পাহাড়ি ছাত্র সমাজের সংগ্রাম, ইতিহাস ও কিছু অভিজ্ঞতার সারসংকলনঃ বাচ্চু চাকমা
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এর জন্ম শুধুমাত্র লংগদু গণহত্যার মধ্য দিয়ে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে ছাত্র সমাজের জন্ম বহু আগে বলা যায়। ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে সংগঠিত লংগদুর গণহত্যা আমাদের জাতীয় জীবনে একটা বড় ধরণের ঘটনার জন্ম দিয়েছে। যে ঘটনা জুম্ম ছাত্র সমাজকে আরও নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা বাস্তবতা জন্ম দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটির বুকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করেছিল। ফলশ্রুতিতে জুম্ম জাতীয় জীবনে এক দুর্বিসহ যে অবস্থা জন্ম নিয়েছিল, আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, সেই সময়েও আমরা লক্ষ্য করেছি একমাত্র পাহাড়ি ছাত্র সমাজই সেই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়িয়েছিল। যুগে যুগে ছাত্র সমাজরাই জাতির ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে, স্বাধিকার-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করেছিল। ব্রিটিশ আমলে যদি ফিরে যায়, ১৯১৫ সালে চাকমা যুব সমিতি নামে এই সংগঠন জন্মলাভ করে। এই সংগঠনেও নেতৃত্ব দেন পাহাড়ি ছাত্র-যুব সমাজ। এই সংগঠনের মাধ্যমে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা ও শিক্ষা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে মুক্তি করে বিকাশের পথে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে শিক্ষা উন্নয়নে আর একজন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হলেন কৃঞ্চ কিশোর চাকমা। তারপর ১৯২৮ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ান ও ¯েœহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে গঠিত হয় চাকমা যুবক সংঘ। নানা বাধানিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন ‘চাকমা যুবক সংঘ’ গঠিত হয়। সবচেয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য হল সেই সময়ে সামন্তীয় সমাজের ঘুণেধরা, রক্ষণশীল ও পশ্চাদপদ জুম্ম সমাজের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে নেতৃত্ব দিয়েছিল পাহাড়ি ছাত্র সমাজ। নতুন করে ভাবতে তারা শুরু করেছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্যাঞ্চল কেন পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হতে যাবে? কথা ছিলো মুসলমানদের নিয়ে গঠিত হবে পাকিস্তান আর বাকি সকল জনগোষ্ঠী সম্মিলিত হয়ে গঠিত হবে ভারত। কিন্তু সেই সময়ে সামন্তবাদী নেতৃত্ব প্রতিরোধ তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করতেও সাহস করেনি। বলতে গেলে সামন্তবাদী নেতৃত্বই পাকিস্তানের হাতে পার্বত্যাঞ্চলকে তুলে দিয়েছিল। ৫০ দশকের শেষের দিকে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬২ সালে মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণ পেয়েছিল অধিকারকামী ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র সমিতি। এই পাহাড়ি ছাত্র সমিতি আবারও নতুন করে ছাত্র সমাজ তথা জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এই পাহাড়ি ছাত্র সমিতি জুম্ম জনগণের স্বাধিকার আদায়ের প্রতিরোধ সংগ্রামে বিশাল মহিরূহে আবির্ভাব ঘটে। ’৭০-এর নির্বাচনে মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সমাজ জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করেছিল এবং নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭২ এর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে আমাদের আত্মপরিচয়কে অস্বীকৃতি জানানোর পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ সংঘবদ্ধ হয়ে পার্বত্যাঞ্চলের বুকে