সাক্ষাৎকার

পার্বত্য চট্রগ্রামের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী রনজিত দেওয়ানের সাক্ষাৎকার

রনজিত দেওয়ান ১৯৫৩ সনের ৮ আগস্ট রাঙ্গামাটির রাঙ্গাপানি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সনে রাঙ্গামাটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তাঁর কর্মজীবনের শুরু ১৯৭৭ সনে থেকে জেলা গণসংযোগ দপ্তরে ভ্রাম্যমান পল্লীর গায়ক হিসাবে। তিনি ১৯৭৮ সন থেকে ১৯৮১ সন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের পাহাড়িকা অনুষ্ঠানেও কাজ করেন। তিনি মোনঘর আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বর্তমানে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছাত্র জীবনে তিনি তৎকালীন পাহাড়ি ছাত্র সমিতির কেন্দ্রীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি একজন গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। আদিবাসী চাকমাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বেতার শিল্পী। তিনি ১৯৭৩ সনে ঢাকায় বাংলাদেশ বেতার ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে এবং ১৯৭৪ সনে চট্টগ্রাম বেতারে লোক সংগীত অনুষ্ঠানে সর্ব প্রথম চাকমা গান পরিবেশন করেন। এতদ্ঞ্চলে চাকমা গান ও ধর্মীয় গানের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রদূত। তিনিই সর্বপ্রথম চাকমা গানের ক্যাসেট বের করেন। তাঁর চাকমা গানের ক্যাসেটের সংখ্যা ২টি এককসহ ৮ এবং ধর্মীয় গানের ক্যাসেটের সংখ্যা ৪টি এককসহ ৭। তিনি গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠি ও গিরিঝংকার শিল্পীগোষ্ঠির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তিনি সংগীত, নৃত্য ও চারুকলা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ফিবেক একাডেমীর প্রধান উপদেষ্টা। তিনি চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী বিজু নৃত্যের উদ্ভাবক এবং বিভিন্ন সময়ে বিটিভি, সিটিভি, এনটিভি ও একুশে টিভিতে সংগীত পরিবেশন করেছেন। ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির প্রেক্ষাপটে তাঁর রচিত ও সুরারোপিত ‘চেঙে-মেইনী-কাচালং’ গানটি দেশ-বিদেশে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এতদ্ঞ্চলে ধর্মীয় চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রেও তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গুনী শিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করেন। তৎমধ্যে ফিবেক একাডেমী ও রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমী উল্লেখযোগ্য।

