পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা দরকার: চট্টগ্রামে পার্বত্য চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি সভায় বক্তারা

আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়িদের জীবনে শান্তি ফিরে আসেনি। এ চুক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে একটি ঐতিহাসিক অর্জন ছিল। পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা দরকার।” চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আজ ১ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রামে র্যালি, গণসংগীত পরিবেশন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আয়োজিত অনুষ্ঠানটি নগরের জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে বিকেল ২:০০ ঘটিকায় শুরু হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি, চট্টগ্রামের আহ্বায়ক তাপস হোড় মহোদয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় প্রধান উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন মহোদয়।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি প্রকৌশলী পরিমল কান্তি চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রামের সভাপতি অশোক সাহা, কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অজিত দাশ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. প্রদীপ কুমার চৌধুরী, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল বিকাশ চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নরেশ চাকমা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি দিশান তঞ্চঙ্গ্যা এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পিসিপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সহ-সভাপতি বিনিময় চাকমা। আলোচনা সভার শুরুতে গণসংগীত পরিবেশনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবুল মোমেন বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়িদের জীবনে শান্তি ফিরে আসেনি। এ চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গণে একটি ঐতিহাসিক অর্জন ছিল। যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ শান্তিতে থাকতে চেয়েছিল তখন একটি স্বার্থান্বেষী মহল এটিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পায়তারা চালায়। এরশাদের আমলে সমতল এলাকা থেকে বাঙালি এনে পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করানো হয়। এর ফলে পার্বত্য এলাকার জনগণ তাদের অস্তিতের সংকটে পড়ে যায় এবং তাদের ভূমি হারায়। জুম চাষের উপযোগী জমিগুলো দখল হয়। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যাকে স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারকে চুক্তির বাস্তবায়ন করা জরুরি। এভাবেই কেবল পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনে শান্তির সুবাতাস মিলবে।”
প্রকৌশলী পরিমল কান্তি চৌধুরী বলেন, “চুক্তির ২৬ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ আজও অধিকারহীন। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি হলেও তা যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ আজ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।”
অশোক সাহা বলেন, “বাংলাদেশে বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। কিন্তু এসব আদিবাসীদের সরকার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান ও তাদের নায্য অধিকার বাস্তবায়ন করেনি। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত চুক্তি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার সুযোগ থাকলেও এর অধিকাংশ মৌলিক ধারা বাস্তবায়িত হয়নি। তরুণ ছাত্রসমাজকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠতে হবে এবং শোষণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামিল হওয়া সময়ের দাবি।”
হাফিজ রশিদ খান বলেন, “দীর্ঘ দুই যুগের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে।কিন্তু বর্তমান সরকার মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেনি। তার জন্য কঠোর আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে সরকারকে আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ে বাধ্য করতে হবে।”
আনন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, “পার্বত্য চুক্তি পাহাড়ি জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রেখে তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার এক উপায়। কিন্তু আজও এই চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। তাই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও প্রগতিশীল মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।”
অজিত দাশ বলেন, “পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের দফায় দফায় আলোচনায় বসা জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন নীতি চুক্তি বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা। এজন্য এই নীতিও অতিদ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়াও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবীদের চুক্তি বাস্তবায়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।”
প্রদীপ কুমার চৌধুরী বলেন, “সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার ও জাতীয় অস্তিত্বকে অন্তর্ভূক্ত না করায় আদিবাসীদের জীবন সংকটে পড়েছে। পাহাড়ি জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের এই আন্দোলন যৌক্তিক যেভাবে আমাদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলন আমাদের জন্য যৌক্তিক ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন জরুরি।”
অনিল বিকাশ চাকমা বলেন, “জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার রক্ষার সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। চুক্তির পূর্বে জুম্ম জনগণ যেমন রক্ত দিয়েছিল তেমনি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য জুম্ম জনগণ রক্ত দিতে প্রস্তুত।” এছাড়াও তিনি দেশের সুশীল সমাজ, প্রগতিশীল ছাত্র-যুবদের চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার জন্য আহ্বান জানান।
সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর জনসংহতি সমিতি ও সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্ত এই চুক্তির ২৬ বছর পরও তা যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার যদি অতিদ্রুত চুক্তি বাস্তবায়ন না করে তাহলে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।”
সংহতি বক্তব্যে রবীন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, “পাহাড় ও সমতলে প্রতিনিয়ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি বেদখল, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানামুখী সহিংসতা বেড়ে চলেছে। এইসব সহিংসতা আদিবাসীদের জীবনযাপনকে ক্রমশ জটিলতার দিকে নিয়ে তাদেরকে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
নরেশ চাকমা বলেন, “চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬টি বছর অতিক্রম হলেও চুক্তির বেশ কিছু দাবি অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। পার্বত্য চট্টগ্রামে দিন দিন সেনা শাসন বেড়েই চলেছে এবং জুম্ম জনগণকে নানামুখী চাপের মুখে রাখা হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করতে সরকার চুক্তিবিরোধী নানা গোষ্ঠী সৃষ্টি করছে। চুক্তির পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প কমেনি। চুক্তি অনুযায়ী ভুমি কমিশন গঠন করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধান হয়নি। সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা।”
স্বাগত বক্তব্যে দিশান তঞ্চঙ্গ্যা বলেন,”১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। আওয়ামীলীগ সরকার নির্বাচনের আগে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়নের আগ্রহ দেখায় যায় না।”
সভাপতির বক্তব্যে তাপস হোড় বলেন,”পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও অধিকাংশ মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তার জন্য পাহাড়ি জনগণকে রুখে দাঁড়িয়ে কঠোর আন্দোলন করতে হবে। পাহাড়ি আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য পাবর্ত্য চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করাটা জরুরি।”
সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য যে, আলোচনা সভার আগে নন্দনকানন থেকে প্রেসক্লাব হয়ে জেএম সেন হল পর্যন্ত র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।