প্রতিরোধ সংগ্রাম জোরদার করতে থাকে। গোটা দুই দশক ধরে চলতে থাকে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম। নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন পাহাড়ি ছাত্র সমিতি থেকে উঠে আসা সেই সময়ের আপোষহীন সংগ্রামী ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিরা। মহাননেতার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ নতুন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে অনেক আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। বিপ্লবী চেতনা উন্মেষ ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জুম্ম জনগণের স্বাধিকার-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ি ছাত্র সমাজ সংগ্রাম করতে কোন প্রকারের সন্দেহ পোষণ করেনি। পার্বত্যাঞ্চলের হাজারো ছাত্র সমাজ বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে। পাহাড়ি ছাত্র সমাজের মধ্যে পার্বত্যাঞ্চলের প্রকৃত সংগ্রাম ও ইতিহাস সম্পর্কে অধিকাংশই ওয়াকিবহাল নয়। সময়ের অন্তর দাবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ বিভিন্ন জীবিকা ও কর্মক্ষেত্রে নিজেদেরকে নিবেদিত করছে। পাহাড়ি ছাত্র সমাজ পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার, মান-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আজকে জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার কোন বাস্তবতা নেই, যদি না পার্বত্যাঞ্চলে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন অধিকতর জড়িত না হয়। ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে যেই ছাত্র সমাজ জাগ্রত করেছিল মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সেই ছাত্র সমাজের সংগ্রামী চেতনাকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সাহসী, সংগ্রামী, ত্যাগী ও আদর্শিক পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে আজকে অধিকতর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
আমরা জানি, ১৯৮০-র দশক পাহাড় ছিল এক অবরুদ্ধ আর আতংকের জনপদ। শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিণত হয়েছিল এক মৃত্যু উপত্যকায়। এমনতর গভীর অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথে আগুয়ান হবার মন্ত্র শুনতে পায় পাহাড়ের ছাত্র সমাজ। পথ দেখিয়েছিল আমাদের প্রিয় অগ্রজরা। গহীন অরণ্যে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়, জুমে জুমে অগ্রজরা প্রতিরোধ যুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীকে জবাব দিয়েছে প্রতিনিয়ত। এম এন লারমার প্রদর্শিত সংগ্রামের পথেই পা বাড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেনি পাহাড়ের তরুণ ছাত্র সমাজ। এরই মধ্যে লংগদুতে সংগঠিত হয় আরেক নির্মম গণহত্যাকান্ড। রক্তের হোলিখেলায় পাহাড়ের আকাশ-বাতাস আবারও ভারি হয়ে উঠে। ৪ মে ১৯৮৯ লংগদু গণহত্যা পাহাড়ের ছাত্র সমাজকে বিদ্রোহে অদম্য করে তুলেছে। লংগদু রক্তের ¯্রােতধারায়, স্বজন হারানো যন্ত্রণায় চাপা গোঙানিতে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ জেগে উঠার নতুন জাগরণের ডাক শুনতে পায়। সেনাশাসনের ভয়াল আগ্রাসী হায়েনার থাবা অগ্রাহ্য করে ১৯৮৯ সালের ২০ মে পাহাড়ের ছাত্র সমাজ ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিল। শৃঙ্খল ছেঁড়ার গান ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ি মানুষের প্রাণ থেকে প্রাণে। এভাবে সূচিত হয় আরেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের, অগণিত তরুণ পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্রতিরোধের বহ্নিশিখা জ্বালিয়েছে।