ইন্টু মনি তালুকদারঃ নমস্কার আপনি কেমন আছেন?
রনজিত দেওয়ানঃ ভালো আছি।
ইন্টু মনি তালুকদারঃ ক’বছর বয়স থেকে গানে মন গেল। গানের জন্যে আশপাশের পরিবেশে কাউকে কি ওস্তাদরূপে পেয়েছিলেন? তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলুন। পারিবারিক পরিবেশ কি আপনার গান করার পক্ষে সহায়ক ছিল?
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ একদম ছোট বেলায় মানে ৬/৭ বছর বয়স থেকে গানের প্রতি অদম্য কৌতুহল জন্ম নেয়। সে বয়সে রেডিও কিংবা গ্রামোফোনে গান শুনে গুন গুন করার চেষ্টা করতাম। আর অবাক হয়ে ভাবতাম এত সুন্দর সুন্দর গান কারা কোথা থেকে কিভাবে গায়? যদি দেখতে বা জানতে পারতাম! মজার ব্যাপার গ্রামোফোন রেকর্ড গান যখন বাজতো, গ্রামোফোনের এক পাশে গর্তের মত জায়গা ছিল (যা হাতে ঢুকানো যাওয়ার মত) তাতে মাথা নীচু করে চেয়ে দেখতাম কারা ভিতরে গান করছে আর কিভাবে ছোট জায়গার মধ্যে এত জন আছে? খুবই বিস্ময় বোধ করতাম। অবচেতন মনে গানের দিকে মন ঝুঁকে পড়ে। আরো মজার ব্যাপার যে যখন ১৯৬১ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি আমার এক আত্মীয়া বিয়ের সময় ‘‘ভারতীয় বাংলা গান’’ নামে একটি গানের বই উপহার পেয়েছিলেন। ঐ গানের বইটি থেকে পছন্দমত গান দেখে দেখে নিজেই সুরকরে গাইতাম। জানাছিলনা যে ঐ গান গুলো সুরকরা এবং রেকর্ডকৃত ভাবলে হাসি লাগে তখন হারমোনিয়াম বাজানো দূরের কথা, চোখেও ভালেভাবে দেখিনি।
স্মরণযোগ্য যে, ১৯৬১/৬২ সনে তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় Pakistan Arts Council ছিল বর্তমানে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পশ্চিম পার্শ্বের স্থানটিতে। ওখানে প্রায় সময় নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হতো। সে সময় জয়শ্রীরায়, তৃপ্তি তালুকদার, জয়তী রায়, বিমলেন্দু দেওয়ান প্রমুখ শিল্পীরা রাঙ্গামাটি ছোট্র শহরটিকে গানে মাতিয়ে রেখেছিলেন। তাঁদের গান শুনতে যেতাম। পিচ্ছি বলে কেউ পাত্তা দিতনা, এমনকি দয়াকরে কেউ ঢুকতেও দিত না। বাইরে থেকে কেবল গান শুনে দুধের স্বাদ খোলে মিটাতাম। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ‘‘আমিও একদিন গান করবো। আমাকেও একদিন হাজার জনতায় দেখবে! আমার গান শুনবে।’’ সে সময়ে শ্রদ্ধেয় সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সুনীতি বিকাশ বড়ুয়া, কল্যাণ মিত্র বড়–য়া, হিমাংশু বিশ্বাস উনাদের নিকট হতে যা পারি অল্প-সল্প শিখে ছিলাম। এখানে বলি যে, আমি কোন বড় শিল্পী নই, সঙ্গীতে আমার তেমন কোন জ্ঞান নেই। তখন বর্তমান সময়েরমত গান শেখার সুযোগ কম ছিল। পারিবারিক পরিবেশে প্রথম দিকে গান শেখার পরিবেশ ছিলনা। অনেক পরে কিছুটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়; তাও সংগ্রাম করে।
 (উনারা স্ব-স্নেহে যত্ন সহকারে শিখাতেন। আমরা যারা শিখতাম শ্রদ্ধা করতাম। তখন আলাদা একটা আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল যা এখন বড় একটা দেখা যায়না) গানের সাথে তবলা শিখছি জেনে বাবা ত্যাজ্য পুত্র করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমিও দমবার পাত্র ছিলামনা। দু’দিন অনশন করলে শেষ পর্যন্ত মত দিতে বাধ্য হন।

