জাতীয়

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকায় আগামীকাল আদিবাসী ছাত্র যুবদের মিছিল ও সমাবেশ

হ্লামংচিং মারমা, ঢাকা: আগামী ২ ডিসেম্বর ২০২৩, ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছর পূর্ণ হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকারহারা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর উপর অব্যাহত থাকা অন্যায়-অত্যাচার,নির্যাতন-নিপীড়ন, ধর্ষণ-গণহত্যা, জুম্মদের ভূমি বেদখল, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ পার্বত্য সমস্যাকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের জন্য দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়ীরা সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। এই সংগ্রাম ছিল কখনো নিয়মতান্ত্রিক আবার কখনো রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াই। দীর্ঘ দুই যুগেরও সশস্ত্র সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত‍্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চটগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এর চার খন্ডের ৭২টি ধারা সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়।

এই চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ ২৬ বছরেও সরকার পার্বত‍্য চুক্তির অধিকাংশ মৌলিক ধারা এবং চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করেনি বলে জনসংহতি সমিতি অভিযোগ করে এসেছে এবং তার জন্য এখনো আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। চুক্তি পরবর্তী সময়ে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল আওয়ামীলীগ তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে আছে। এদিকে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন । জনসংহতি সমিতি ও বিশিষ্টজনরা অভিযোগ করছেন, “সরকার টানা ক্ষমতায় থাকলেও মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেনি বরঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ চুক্তি পরিপন্থি এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।”

সরকার সর্বশেষ দাবী করেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত ও ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে উল্লেখ করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিবাসীদের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল জনসংহতি সমিতি বলছে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, অবশিষ্ট ২৯টি ধারা সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত, অবশিষ্ট ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার চুক্তির নানা ধারা লঙ্ঘন করে চলেছে।

এদিকে পার্বত্য চটগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় বর্তমান পার্বত‍্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্তিতি অত‍্যন্ত নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে, দীর্ঘ ২৫ বছরে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক একের পর এক চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা ষড়যন্ত্র ও কার্যক্রমের কারণে পার্বত‍্য চট্টগ্রামের অধিবাসী ও ভূমিজ সন্তান জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। সরকার ও বহিরাগত গোষ্ঠীর নির্মম, ঔপনিবেশিক ও সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসনের কবলে পড়ে জুম্ম জনগণের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ভূমি অধিকার আজ প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে।

এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে আগামীকাল (২৯ নভেম্বর) বুধবার, সকাল ১০.৩০ মিনিটে আদিবাসী ছাত্র সংগঠন সমূহ ঢাকার শাহবাগে, জাতীয় জাদুঘরের সামনে ছাত্র ও যুব সমাবেশের ডাক দিয়েছে। আয়োজকরা আইপিনিউজকে জানিয়েছেন, সমাবেশের পর চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে একটি মিছিলও করা হবে।

আইপিনিউজের পক্ষ থেকে ছাত্র ও যুব সমাবেশে আয়োজকদের সাথে যোগাযোগ করা হলে আয়োজকদের অন্যতম এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ বলেন,
দীর্ঘ ২৬ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূলধারাগুলো বাস্তবায়িত হল না। আমরা রাষ্ট্রকে বার বার বলেছি পাহাড়ের মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ও শান্তি ফেরাতে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

তিনি চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে অভিমত জানিয়ে বলেন, বর্তমানে যে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় তাঁদের কর্তৃক গঠিত জাতীয় কমিটি এবং জনসংহতি সমিতির চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু সরকার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখালো না। ফলে আমরা আদিবাসী যুবরা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সামনে নির্বাচন আসন্ন। তবুও এই চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো খবর নেই। তাই এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে আমরা রাষ্ট্রকে আবারো জানিয়ে দিতে চাই যে, চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে আদিবাসী ছাত্র ও যুব সমাজ জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে যে কোন আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত বলে হুশিয়ারি দেন। এছাড়াও তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন করছেনা সরকার। পার্বত‍্য এলাকায় পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটাতে এবং পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। অন‍্যথায় পাহাড়ে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে সরকার দায়ী থাকবে।

এদিকে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল (বিএমএসসি ) এর সাধারণ সম্পাদক অংশৈসিং মারমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন অতীব জরুরী। পার্বত‍্য চট্টগ্রামে যত নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে এর পিছনে কোনো না কোনোভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রসঙ্গটি জড়িত। তাই পাহাড়ের এই প্রজন্মের একজন তরুণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের একজন হিসেবে মনে করি- পার্বত‍্য চট্টগ্রামের উদ্ধুত সমস্যাগুলোর সমাধানে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন অতীব জরুরি। এজন্য আমরা আগামীকালকের সমাবেশটির মাধ্যমে আপামর মানুষকে এই বার্তাটি জানিয়ে দিতে চাই।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনে ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি চন্দ্রিকা চাকমা বলেন, পাহাড়ের সমস‍্যা রাজনৈতিক সমস‍্যা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে আজ পাহাড়ে শাসক গোষ্ঠীর দমন-পীড়ন, মিথ্যা মামলা, হামলা, জেল-জুলুম সহ পাহাড়ী মানুষদের উপর নির্যাতন এখনো অব্যাহত আছে। সে অব্যাহত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আগামী দিনের আন্দোলন জোরদার করার শপথ নিতে চাই এবং জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে ছাত্র-যুবদের যে ঐতিহাসিক দ্বায়িত্ব তা পালনের জন্যই আমরা সমাবেশ করতে যাচ্ছি। আয়োজকরা সকল আদিবাসী ছাত্র যুবাসহ প্রগতিমনা মানুষদেরকে সমাবেশে অংশগ্রহনের আহ্বানও জানান।

Back to top button