অতীতের স্মৃতি বিজরিত সংগ্রামী সহযোদ্ধা, স্নেহাদ্র্র কর্মী বন্ধুদের সাথে প্রায় এক দশকের অধিক সময় ধরে কাটিয়েছি সংগ্রামী জীবন, একসাথে জুম পাহাড়ের স্বপ্ন বুনেছি, এম এন লারমার গল্প করেছি ও তাঁর আদর্শের জীবন্ত প্রতীকরূপে কর্মী বন্ধুদের গড়ে উঠতে অনুপ্রেরণা যোগানোর চেষ্টা করেছি। পাহাড়ের সংগ্রামের গল্প হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিংবা জগন্নাথ হলের পাশে পুকুর পাড়ে রাত জেগে গল্প হয়েছে, পাহাড়ের লড়াইয়ের গল্প হয়েছে জগন্নাথ হলের জুম্ম শিক্ষার্থীদের সাথে, আপোষহীন সংগ্রামের গল্প হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খেলার মাঠে, গল্প হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অত্যন্ত কাছের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এস আলম কটেজ, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ, গ্রন্থগার ও খেলার মাঠ ও ক্যাম্পাসের চারিদিকে, গল্প হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্রাবাসে, গল্প হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের সবচেয়ে পুরাতন ঐতিহ্যবাহী রাঙ্গামাটি কলেজ ক্যাম্পাসে কিংবা রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলায় শহর হতে গ্রামাঞ্চলের পাহাড়ে-পাহাড়ে জুম্ম জনগণের সাথে একাকার হয়ে সংগ্রামের গল্প হয়েছে। জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার কোন কমতি ছিলো না। দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের সময় প্রিয় অগ্রজদের সফলতা ও ব্যর্থতা দুটোই দিক তুলনামূলকভাবে আলোচনা-সমালোচনা, নানাবিধ যৌক্তিক কথাবার্তা উপস্থাপন হয়েছে। কর্মীদের সাথে যোগাযোগ, খবরা-খবর নেওয়া, সাংগঠনিক কাজের কি অবস্থা চলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা এবং ছাত্র সমাজের করণীয় বিষয়ে গভীরভাবে আলাপ হতো, পর্যালোচনা চলতো, তর্ক-বির্তক চলতো, সমালোচনা-আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে একটা যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছে যেতাম। এভাবে কেটেছে এক দশকের অধিক প্রিয় ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কোলে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যেকোন মূল্যে পাহাড়ের বুকে মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। জুম্ম জাতির জাতীয় জীবনে বারে বারে সংকট নেমে এসেছে। জাতির দুর্দিনে সংকট মোকাবেলায় অসীম সাহস নিয়ে পাহাড়ের বুকে আমাদের জুম্ম জাতির বীর সেনানীরা এগিয়ে এসেছে। তাঁদের মেধা, ঘাম, রক্ত ও জীবন দিয়ে গড়ে উঠেছে জুম্ম জাতির সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই হলো আপনাদের লক্ষ্য। কিন্তু সেই মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রবল বৈরি ¯্রােতে দাঁড়িয়ে আপনাদের লড়াই করতে হচ্ছে। সমাজের প্রগতিশীল চেতনাকে বুকে ধারণ করে সামনে দিকে এগিয়ে চলতে হবে। আমাদের চলার পথকে কেউ রুদ্ধ করে দিতে পারে না- যদি আমরা মহান মুক্তির মহান আদর্শকে ধারণ করতে পারি এবং সেটা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। জুম্ম জনগণের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী হলো এই শাসকশ্রেণির শোষণ-নিপীড়ন। দুঃখ, যন্ত্রণা, অভাব জুম্ম জাতির মানুষগুলোকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভূমির উপর অধিকার, বনের উপর অধিকার, জন্মভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের লড়াই কোন জাতির বিরুদ্ধে নয়, আমাদের লড়াই শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, যারা আমাদের জুম্ম জাতিকে বঞ্চিত করে রাখতে চায়, ন্যায্য অধিকার দিতে চায় না। সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র মৌলবাদ ও ইসলামী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের কন্ঠ প্রতিধ্বণিত হবে পাহাড়ের বুকে। এসকল বিষয়ে পাহাড়ি ছাত্র সমাজের সাথে ব্যাপকভাবে আলোচনা হতো, ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময় পার করতাম।