ইন্টু মনি তালুকদারঃ মা-বাবাসহ পারিবারিক পরিচিতি বর্ণনা করুন। কৈশোর তারুণ্যে কি গান নিয়ে কোনো উন্মাদনা বা মেতে থাকার ঘটনা স্মরণে আসে? এই সংশ্লিষ্ট বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ীদের কথা বলুন।
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ ১০২নং রাঙ্গাপানি মৌজার অর্ন্তগত কাটাছড়ি নিবাসী গুজঙ্যে কার্বারীর কন্যাসন্তান কালিন্দী, পুত্রসন্তান জয় মুনি। রাজা ধরম বক্স খাঁ কালিন্দীকে রাণী করলে হন কালিন্দী রাণী। রাজা ধরম বক্স খাঁ (আমার ভুল না হলে) গুজঙ্যে কার্বারীকে দেওয়ান উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ১০২ নং রাঙ্গাপানি মৌজাটির হেডম্যান করেন। সেই থেকে কাপ্তাই বাঁধের আগ পর্যন্ত বংশ পরস্পরায় রাঙ্গাপানি মৌজাটি আমাদের ছিল যা বর্তমানে ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় হেডম্যান হিসাবে আছেন। গুজঙ্যে দেওয়ানের পুত্র সন্তান জয়মুনি দেওয়ানের দু’টি পুত্র সন্তান ১) কমলা কান্ত দেওয়ান ২) চন্দ্র কান্ত দেওয়ান। যা বড় দেওয়ান ও ছোট দেওয়ানের চার মেয়ে ও চার ছেলে ছিল। তার মধ্যে মেজো মেয়ে ভূবন মোহন রায়ের প্রথম সহ ধর্মীনি রাণী দয়াময়ী। চার পুত্র সন্তানের মধ্যে যথাক্রমে ১। জয় কুমার দেওয়ান ২। বিজয় কুমার দেওয়ান ৩। যোগেন্দ্র কুমার দেওয়ান ও ৪। রাজ কুমার দেওয়ান। ব্রিটিশ আমলে মৌজা পরিচালনার সুবিধার্থে আমার পিতা যোগেন্দ্র কুমার দেওয়ান রাঙ্গাপানিতে এসে বসতি স্থাপন করেন। সে অবধি আমরা রাঙ্গাপানিতে বসবাস করছি। তিনি ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯০ সালে পরলোক গমন করেন। মাতা লালনা দেওয়ান। ৬ ভাই ৫ বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। বোনদের মধ্যে বড় দুই বোন মারা গেছেন। সবার ছোট বোন এবং তৃতীয় ভাই কানাডা প্রবাসী। বাকীরা বিভিন্ন পেশায় রত আছে।
নির্দ্দিষ্ট কোন একটি গান নিয়ে উন্মাদনা নয় বরং সর্বদাই গান নিয়ে নেশা বা উন্মাদনা ছিল। যেমন- পাঠ্য বইয়ের পড়া মুখস্ত হলেই টেবিল চাপড়িয়ে গুন গুন করা, ভাত খাওয়ার সময় গান, স্নান করতে গেলে গান, কোথাও বেড়াতে গেলে পথে গান এই রকম আরকি! মনে সব সময়ই ভাবনা ছিল একদিন গানের শিল্পী হবো। মাথায় চিন্তা খেলতো অন্যেরা গানলিখতে পারলে আমি কেন লিখতে পারবো না। অন্যেরা সুর করতে পারলে বা গাইতে পারলে আমি কেন পারবো না। গানের ক্ষেত্রে আমার আদর্শ হলেন ভূপেন হাজারিকা। প্রেরনা হলেন জনগণ এবং তাঁদের ভালবাসা। মেহেদী হাসান, মো: রফি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, মান্নাদে, শ্যামল মিত্র, লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে এঁরা হলেন গানের প্রেরণার উৎস শিল্পী হিসেবে । লক্ষ্য ছিল একটাই গান গেয়ে জাতিকে জাগাবো শুভানুধ্যায়ি হিসাবে একজনের কথাই বেশ্রী বার বার বলতে হয়- তিনি হলেন কুমার নন্দিত রায় (রেণী বাবু) এর শাশুড়ী মা মিসেস প্রতিমা চাকমা (হুক্কিমা)। আপন ছোট ভাই এর মত অত্যন্ত স্নেহ করতেন। দু’তিন দিন গান করতে না গেলে তাঁর ছেলে বা মেয়েকে দিয়ে ডেকে পাঠাতেন। গেলে জিজ্ঞেস করতেন ‘‘এতদিন কোথায় ছিলে? গান করতে আসনি কেন? যাও হারমোনিয়াম নিয়ে বস। তোমাকে একদিন বড় শিল্পী হতে হবে।’’ আমার জন্মদাত্রী মাও এরকম উৎসাহ কোনদিন দেননি। দিদির স্ব-স্নেহে ভরা আশা হয়তো পূরণ করতে পারিনি। তিনি আমায় ক্ষমা করুন। তাঁর আতœা শান্তি লাভ করুক। যেখানেই জন্ম গ্রহণ করুন সুখী হোন। গানের প্রসঙ্গ আসলে অবশ্যই আর এক জনের কথা বলতে হয়। তিনি হলেন বিশিষ্ট হস্তরেখাবিদ মি: চাচ্চি। ঘটনাটা সংক্ষেপপে বলি, ১৯৭৫ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে চোখের চিকিৎসার্থে চট্টগ্রাম শহরে যাই। কাজসেরে পরেরদিন সকালে রাঙ্গামাটি ফেরার উদ্দেশ্য কাউন্টারে টিকিট কাটি। গাড়ী ছাড়ার ঘন্টা খানেক দেরী ছিল। সেখানে নিশিধন (পিত্তর) এবং আনন্দ বাবুর (ওগোলছড়ীর হেডম্যান চিত্ত বাবুর ছোট ভাই) সাথে দেখা হয়। বিশ্রামের জন্য উনাদের সাথে হ্যাপীলজে চার তলায় উনাদের কামরায় যাই। ওখানে মি: চাচ্চি এর সাথে দেখা হয়। নিশিধন ও আনন্দ বাবুর হাত দেখার পর অনেকটা জোর করে আমার হাত দেখেন। আমার হাত দেখে বললেন সবই সত্যি ছিল। এবং বললেন আমি নাকি গানকরি। উনাকে বাজিয়ে দেখার জন্য উপস্থিত তিন জনেই বললাম- ‘‘আমি গান পারিনা।’’ চ্যালেঞ্জের মুরে বললেন উনার গনণা নির্ভুল। আজ পর্যন্ত মিথ্যে হয়নি উনার গনণা। নিশিধনকে দেখিয়ে দিয়ে বললাম ‘‘উনি গান করেন।’’ মাথা নাড়িয়ে বার বার বলতে লাগলেন নিশিধন নয়- আমি গান করি। গান না করলেও গানের গলা আছে। উঠে আসার সময় আমার হাত দুটো ধরে বললেন, বাবু আমার অনুরোধ রাখবেন? আপনার গানের গলা আছে। ওস্তাদের কাছে গান শিখুন, দেখবেন আপনার অনেক নাম হবে। একদিন আমাকে স্মরণ করবেন।’’

