পাহাড়ে তরুণদের তুলিতে আঁকা গ্রাফিতিকে রাঙিয়ে উঠছে তিন জেলার শহুরে দেয়াল
আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় তরুণ আদিবাসীরা নানা স্থানে পালন করেছে গ্রাফিতি অংকন কর্মসূচী। মূলত খাগড়াছড়ি জেলা সদরে কল্পনা চাকমাকে নিয়ে আঁকাে একটি গ্রাফিতি মুছে দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছে পাহাড়ের জুম্ম তরুণরা। উক্ত গ্রাফিতিতে আইনরক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক কল্পনা চাকমাকে অপহণের প্রেক্ষাপট টেনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে- “কল্পনা চাকমা কোথায়?” এই গ্রাফিতি মুছে দেওয়ার পর পরই পাহাড়ের তরুণ আদিবাসীরা তিন পার্বত্য জেলায় এই কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়।
ঘোষণা অনুযায়ী দেখা যায় গতকাল ১১ আগষ্ট রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান শহরে পাহাড়ী জুম্মরা শহরের নানা জায়গার দেওয়ালে নানা ধরণের গ্রাফিতি অংকন করেন। অনেকেই নিজেদের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন “যতবার মুখে ফেলার চেষ্টা হবে ততবার আঁকা হবে।”
রাঙ্গামাটিতে বনরূপা পুলিশ বক্সের পূর্বে বনবিভাগের ওয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছে স্থানীয় তরুণ আদিবাসী শিক্ষার্থীরা। সেখানে দেখা যায় গ্রাফিতিগুলোতে পাহাড়ের নানা সমস্যা কিংবা ঘটনাকে চিত্রিত করা হয়েছে। দেখা যায় সেখান নিঁখুত তুলিতে আঁকা হয়েছে জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে। একই সাথে সেখানে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সেনাবাহিনীর কতিপয় অভিযুক্ত কর্মকর্তা কর্তৃক কল্পনা চাকমাকে অপহরণের চিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
অন্যদিকে রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীতে অবস্থিত দেওয়ালগুলোতেও আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি। দেখা যায় সেখানে চাকমা আদিবাসীদের ব্যবহৃত ‘পিনোন’ এর সাবুগীর সাথে লেখা হয়েছে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা’র চিরচেনা উক্তি- “যারা মরতে জানে পৃথিবীতে তারা অজেয়”। উক্ত গ্রাফিতিতে চাকমা বর্ণমালায়ও একই কথায় লেখা হয়।
তার পাশেই আঁকা গ্রাফিতিতে মুষ্টিবদ্ধ হাতে ধরে থাকা কলম এবং স্পর্ধা নিয়ে লেখা হয়েছে- “আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী আদিবাসী।”
একই সাথে আরেকটি গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে- “WE WANT CIVILIAN RULE IN CHT”। উক্ত গ্রাফিতিতে সেনাশাসনের যাঁথাকল থেকে মুক্তির অবাধ আকাংখা যেন ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবে। এ গ্রাফিতির ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে ইশন চাকমা নামের এক পাহাড়ী তরুণ লিখেছেন- ”আজ রাংগামাটিতে শিক্ষার্থীরা এত এত গ্রাফিতি এঁকেছে যে কারো যদি মুছে ফেলারও উদ্যেশ্য থাকে তাহলে তারা মুছতে মুছতে ক্লান্ত হয়ে যাবে।”