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ অত্যন্ত বনেদি ও প্রাচীন একটি সংগঠন। ৯০ দশকে জন্ম হলেও তার বীজ ব্রিটিশ আমলেই অঙ্কুরিত হয়েছে বলা যায়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ একটি সংগ্রামের নাম এবং একটি আদর্শের নাম। তাঁর এই আদর্শ ও লড়াকু অবস্থান সেটি এখনও ধরে রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও আশা করি কোন হেরফের হবে না। কারণ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রেরণা হল নবীন জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে চলা, তাদের যে প্রাণখোলা হাসি ও সংগ্রামী চেতনায় জাগ্রত অধিকারকামী বিশাল পাহাড়ি ছাত্র সমাজ। পাহাড়ি ছাত্র সমাজের একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক, একটি আপোষহীন ছাত্র সংগঠনের নাম যা অন্যসব ছাত্র সংগঠন থেকেই সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির। কারণ পাহাড়ি ছাত্র সমাজের গর্ভে এম এন লারমারই জন্ম হয়েছে। পৃথিবীতে যুদ্ধ দু প্রকারের: একটা ন্যায় যুদ্ধ অপরটি অন্যায় যুদ্ধ। আমাদের প্রিয়নেতা ছিলেন ন্যায় যুদ্ধের পক্ষে, যেখানে সুদৃঢ় নীতি, আদর্শই পরিপূর্ণ থাকে, হাজারো বাধা আসলেও লক্ষ্য, উদ্দেশ্য কখনো বদলায় না, সে কথা বিশাল ছাত্র সমাজের নিকট পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি একদিন, বাস্তব সত্যকে অন্তরের গভীর থেকে নিয়ে এসে কর্মী এবং বিশাল ছাত্র সমাজ তথা জুম্ম জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। শতশত-হাজারো কর্মী বন্ধু আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পতাকা তলে জড়ো হয়েছে। অন্তর দিয়ে সংগঠনের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বলতর করার চেষ্টা করেছে, জাতির প্রতি ভালবাসাও তাদের কমতি ছিল না। অনেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গৌরবময় সংগ্রামের বাস্তব সাক্ষী হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার চেষ্টা করেছে। বিশেষ দায়িত্ব থাকা অবস্থায় অতীতের সহযোদ্ধাদের সংগ্রাম মুখর দিনগুলোই আমাকে অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। অতীতের ছাত্র আন্দোলনের জোয়ারের সময় হয়তোবা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অনেকেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত ইতিহাসের কথা তুলে ধরে জুম্ম জাতিকে গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত করেছে। পাহাড়ি ছাত্র সমাজ সেনাবাহিনীর বন্দুকের নলের সম্মুখেও ন্যায্য দাদি-দাওয়ার কথা তুলে ধরতে কখনো পিছপা হয়নি, শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে অধিকারের কথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে উচ্চারণ করেছে বারবার। কিন্তু অনেকেই আজ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সেই সহযোদ্ধদের স্মৃতি ও গৌরব। সেই সংগ্রামের স্মৃতি ও গৌরব পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে। অনেকজন আজ প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে, জাতির সাথে চরম বেঈমানী করছে। সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাটা ভারী হওয়ায় এখনো জুম্ম জাতির মুক্তি মেলেনি।