ইন্টু মনি তালুকদারঃ মুক্তিযুদ্ধকালে আপনার বয়স কত ছিল? কীভাবে দেখেন মুক্তিযুদ্ধকে? ৭০ দশকের প্রায় মাঝাপর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমিয়া জাগরণের আন্দোলনটা বেশ আলোচনায় চলে আসে গণমাধ্যমে। এ আন্দোলনে আপনার কোনো ভূমিকা বা অংশগ্রহণ ছিল কী? বিস্তারিত বলুন।
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৮/১৯ বছর। তখন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। তখনকার প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের ১১ দফা, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফাদাবী যথাযথ ছিল মনে করি। জুলফিকার আলীভুট্টো আর ইয়াহিয়াখান যদি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারতেন তাহলে এতবড় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হতো কিনা তা ভাববার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি। মোদ্দাকথা হলো চুড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং অবশ্যই সঠিক ছিল।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলে নাম হয় ‘‘গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।’’ দীর্ঘ পচিশ বছর গণতন্ত্র ছিলনা, জনগণের বাক স্বাধীনতা ছিলনা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্ম হলে কথাবলার অধিকার ফিরে পাই। তখন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন দাবী আদায়ের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে সে সময়ের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির পক্ষ থেকে তিনটি প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়। একদল বান্দরবান, দ্বিতীয় দল মারিশ্যা এবং তৃতীয় দল চেঙ্গী, মাইনী ভ্যালি গমন করে। তৃতীয় দলে আমিসহ ৬ জন ছিলাম। যথাক্রমে চাবাইমগ সভাপতি, পাহাড়ী ছাত্র সমিতি ও দলনেতা, শ্রী উষাতন তালুকদার (বর্তমান এমপি মহোদয়) সুবোধ বিকাশ (বর্তমান কানাডা প্রবাসী) জিতেন্দ্রীয় গুংগু, প্রমোদেন্দু (নুক্ক) (হৃদয় মার্কেটের মালিক) এবং আমি। প্রায় চৌদ্দ, পনের দিন চেঙ্গী ও মাইনী ভ্যালি সাংগঠনিক সফর করি। এই সাংগঠনিক সফরে একদিকে বক্তৃতা দিতে হতো তেমনি গানও করতে হতো আমাকে। এভাবে শুরু হয় আমার ছাত্র রাজনীতি। পরবর্তীতে জে, এস, এস পতাকা তলে রাজনীতি। একদিকে গান করতাম রাঙ্গামাটি ও এর বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অন্যদিকে গ্রামে গিয়ে সাংগঠনিক কার্য্যক্রম চালাতাম ও রাজনীতি গান করতাম। বিশেষ করে মারিশ্যায় মাইনীতে ও কয়েকবার। ছাত্ররাজনীতি করার সময় শুধুমাত্র একবার রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছিলাম। ১৯৭২-৭৩ মেয়াদে কেন্দ্রীয় কমিটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে, ১৯৭৩-৭৪ মেয়াদে সিনিয়র ভাইচ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ৭০ দশকের মাঝামাঝিতে যখন অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয় তখন আমি রাঙ্গামাটিতেই ছিলাম। কৌশলগত কারণে রাঙ্গামাটিতে থাকতে হয়। প্রিয়নেতা সন্তু লারমার নির্দ্দেশে বিপ্লবী শিল্পীদল গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল। কার্যক্রম ও চালিয়েছিলাম বছর দেড়েকের মত। দুর্ভাগ্য সফল হতে পারিনি। কেননা সে সময়ে যারা গান চর্চা করতো ভেতরে ভেতরে রোমান্টিকতার যোগে পেয়েছিল। এটা জানতে পেরে বন্ধ করতে বাধ্য হই। এটা আমার দুর্ভাগ্য এবং চরম ব্যর্থতা।