গ্রাফিতি অংকনের পাশাপাশি শহরের জনপ্রিয় তরুণ শিল্পীবৃন্দ কর্তৃক উক্ত কর্মসূচীতে অংশগ্রহনকরাীদের গানে গানে মাতিয়ে রাখার প্রয়াসও দেখা গেছে। সেখানে কন্ঠশিল্পী তিশা দেওয়ান, আরশি ত্রিপুরা, জীবন দেওয়ান, মুনসুন দেওয়ানসহ অনেক পাহাড়ী তরুণকে গানে গানে সংহতি জানাতে দেখা গেছে। তাঁরা গেয়েছেন আদিবাসী ব্যান্ড মাদল এর ‘আমি আদিবাসী, আমি আদিবাসী”, ‘পীরেন স্নাল’কে নিয়ে করা তারুণ্য মাতানো গান ’শাল বৃক্ষের মতন সিনহা তান করেছে/ মানুষ হয়ে বাঁচতে পীরেন জান দিয়েছে।”
এদিকে খাগড়াছড়িতেও নানা জায়গায় আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি। শহরের চেঙ্গী স্কোয়ার সংলগ্ন রাস্তার দেওয়ালে, লারমা স্কোয়ারের দেওয়ালে এবং মধুপুরের কিছু দেওয়ালে এ কর্মসূচী পালন করা হয়। উক্ত কর্মসূচীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাহাড়ের শিক্ষার্থীদেরকে অংশ নিতে দেখা যায়।
তাঁদের আঁকা প্রাফিতিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেখানে কল্পনা চাকমার প্রতিকৃতিসহ আরো জুম্ম তরুণীর ছবি অংকন করে লেখা হয়েছে- “ পাহাড়ের প্রতিটি কন্ঠস্বরে এখন কল্পনা চাকমা”। একই সাথে সেখানে আঁক হয়েছে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রতিকৃতি। উক্ত প্রতিকৃতিকে ঘিরে ধরেছে নানা ভাষার আদিবাসী বর্ণমালা। তাছাড়া কল্পনা চাকমার চোখে জলপায় রঙের কাপড় পেছিয়ে আঁকা গ্রাফিতিতে পাহাড়ের এই তরুণরা বার বার প্রশ্ন উত্থাপন করছে- “কল্পনা চাকমা কোথায়?”
তাছাড়া বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশে জলপায় রঙের ছাপ রেখে বাকী অংশজুড়ে সবুজ আর তার কেন্দ্রে আঁকা হয়েছে লাল। সেখানে প্রশ্ন করা হচ্ছে- যেখানে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন দেশের পদযাত্রা শুরু হয়েছে, সেখানে কেন পাহাড়ে এখনো সেনাশাসন জিইয়ে রাখা হল?
এদিকে বান্দরবানেও শহরের নানা জায়গায় গ্রাফিতি অংকন করেছে এ জেলার স্থানীয় পাহাড়ী শিক্ষার্থীরা। তাঁদের গ্রাফিতিতে দাবী তোলা হচ্ছে- ” Fully Implement CHT Accord” । তাছাড়া দেয়ালিকায় লেখা হয়েছে- “আদিবাসীি হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই।” অন্যদিকে তার পাশে দেয়ালে লেখা হয়েছে- “এক জাতির দেশ নয়, বহুজাতির বাংলাদেশ”।
বান্দরবান শহরে আঁকা এক গ্রাফিতিতে আরো লেখা হয়েছে- “ক্ষুদ্র নয়, উপজাতি নয়, আদিবাসী বলি”। উক্ত দেওয়ালের পাশেই লেখা হয়েছে- “আমাদের বম জনগোষ্ঠী কী মুক্তি পাবে?”
এদিকে বান্দরবান শহরেও গ্রাফিতি অংকনের সময় নানা ধরণের প্রতিবাদী গান গেয়ে অংশগ্রহনকারীদের উৎসাহিত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।
জানা যায়, আজ ১২ আগষ্টও খাগড়াছড়ির সদর উপজেলা, দিঘীনালা উপজেলা, পানছড়ি উপজেলা, রাঙ্গামাটি সদর এবং বান্দরবান সদরে এই কর্মসূচী পরিচালনা করবে স্থানীয় জুম্ম শিক্ষার্থীরা। উক্ত কর্মসূচীতে প্রয়োজনীয় রং, তুলি ক্রয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা নিজেরায় অর্থ উত্তোলন করছেন এবং সেখানে বহু শুভাকাঙ্খী স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।