প্রিয় সংগঠনের হিসাবের খাতা খুলে দেখো, ছাত্র তরুণ সমাজের ব্যর্থতা থেকে কাটিয়ে উঠার পথ খুঁজো, প্রিয়নেতার আদর্শিক চেতনায় জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত এভাবে ব্যর্থতার খাতাগুলো অনাগত দিনে জুম্ম জাতির ইতিহাসে যোগ হতে থাকবে, তখন সফলতা চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হবে, আকাশ-পাতাল ব্যবধান তৈরি করবে। সেই কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে উঠে সংগ্রামের ময়দানে সফলতার পাল্লাটা ভারী করার দায়িত্ব পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উপরই নির্ভর করবে। আমাদের বর্তমান নেতা, জুম্ম জনগনের জীবন্ত কিংবদন্তী প্রিয়নেতা সন্তু লারমা আক্ষেপের সুরে বলেন, “এযাবত অনেকগুলো পিসিপির কাউন্সিল হয়েছে; সেই কাউন্সিলের মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক যারা নির্বাচিত হন, তারা আজকে কোথায়”? তারা আজ পার্টির মূল¯্রােতধারা থেকে হারিয়ে গেছে কেন? জনসংহতি সমিতির মূল¯্রােতধারায় তাদেরকে পাওয়া যায় না! কেন টিকে থাকতে পারে না; কেন হারিয়ে যায়; দীর্ঘদিন ধরে এই সংকট নিরসনে আমাদের পার্টি জনসংহতি সমিতি মূল¯্রােতধারার নেতৃবৃন্দরা চেষ্টা করে চলেছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, আমাদের এখনো অধিকার নেই, আমরা এখনো অধিকার পাইনি, যাদের অধিকার নেই, তাদের পায়ের তলের মাটি এমনিতেই সরে যায়। ইচ্ছে করলেও তারা কিছুই করতে পারে না; খাওয়ার জিনিস খেতে পারে না, চাওয়ার জিনিস চাইতে পারে না, প্রাপ্য ন্যায্য অধিকারগুলো সে পায় না, এটায় বাস্তবতা! পার্বত্য চট্টগ্রামের কঠিন পরিস্থিতি ও বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে না পারা কারণে আজ তারা হারিয়ে গেছে। যেই ছাত্র বন্ধুরা এই কঠিন পরিস্থিতি ও বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকবে তারাই বিজয়ী হবে, তারাই সংগ্রামী, প্রগতিশীল ও আমাদের ছাত্র সমাজের অগ্রগামী অংশ, ইতিহাস তাদের পক্ষে বিজয়ের গান গাইবে, তারাই সৃষ্টি করবে নতুন নতুন ইতিহাস।
প্রিয় সংগঠনের কোলে নতুন করে আমার জন্মলাভ করাটা সত্যিই গৌরবের। শুনেছি মানুষ নাকি দুই বার জন্মগ্রহণ করে। একবার মায়ের গর্ভে থেকে আর দ্বিতীয়বার স্কুলে অধ্যয়নের মাধ্যমে মানবসত্তাকে জাগ্রত করে। দ্বিতীয়বারের মত জন্মগ্রহণ করার নিয়মের সাথে আমি আরেকটা নতুন নিয়ম যোগ করতে চাই। সেটা হল সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে আমি তৃতীয়বার জন্মগ্রহণ করেছি। এই প্রিয় ছাত্র সংগঠনটি আমাকে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তোমার কাছে আমার দুর্বলতা একটাই সেটা হল তোমার প্রতি অগাধ ভাললাগা ও ভালবাসা। ভালবাসার বস্তুর নিকট মানুষ অধিকতর দুর্বল হয়। সেই দুর্বলতা আমাকে সংগ্রামের স্বপ্নভূমিতে আরো অধিকতর শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে, অনুপ্রেরণা দিয়েছে বারবার। প্রায় একদশকের অধিক ধরে তোমার কাছে লালিত হয়েছি। তোমার দেখিয়ে দেওয়া নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য-লক্ষ্যই এম এন লারমারই বহি:প্রকাশ। সেই প্রদর্শিত পথ থেকে যতই আমাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে ততবেশি আমার অন্তরের গভীরে তোমার স্থান সুদৃঢ় হয়েছে। আমি বাস্তবে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে একটা পাঠশালা হিসেবে বেছে নিয়েছি। সেই পাঠশালা আমাকে শিখিয়ে দিল যে, প্রথমে নিজেকে জানতে হবে! নিজেকে জেনেই নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। সমাজ ব্যবস্থাকে জেনেই সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে, দুনিয়াকে জেনেই দুনিয়াকে পরিবর্তনের কাজে নেমে পড়তে হবে। এবার নিজেকে জানতে গিয়ে আমাকে শিখতে হল আমি কে? প্রথমে আমি ব্যক্তি হিসেবে সমাজে পরিচিত হয়েছি; রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পর আমার পরিচয় হয়ে গেল সংগঠনের রাজনৈতিক পরিচয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ হতে সবেমাত্র প্রস্থান করার পর, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মূল¯্রােতধারায় আমার আগমন। আমি কোন আকাশ থেকে হুত করে পড়েনি, সমাজ থেকে এসেছি সেই সমাজের শ্রেণিচরিত্র কি ধরনের? সাধারণত জুম্ম সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আমার জন্ম। আমাদের প্রয়াতনেতা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন জুম্ম সমাজ ক্ষয়িঞ্চু সামন্ত সমাজ। তাহলে সামন্ত সমাজের শ্রেণিচরিত্র কি কি, সেগুলো আমাকে অধ্যয়ন করতে হবে। যেহেতু নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে সেই সমাজের একজন মানুষের চিন্তা-চেতনা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। সেজন্যে জুম্ম সমাজের শ্রেণিচরিত্র অধ্যয়ন ও অনুশীলন করা একান্ত আবশ্যক।
আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটি করতে হবে, সেটা হল চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা। জুম্ম সমাজে রন্দ্রে রন্দ্রে সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণা শিকড় গেড়েছে। ফলে একসময় সেই সামন্ত সমাজে মানুষ আপন জাতীয় ইতিহাস সম্পর্কে অন্ধ রয়ে গেছে। নিজেকে জানার আগ্রহ আর তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। জাতীয় চেতনার উন্মেষের অভাবের দরুন জাতীয় চিন্তা জগতে জাগ্রত হয়নি দেশপ্রেম এবং এভাবেই জুম্ম জনগন ঘুণেধরা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়েছিলো। যেই সমাজে জন্ম নিয়েছি সেই সমাজের সকল প্রকার ভুল চিন্তাধারাগুলো আমার রক্তের শিরায়, উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সেই ভুল চিন্তাধারাগুলো ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন চিন্তাধারা আগমন ঘটানো আমার নিত্যদিনের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়েছে। পার্টির সাংগঠনিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত এই তিনটি কাজের মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান কার্যক্রমে আমাকে প্রতিদিন যুক্ত থাকতে হচ্ছে। এভাবে নিজের মধ্যেকার মতাদর্শগত সংগ্রাম করতে না পারলে, ভুলের সাথে শুদ্ধের মধ্যেকার সংগ্রাম, মিথ্যার সাথে সত্যের মধ্যেকার সংগ্রাম, খারাপের সাথে ভালোর মধ্যেকার সংগ্রাম, ব্যক্তিস্বার্থের সাথে সামগ্রিকস্বার্থের মধ্যেকার সংগ্রাম করতে না পারলে আমাকেও ¯্রােতের বিপরীতে চলা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তখন দোদুল্যমানতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রীকতা, উচ্চাভিলাষী, সুবিধাবাদী এই প্রতিক্রিয়াশীলতায় আমাকে ঘিরে ধরবে। এই ভুল চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ শব্দগুলো দিয়ে তখন আমাকেও বিশ্লেষণ করবে, বিশেষণে-বিশেষায়িত করা হবে। বিগত সময়ের অনেক প্রাক্তন ছাত্রনেতার মত মূল¯্রােতধারা থেকে আমাকেও হারিয়ে যেতে হবে! সেই বাস্তবতা পুনরাবৃত্তি ঘটুক আমি সেটা প্রত্যাশা করি না। সেকারণে অধ্যয়ন-অনুশীলন-বাস্তবায়ন অধিকতর প্রয়োজন মনে করি এবং প্রতিটি সংগ্রামী জীবনে সেটা অপরিহার্য।
আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে খালি চোখে দেখলে ভুল করা হবে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে দেখতে হবে, বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। এটা কি খুব কঠোর হলো না? মোটেই না। তথ্যানুসন্ধান না করলে কথা বলার অধিকার নেই, যদি তুমি কোন সমস্যার তথ্যানুসন্ধান না কর, তাহলে তার সম্পর্কে কথা বলার অধিকার থেকে তুমি বঞ্চিত হবে। যখন তুমি একটা সমস্যার গভীরে গিয়ে খোঁজ করনি, তার বর্তমান অবস্থা এবং তার বিগত ইতিহাস অনুসন্ধান করনি এবং তার অন্তর্নিহিত গুণাগুণের কোন জ্ঞান আহরণ করনি, তখন সে সমস্যা সম্বন্ধে তুমি যা বলবে, নি:সন্দেহে সে সবই বাজে। কাজেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর আমিও যদি হারিয়ে যায় তাহলে এই সংগঠনের নীতি-আদর্শ আমি গ্রহণ করতে পারিনি বলে আমাকে স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিতে হবে। সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেকার ভুল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম অথবা