ইন্টু মনি তালুকদারঃ
প্রায় পুরোটা ১৯৮০’র দশক এদেশে ছিল প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন। এই সময়ে একজন শিল্পী হিসেবে আপনার দিনকাল কেটেছে কেমন, জানতে চাই।
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ ১৯৭৮ এর শেষের দিকে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত পাহাড়িকা অনুষ্ঠানে চাকমা ভাষার অনুষ্ঠান চালানোর জন্য চট্টগ্রাম শহরে চলে যাই। তিন বছর পর ৮১ এর নভেম্বরের ৬ তারিখ চট্টগ্রাম শহর ত্যাগকরে প্রিয়নেতা সন্তু লারমার আহক্ষানে সরাসরি আন্দোলনে যোগদিতে চলে যাই। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য অন্যদেশে চলে যাই। জাতির চরম দুর্ভাগ্য যে, কুরুক্ষেত্র (ভ্রাতৃঘাতিযুদ্ধ) হওয়ার কারণে স্বপ্ন পূরণ হলোনা। শ্রদ্ধেয় বনভান্তের উক্তিটি মনে পড়ে ‘‘আশার তরনী ডুবিল সাগরে শূণ্যদেউল শুণ্যঘর- জানিনা কাহার রুদ্র প্রতাপে পথের ভিখারী হইল অমর।’’ চার বছর পর ৮৫ এর শেষের দিকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করি জন্মদাত্রী মা আনতে গেলে। পার্বত্য চুক্তির পর্যন্ত বাকী সময়টুকু কেটেছিল ভয় শংকা আশা নিরাশার দোলাচলে ঘড়ির পেন্ডুলাসের মত।

ইন্টু মনি তালুকদারঃ ১৯৯০’র গণআন্দোলনের পর নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে। ওই সময়ে শিল্পী এবং সচেতন মানুষ হিসেবে আপনি কেমন সময় অতিবাহিত করেন?
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ ৯০ এর গণ আন্দোলনের সাধারণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বাতায়ন তৈরী হয়েছিল তৎ প্রেক্ষিতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে আরো দশজন সাধারণ নাগরিকের মত আমারও প্রত্যাশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দিনের সমস্যার সুস্থ সমাধানের পথ সুগম হবে। তা না হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবে মনে শংকা, অস্থিরতার আর্বতে দিন কাটাতে হয়েছিল।

ইন্টু মনি তালুকদারঃ ৯০ দশকের প্রায় শেষ প্রান্তে (১৯৯৭) পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হল। দেশের মানুষ একাত্ম হয়ে গেল ওই ঐতিহাসিক চুক্তির সারমর্মে। পাহাড়ী জীবনের গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এ বিষয়ে আপনার অভিমত জানান।
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ ৯৭ এর পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে মন্তব্য ‘‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।’’ সমগ্র পার্বত্য আদিবাসীদেরমত আমিও আনন্দিত ও আশ্বান্বিত হয়েছিলাম। দুঃখের বিষয় কানা মামা তার ভাগ্নেকে ভুলে গেছে।

ইন্টু মনি তালুকদারঃ গানে চিরকাল প্রেমময়তা, মানুষের প্রতি মানুষের আশা আকাঙ্খার কথা প্রকাশ করে গেলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনগুলোর কাছে আপনার স্বপ্ন প্রত্যাশা কী? বিস্তারিতভাবে বলুন।
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ যেহেতু আপনি আমাকে ‘‘একজন সচেতন মানুষ’’ হিসেবে উল্পেখ বা সম্বোধন করেছেন, তাই বলি একজন সচেতন মানুষের সমাজের কাছে, জাতি ও প্রজন্মের কাছে অনেক প্রত্যাশা থাকতে পারে যে, গুলো দ্বারা জাতি ও সমাজ টিকে থাকবে, সামনে এগিয়ে যাবে, বিশ্বদরবারে নিজের পরিচয় তুলে ধরবে অর্থনৈতিক, সমৃদ্ধি, ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ; জ্ঞান বিজ্ঞানে ও প্রগতিশীল সমাজ, সাহিত্য ও সাংস্কৃতি সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে।

ইন্টু মনি তালুকদারঃ আপনাকে ধন্যবাদ।
রনজিত কুমার দেওয়ানঃ আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

Back to top button