্য দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের জনদাবিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে না। তাই আবারো আমরা আপনার নিকট এই স্মারকলিপির মাধ্যমে আমাদের প্রস্তাব ও দাবিকে তুলে ধরছি। আমাদের অগাধ বিশ্বাস আপনি প্রান্তিক মানুষদের এই প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করবেন।
প্রিয় জননেত্রী, গত ৬ই নভেম্বর ২০১৬ মিল কর্তৃপক্ষ বেআইনীভাবে (কোর্টের আদেশ ব্যতীত) আদিবাসীদের নির্মিত বসতবাড়ি, ফসলাদি ও মৎস্যখামারে পুলিশ, প্রশাসনসহ স্থানীয় প্রভাবশালী সন্ত্রাসীদের দ্বারা উচ্ছেদের নামে নিরীহ আদিবাসীদের উপর হামলা বসতবাড়ি ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং বর্বরোচিতভাবে গুলিবর্ষণ করে। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের সাঁওতাল পল্লীতে আদিবাসীদের স্কুল সন্ত্রাসীরা পুড়িয়ে ফেলে। পুলিশের গুলিতে ও নির্যাতনে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মারডি ও রমেশ টুডু নিহত এবং অনেকেই গুরুতর আহত হয়। গুরুতর আহতদের মধ্যে অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করে। এমনকি পুলিশ আদিবাসী-বাঙালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে অনেককে গ্রেফতার ও নির্যাতন করে জেল হাজতে প্রেরণ করে। ৬ নভেম্বর ২০১৬ তা-বলীলার পর থেকে আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বাড়িঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষায় যে স্কুলটি ছিল ঐদিন সন্ত্রাসীরা তছনছ করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। আমরা শিশুদের জন্য পূর্বের স্থানে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পুন:স্থাপন করার জন জোর দাবী জানাচ্ছি।
অবিলম্বে আদিবাসীদের স্কুল স্বস্থানে পুননির্মাণসহ আদিবাসী বাঙালিদের ৭ দফা দাবী পূরণের লক্ষে আন্দোলনরত সংগ্রামে সর্বস্তরের জনগণকে শরিক হওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের আদিবাসী বাঙালিদের পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরত দাও
৬ নভেম্বর ২০১৬ আদিবাসী হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর, নির্যাতনের বিচার ও ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ ৭ দফা দাবি বাস্তবায়ন কর ॥
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির ৭ দফা দাবির পক্ষে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের রাজশাহী জেলা:
১.গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম-এর রিক্যুইজিশন (Requisition) করা ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি আদিবাসীদের ফেরত দিতে হবে।
২.১৯৪৮ সালের The East Bengal (Emergency) Requisition of Property Act 1948 (No. VIII of 1948) মোতাবেক যে কার্যের জন্য (ইক্ষুচাষ) গ্রহণ হয় তা না করা হলে খেসারতসহ পূর্বমালিক আদিবাসীদের ফেরতের বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩.আদিবাসীদের সম্পত্তি কোন সরকার/কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রিক্যুইজিশন (Requisition) করা এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় এ ধরণের কার্য বাতিল ও পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করে আদিবাসীদের সম্পত্তি ফেরত দিতে হবে।
৪.আদিবাসী সাঁওতালপল্লীতে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং গুলি করে নিহত ও গুরুতর আহত করার সাথে জড়িত উস্কানীদাতা ও সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নিহত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫.৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ আদিবাসী-বাঙালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আদিবাসী-বাঙালি নারী-পুরুষের উপর স্থানীয় সন্ত্রাসীদের জুলুম ও পুলিশী হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
৬.আদিবাসী সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগকারী চিহ্নিত পুলিশ কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
৭.২০০৪ সালে সুগার মিল বন্ধের পর প্রভাবশালীদের মাঝে লিজের নামে যে অর্থআত্মসাৎ ও দুর্নীতি হয়েছে সেই দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অতএব, আমরা আপনার নিকট এই স্মারকলিপির মাধ্যমে আমাদের প্রস্তাব ও দাবিকে তুলে ধরছি। উক্ত ন্যায়সঙ্গত দাবীসমূহ পুরণে আপনার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি।
বিনীত নিবেদক
(বিমল চন্দ্র রাজোয়াড়)
সভাপতি
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, রাজশাহী জেলা কমিটি
(সুসেন কুমার স্যামদুয়ার) সাধারণ সম্পাদক
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, রাজশাহী জেলা কমিটি

Back to top button