পার্বত্য চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন চান দেশের ৪১ বিশিষ্ট নাগরিক: আট দফা দাবি পেশ

আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন চান দেশের ৪১ বিশিষ্ট নাগরিক। আজ এক বিবৃতিতে তাঁরা এই দাবী জানান। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে দেয়া উক্ত বিবৃতিতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষে ৮ দফা দাবিসহ সকল প্রকার বাধা অপসারণ করে অতিদ্রুত সুনির্দিষ্ট সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করার আহ্বানও জানিয়েছেন বিবৃতিদাতা নাগরিকরা।
আজ (৩০ নভেম্বর) বিশিষ্ট এই নাগরিকগণ যৌথ স্বাক্ষরে তাঁদের এই যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। নাগরিকবৃন্দ বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, ‘এ বছরের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির মধ্যে এ ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, চুক্তির ২৫ বছরের মাথায় এসেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি হয়নি। চুক্তির কয়েকটি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে যেমন পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন, জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রভৃতি। তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারা (যেমন ভূমি, সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন) বাস্তবায়িত করার কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি বরং নানা অজুহাতে তা বিলম্বিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে এটা খুবই দু:খজনক যে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল আওয়ামীলীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরেও চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবার কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলো না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য অটুট রাখার অভিপ্রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে আমরা লক্ষ করেছি যে, সর্বশেষ জনশুমারীর তথ্য অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমিতির অনুপাত পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রতিকূলে বদলে যেতে শুরু করেছে।
বিবৃতিতে নাগরিকরা আরো উল্লেখ করেন যে, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ পাস হলেও এ আইন বাস্তবায়নের জন্য এখনো বিধিমালা না হওয়ায় কমিশন যথাযথভাবে কাজ শুরু করতে পারছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনকে অকার্যকর করে রাখা ও তাদের নিষ্ক্রিয়তায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি তাদের নিয়মিত সভা স্বার্থন্বেষী মহলের বাধার কারণে একাধিকবার স্থগিত করতে হয়েছে। এব্যাপারে পার্বত্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের নীরবতা খুবই দু:খজনক।”
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “চুক্তি মোতাবেক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদই সেখানকার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কথা ছিল। প্রয়োজনীয় নূন্যতম বাজেট এবং লোকবল না থাকায় সেই আঞ্চলিক পরিষদ তার চুক্তি নির্ধারিত কোন দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। চুক্তি মোতাবেক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কার্যক্রম আঞ্চলিক পরিষদের অধীনে রেখে পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘ ২৫ বছরেও এ পরিষদগুলোর নির্বাচন না করে সরকার মনোনীত ব্যক্তিদের সেখানে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। যে সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব জেলা পরিষদের কাছে চুক্তি অনুযায়ী হস্তান্তরের কথা, তাও করা হয়নি।
১৯৯৭ সালের স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রধানতম দর্শন ছিল পাহাড়ের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। সরকার নিরাপত্তার চশমা দিয়ে পাহড়ের সমস্যাকে দেখার পুরোনো কৌশলে ফিরে যাওয়ায় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এখানের পাহাড়ি জনগনের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে স্থানীয়ভাবে সামরিক কর্তৃপক্ষের শাসনই বহাল রাখা হচ্ছে, যা চুক্তির পরিপন্থী।

চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং সকল উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগনকে সম্পৃক্ত করার কথা থাকলেও এতবছরেও তা করা হয়নি। অপরদিকে মানবাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তি ও কর্মীদের বিরুদ্ধে মনগড়া ও অসত্য অভিযোগ তুলে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলছে।”
বিবৃতিতে সরকারী প্রশাসনের একটি শক্তিশালী মহল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগের কথা তুলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ ধরনের জনবিরোধী ও চুক্তিবিরোধী কার্যকলাপের আমরা তীব্র নিন্দা জানানো হয়।
বিবৃতিতে পূর্বতন সামরিক সরকারের প্রণীত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেটেলার বাঙ্গালীদের বসিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ আয়োজন থেকে সরে আসারও আমরা দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হয়-
১. চুক্তিতে প্রস্তাবিত সকল অঙ্গীকারের পূর্ণবাস্তবায়ন (যেমন ভূমি, পর্যায়ক্রমে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন) করতে হবে।
২. ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন যথাযথভাবে কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় বাজেট, লোকবল এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারের দৃশ্যমান সমর্থন জোরদার করতে হবে।
৩. চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যে কয়টি সেনানিবাস ছিল, যার কথা চুক্তিতেও উল্লেখ আছে সেগুলো বহাল রেখে বাকি সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে পার্বত্য এলাকায় নাগরিকদের জন্য স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
৪. আইনশৃংখলা পরিস্থিতির নামে একতরফা পাহাড়িদের দায়ী করার মানসিকতা পরিহার করে কোন সহিংসতার ঘটনা ঘটলে তার স্বাধীন স্বচ্ছ নিরেপক্ষ তদন্তের জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে উচ্চ আদালতের কোন বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু বিশ^াসযোগ্য তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদকে চুক্তির বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ক্ষমতা, বাজেট এবং দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. পার্বত্য এলাকায় যেসকল বহিরাগত বাঙ্গালীদের সেটেলার হিসেবে বসানো হয়েছে তাদেও স্ব স্ব জেলা বা এলাকায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এদের পুনর্বাসনের জন্য জাতীয় বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ দিতে হবে।
৮. সম্প্রতি পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০ বিরোধিতার জন্য একটি মহল সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট রায় থাকার পরেও নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এব্যাপারে সরকারকে চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০ এর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করতে হবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতা বিশিষ্ট নাগরিকগণ হলেন সুলতানা কামাল, খুশী কবির, প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, ড. মেঘনাগুহ ঠাকুরতা, রাণা দাশগুপ্ত, প্রফেসর মেজবাহ কামাল, সুব্রত চৌধুরী, কাজল দেবনাথ, অ্যাড. জেড আই খান পান্না, তবারক হোসেইন, পারভীন হাসান, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. আবুল বারকাত, রাহনুমা আহমেদ, শামসুল হুদা, ড. ইফতেখারুজ্জামান, রোবায়েত ফেরদৌস, বদিউল আলম মজুমদার, সঞ্জীব দ্রং, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. শহিদুল আলম, ড. হামিদা হোসেন, শিরিন হক, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, জাকির হোসেন, শাহীন আনাম, রাশেদা কে চৌধুরী, ড. স্বপন আদনান, ড. সুমাইয়া খায়ের,রেজাউল করিম চৌধুরী, মো: নুর খান, দীপায়ন খীসা, নোভা আহমেদ, ড. মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান, জোবাইদা নাসরীন কণা, পল্লব চাকমা, রেজাউল করিম লেনিন, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, ফারাহ তানজীন তিতিল, হানা শামস আহমেদ, লেলুং খুমী।


