প্রথম আদিবাসী নারী গানের দল এফ মাইনর
শ্যাম সাগর মানকিনঃ
এফ মাইনর। যারা গান করেন তাদের কাছে এফ মাইনর পরিচিত একটা কর্ড বা স্বরসঙ্গতি হিসেবে। কিন্তু আজকের আলাপের বিষয় কর্ড বা স্বরসঙ্গতি নয়, কথা বলবো আদিবাসী নারীদের প্রথম গানের দল এফ মাইনর নিয়ে। আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম হলেও, পাঁচ সদস্যের এই নারী গানের দলটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী গানের দল হিসেবেই নিজেদের আত্মপ্রকাশ করেছে।
এফ মাইনরের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ২০১৬ সালের অক্টোবরের ২৬ তারিখ। আত্মপ্রকাশটা ঘটে সে বছরেরই নভেম্বর মাসে ঢাকা ওয়ানগালায় স্টেজ পারফর্মেন্সের মাধ্যমে। গারো সুরকার, সংগীত পরিচালক ও শিল্পী যাদু রিছিল ও গানের দল মাদলের বেইজিস্ট অন্তর স্কুর তত্ত্বাবধানে এবং নাদিয়া রিছিল, পিংকি চিরান ও ঐশ্বর্য চাকমা এই তিনজন সদস্য নিয়ে এফ মাইনর তার পথযাত্রা শুরু করেছিলো। বর্তমানে গানের দলে ঐশ্বর্য চাকমা না থাকলেও নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরো তিন সদস্য। বর্তমানে গানের দল এফ মাইনরে পাঁচজন সদস্য রয়েছে। পিংকি চিরান দলের ভোকাল, নাদিয়া রিছিল উকুলেলে ও ভোকাল, একিউ মারমা কিবোর্ডিস্ট, গ্লোরিয়া মান্দা গিটারিস্ট এবং দিবা চিছাম কাহন ও ড্রামস বাদক হিসেবে দলে রয়েছেন। দলের প্রত্যেকেই এখনো পড়াশুনা করছেন। পিংকি চিরান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে স্নাতক ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত ও নাদিয়া রিছিল স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। হোম ইকোনমিক্সে স্নাতক ৩য় বর্ষে পড়ছেন একিউ মারমা এবং দলের অন্য দুই সদস্য দিবা চিছাম ও গ্লোরিয়া মান্দা পড়ছেন দশম শ্রেণীতে।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই বছর। এরই মধ্যে প্রথম আদিবাসী নারী গানের দল হিসেবে নিজেদের আলাদা একটা পরিচিতি ও অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে গানের দল এফ মাইনর। স্টেজ পারফর্মেন্সের পাশাপাশি টেলিভিশন ও এফএম রেডিওতে প্রোগ্রাম নিয়ে গত দুই বছরে অনেক ব্যস্ত সময় পার করেছে গানের দলটি। এর মধ্যে এটিএন নিউজ ও চ্যানেল ২৪ এ এবং রেডিও এবিসি, রেডিও নেক্সট ও কালারস এফএমর প্রোগ্রামে নিজেদের পরিবেশনা দিয়ে দেশবাসীকে আগমনী বার্তা দিয়েছে তারা। দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে এফ মাইনরকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ফিচার।
আদিবাসী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকজ সুরের গানের পাশাপাশি শ্রোতাপ্রিয় বিভিন্ন গান কাভার করে থাকে এফ মাইনর। তাছাড়া নিজেদের মৌলিক গানের কাজ করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন অবধি দলের অন্যতম তত্ত্বাবধানকারী যাদু রিছিলের সুর করা ও কম্পোজ করা গান গাইলেও দলের সদস্যদের মধ্যেও গান লেখা সুর করার চেষ্টা চলছে। নিজেদের গান হিসেবে নিশি রাইতের জংলাফুল ও একত্রিশ শিরোনামের দুটো গান ইতিমধ্যে নানা অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছে।
গানের দলের নাম এফ মাইনর কেনো? এমন প্রশ্নে গানের দলের অন্যতম সদস্য ও ভোকাল পিংকি চিরান আমাদের জানাচ্ছিলেন, বিশেষ কোন ভাবনা ছিলোনা গানের দলের নাম এফ মাইনর রাখার পেছনে। যেহেতু গানের দল তাই সুরের সাথে সংগতিপূর্ণ একটা কিছু নাম খুঁজছিলাম। এফ মাইনর একটা কর্ডের নাম তাই নামটা রেখে দেয়া। কিন্তু যদি বলি এফ দিয়ে ফিমেল, ফ্রিডম, ফাইট নানান কিছুই হতে পারে, বলেই হেসে দেন পিংকি। গানে গানে নারী মুক্তির কথা বলাটা গুরুত্বপূর্ণ, সে ভাবনা-চিন্তা এফ মাইনরের রয়েছে বলেও জানান পিংকি।
গানের দলের প্র্যাক্টিসে চলে নানা খুনসুটি। এ ব্যাপারে পিংকির সহজ স্বীকারোক্তি দলের মধ্যে সব থেকে অলস মানুষটা হলাম আমি। প্র্যাক্টিসে সবসময় ঠিক সময়ে হাজির হয় দিবা আর গ্লোরিয়া। এদের কারনে নাদিয়ার সময়মতন থাকতেই হয়। তবে কখনো কখনো নাদিয়ার দেরি হলে আমাকেও সময়মত পৌছাতে হয়। কিন্তু আমি সবসময়ই দেরি করি। এ দিক থেকে মাঝামাঝি জায়গায় রাখা যেতে পারে একিউ মারমাকে। দলের মধ্যে প্রত্যেকের আবার আলাদা মজার নাম রয়েছে। যেমন নাদিয়াকে লাড্ডু, দিবাকে দিব্বা(ছারপোকা), গ্লোরিয়া ফুচকু, একিউ বংবং(বোকাসোকা), আর আমাকে সবাই ডাকে ফিংকি বলে হেসে হেসে সে কথা জানাচ্ছিলেন দলের অন্যতম সদস্য পিংকি চিরান।
এফ মাইনরের কাছে শ্রোতাদের প্রত্যাশা বেড়েছে। গানের দলের সদস্যদের কাছে প্রত্যাশার কথা জানান অনেকেই। এফ মাইনর শ্রোতাদের প্রত্যাশাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখেন। দলেরও স্বপ্ন আগামীতে এফ মাইনর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গানের দল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন। তবে একে তো নারী তারপর আবার আদিবাসী নারী, সে হিসেবে নিজেদের এই পথযাত্রা যে খুব সহজ হবেনা সে বিষয়টাও মাথায় রেখে এগিয়ে চলেছে এফ মাইনর। সাম্প্রতিক এফ মাইনর তাদের প্রথম এ্যালবামের কাজে হাত দিয়েছে। আগামী বছর নাগাদ এ্যালবামটি প্রকাশ করার ইচ্ছে তাদের।
সারাদেশে আদিবাসী ও আদিবাসী নারীদের উপর চলা নানান সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যেও আদিবাসী নারীদের এমন উত্থানে আমরা নিশ্চয় আশাবাদী হতে পারি। নতুন আগামীর স্বপ্নে নিজেদের বুক বাঁধতে পারি। নিজেদের সমস্ত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতাকে মাড়িয়ে দিয়ে, আদিবাসী তরুনীদের এ এক স্বপ্নময় যাত্রা। এফ মাইনরের কথা ও সুরের এই স্বপ্নময় যাত্রা অবিরত থাকুক।