নিজের মধ্যেকার ভুল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারেনি, পারিবারিক সমস্যার মধ্যেই অর্থনৈতিক সমস্যা নিহিত- এধরনের অনেকগুলো অজুহাত দেখানো হয়। অথচ রাজপথের সামনের সারিতে বিশাল ছাত্র সমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছে, বুঝিয়ে বলার পদ্ধতি অনুসরণ করে অগণিত ছাত্রদের সংগঠনে নিয়ে এসেছে, পার্টির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে তৈরি করেছে, বজ্রকন্ঠের মাধ্যমে ছাত্র সমাজের তারুণ্যে শক্তিকে উজ্জীবিত করেছে বারবার। তাদেরকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে আজ দেখা মেলে না, দোদুল্যমানতায় তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয়েছে পরবর্তীতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেদের পৃথিবীতে নিজেরাই হারিয়ে গেছে।
জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে তারাও পরাজিত এক সৈনিক হিসেবে জুম্ম জাতির ইতিহাসে নিজেদের স্থান দখল করে নিয়েছে। এই সংগঠনের চিন্তাধারাকে সত্যিকারভাবে চিনতে পারেনি, জানার ইচ্ছাও রাখেনি। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সম্পর্কে নীতিবাচক কথা বলা বা আজেবাজে মন্তব্য করা তাদের কোন অধিকার নেই বলে আমি মনে করি। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সম্বন্ধে যে দুর্বলতা ছিল, সে দুর্বলতাকে প্রগতিশীল শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেনি। প্রিয় ছাত্র সংগঠনের প্রতি ভালবাসার যোগ্যতা তারা হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সম্পর্কে গদবাঁধা মন্তব্য করার অধিকার থেকে হারিয়ে যাওয়া ছাত্র বন্ধুদের বঞ্চিত করা মোটেই কঠোর হতে পারে না। এটা কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, সকলের জন্য প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। কারণ যারা চলে যায় তারা একটি অংশ প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে; যেমন বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিভেদপন্থী দলে যোগ দিয়ে জাতির অস্তিত্বকে বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রের কাজে যুক্ত হয়ে নিজেকে জাহির করে বলে, আমি পিসিপির এই ছিলাম, সেই ছিলাম, অথবা পিসিপির এটা করতে হবে, সেটা করা উচিত, পিসিপির এটি করা ঠিক নয় ইত্যাদি অবাস্তব যুক্তি উপস্থাপন করে নিজেকে শান্তনা দিয়ে প্রশান্তি লাভ করে। আবার অনেক বন্ধুকে বিগত জীবনের গ্লানিভরা হীনতার লজ্জার দগ্ধানি সইতে না পেরে আত্মসমালোচনা করে করে যন্ত্রণাভরা অনুশোচনায় ভুগতে দেখা যায়।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জুম্ম জাতির ভবিষ্যৎ। এটা কথার কথা নয়! এই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে অনেক সময় লেগেছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে-শতশত বাধা ডিঙিয়ে আজ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ একটা সংগ্রামের প্রতীক রূপে আবির্ভূত হয়েছে। একটা মহান আদর্শকে বুকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে বারবার। প্রথম থেকেই তোমাকে নিয়ে আমার লেখালেখির প্রতি একটু দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতায় আমাকে সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যুগিয়েছে বারবার। সামনে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা, সাত সাগর তের নদী পাড়ি দেওয়ার মত জাহাজে উঠার ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। যেই জাহাজের হাল ধরেছিল প্রয়াতনেতা এম এন লারমা ও বর্তমান জীবন্ত কিংবদন্তী সন্তু লারমা। এই জাহাজে আমি সাধারণ একজন সদস্য হয়ে জুম্ম জাতিকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত। সেটার জন্য করতে হবে অক্লান্ত