জাতীয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা পেলে প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের আরো অনেক কাজ করা যেতো-রাজা দেবাশীষ রায়

শ্যাম সাগর মানকিন: পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের যথাযথ সহযোগিতা পেলে আরো প্রথাগত আইন ও প্রতিষ্ঠানের অনেক কাজ করা যেতো বলে জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায়। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী নারীর অংশগ্রহন বর্তমান বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ করনীয় শীর্ষক এক জাতীয় পরামর্শসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা জানান। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে পরামর্শসভাটি অনুষ্ঠিত হয়ছে।
প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন সমস্যাসহ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আর্থিক সংকট আলোচনার প্রেক্ষিতে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীর ক্ষমতায়নের ব্যপারটা যদি আমরা দেখি তবে দেখি আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদে নারীদের অংশগ্রহন খুবই কম।
প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে আমরা চেষ্টা করছি সবাই মিলে যতটুকু এগিয়ে নেয়া যায়। এ ছাড়া প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে বিচারের ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করছি নারীর উপস্থিতি ছাড়া যাতে কোন বিচার না হয় বলেও জানান রাজা দেবাশীষ রায়।
নারী কার্বারিদের নিয়োগ সাম্প্রতিক দেয়া হয়েছে। নতুন এই নারী প্রতিনিধিদের এখনো বিভিন্ন আইন ও কর্মকান্ড সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়নি। প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে তাদের কাছে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন মং সার্কেলের রাজা সাচিং প্রু চৌধুরী।
তিনি আরো বলেন, সবাই কেবল রাজাকেই বলেন। কিন্তু যদি আপনারা এগিয়ে না আসেন তাহলে রাজা একাও নারীর ক্ষমতায়নে একা কাজ করতে পারেনা বলে তিনি জানান। তবুও চাকমা ও বোমাং সার্কেলের থেকে ছোট একটা সার্কেলে ১৩২ জন নারী হেডম্যান ও কার্বারি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সামাজিক ভাবে প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে নারী পুরুষের সমস্যা নিয়ে বিচার হলে নারী প্রতিনিধিদের উপস্থিতি মং সার্কেলে নিশ্চিত করা হয় বলেও জানিয়েছেন মং সার্কেলের রাজা সাচিং প্রু চৌধুরী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রমা রানী রায় তার বক্তব্যে বলেন, প্রথাগত আইনের যুগোপযুগী সংস্কার হওয়া উচিৎ। শতশত বছর পূর্বে গড়া এসব নিয়মনীতি বর্তমানের প্রেক্ষিতে ঢেলে সাজানো উচিৎ।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান এগিয়ে নিতে চাইলে অবশ্যই শিক্ষায় জোর দেয়া উচিৎ তার পাশাপাশি পুরুষদের বেশি সচেতন হতে হবে। যে পুরুষ সচেতন সেতো নারীর উপর নিপীড়ন করবেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের কাজ বহু পুরনো। প্রায় ১১৮ বছরের পর আমাদের এখনো এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের অংশগ্রহন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে নারীদের অংশগ্রহন বেড়েছে সংখ্যায় তবে গুনগত জায়গায় তা আসলেই বেড়েছে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড.আইনুন নাহার।
তিনি আরো বলেন, আমরা যখন প্রথাগত ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছি তখন আমাদের ভাবতে হবে যে এই ব্যবস্থা কি এই সময়ের চাহিদা পূরণ করছে কিনা। নাকি প্রথাগতভাবে নারীকে হেয় করে যে সব ব্যবস্থা থাকে তাকেই জিইয়ে রাখা হয়েছে। যদি সেটা না হয় তবে গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যক্তিগত পারিবারিক কর্ম সব ক্ষেত্রেই নারীরা বঞ্চিত। প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী নারীদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। পুরুষতান্ত্রিকতা অন্যান্য সমাজের থেকে আদিবাসী সমাজে আরো বেশি কঠোর বলে আমার মনে হয়।
তিনি আরো বলেন, প্রথাগত আইনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারনে নারীর উপর পুরুষের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। আমাদের বিভিন্ন সমস্যা যেহেতু প্রথাগত আইনে নিষ্পত্তি হয় তাই এ ক্ষেত্রগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিৎ।
প্রথাগত আইন বা প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযুগী করতে গেলে এখনো আমাদের অনেক দূর যেতে হবে বলে জানান মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান। প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে নারীদের অংশগ্রহন সংখ্যাগত অনুপাতে অনেক কম বলেও জানান তিনি।
বর্তমান সময়েও নারীদের প্রতি খুব যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাবেনা। তবে নিশ্চিতভাবেই আগের থেকে কিছুটা এগিয়েছে বলেও তিনি জানান। প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় চালিত সংস্থায়ও নারীর যে অংশগ্রহন তা বাড়ানো উচিৎ।
পরামর্শ সভায় বিভিন্ন অঞ্চলের কার্বারি ও হেডম্যান মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহন করেন। মুক্ত আলোচনায় হেডম্যান ও কার্বারিরা তাদের নানান সমস্যার কথা তুলে ধরেন। আলোচনায় উঠে আসে বিভিন্ন অঞ্চলের কার্বারি ও হেডম্যান অনেকেই নিজেদের আশ্রয় হারিয়েছেন। তা ছাড়া প্রথাগত এই সব প্রতিষ্ঠান অনেকটা হুমকির মুখে রয়েছে বলেও জানান তারা। ফলে প্রতিষ্ঠানকেও বাঁচিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে বক্তব্য রাখেন তারা।
বাংলাদেশ নারী প্রগতির নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীরের সঞ্চালনায় পরামর্শসভার মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা। পরামর্শ সভার আয়োজন করেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, কাপেং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, ওমেন হেডম্যান-কার্বারি নেটওয়ার্ক, সিএইচটি অমেন এক্টিভিস্ট ফোরাম প্রগ্রেসিভ, অনন্যা কল্যাণ সংগঠন ও খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি।

Back to top button