পরিশ্রম। মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় বস্তুর যা কিছু পরিবর্তন ও বিবর্তন হয়েছে, মানব সভ্যতা অগ্রগতির দিকে এগিয়েছে সমাজ ব্যবস্থা সেখানেই পরিশ্রম ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। সেজন্যে শ্রমকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে, আপন করে নিতে হবে। এখানে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য যে, মানবসমাজ ক্রমবিকাশের ধারায় উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মানুষের সত্যিকার বাস্তব জ্ঞান। এই মহান জ্ঞানের অধিকারী হয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে আগামী দিনে বিশাল পাহাড়ি ছাত্র সমাজ ও জুম্ম জাতিকে নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামী দিনে জুম্ম জাতির কি হবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটার নির্ণায়ক শক্তিরূপে আবির্ভূত হবে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ। তারাই নির্ধারণ করবে জুম্ম জাতির অদূর ভবিষ্যতের পথচলা। বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর শোষণের শৃঙ্খল ভাঙবে, নাকি তাদের কাছে পরাজয় মেনে নেবে। সিদ্ধান্ত একান্ত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিশাল কর্মী বন্ধুদের। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নীতি-আদর্শ কতটুকু কর্মী বন্ধুরা ধারণ করেছে, সেই অনুযায়ী জুম্ম জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে, তারা কতটুকু ত্যাগী ও সংগ্রামী তার উপর নির্ভর করবে, জুম্ম জাতির সত্যিকার পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি।
২৮ বছর দীর্ঘ এই লড়াই সংগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অকুতোভয় বীর সেনানীরা তাদের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়েছে বার বার। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর তাক করা রাঙা বেয়নেট আর বন্দুকের বুলেটকে বুকে আলিঙ্গন করেছে সাহসের সাথে। ভরদ্বাজমনি ৭০ বছর বয়সে ভরা তারুণ্যের জীবন সঞ্জীবনী নিয়ে ছাত্র সমাজের আত্মবলিদানকে উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। সেই পথেই জীবন সমর্পিত করেছিলেন অমর বিকাশ, ক্যজাই মারমা, লাল রিজার্ভ বম, রূপম, সুকেশ, মনতোষ, সনজিৎ তঞ্চঙ্গ্যা, মংচসিং মারমা, পেসকা মারমাসহ আরো অনেকে। সেই সাথে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক গেরিলা যুদ্ধের সময় হারিয়েছি প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ শত শত বীর শহীদদের। সেইসব বীর আত্মত্যাগীদের বীরত্ব গাঁথাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে স্মরণ না করলে আমাকে অকৃতজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হবে। তাদের এই আত্মবলিদান জুম্ম জাতির অস্তিত্ব ও জন্মভূমি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে গৌরবান্বিত করেছে। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই রক্তের ¯্রােতধারা প্রজন্ম হতে প্রজন্মে বহমান থাকবে। জীবন উৎসর্গকারী এই ধারা অনুসরণ করে এখনো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তার পথ চলা অব্যাহত রেখেছে। এখনো স্বপ্ন দেখে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ, স্লোগানের উত্তাল মিছিল, প্রতিরোধের হাজারো কন্ঠের গগণবিদারী রণধ্বনিতে প্রকম্পিত হবে পাহাড়ের রাজপথ ও গিরিশৃঙ্গ। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সমবেত হয়ে পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে পৃথিবীর মহান আদর্শকে বুকে নিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। যতদিন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজয়ের ইতিহাস মিলবে না পাহাড়ি ছাত্র সমাজ নিপীড়িত জুম্ম জাতি ও মানুষের মুক্তির গান গেয়ে যাবে ততদিন।