পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন- এর পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মসূচীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার দাবীতে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন ও অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরীর যৌথ স্বাক্ষরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর এ চিঠি প্রকাশ করা হয়।
উক্ত চিঠিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে ও জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় যারা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি আন্তরিকভাবে সমবেদনা ও গভীর শোক প্রকাশ করে বলা হয়- ’ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগ সন্ধিক্ষণ হিসাবে বিবেচিত হবে, যা ইতোমধ্যে ন্যায়বিচার, শান্তি এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য নতুন করে আশা তৈরি করেছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের দেশমাতৃকাকে গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত করবে।’
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন সরকারের অভিযাত্রায় আমরা ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনার নতুন বাঁকে এসে দাঁড়িয়ে আছি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৬ বছর ধরে চুক্তির মূল উপাদানগুলি অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসী জনগণ এবং সারাদেশের নাগরিকদের এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের সকল আদিবাসীদের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখা এবং একই সাথে দেশের জাতীয় ঐক্যের জন্য অপরিহার্য।’
’প্রায় দুই বছর সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন অক্লান্তভাবে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পক্ষে জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করে আসছে। পাহাড়ি জনগণ এবং বৃহত্তর বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর যাতে একই সাথে উচ্চস্বরে এবং স্পষ্টভাবে শোনা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কাজ করছি। আমাদের আন্দোলন পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র-যুব ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেছে’- বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের পক্ষ থেকে উক্ত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
উক্ত চিঠিতে পার্বক্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিম্নোক্ত ৭ দফা দাবির বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়-
১. চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়সীমাভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক তত্ত্বাবধান বন্ধ এবং অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহার।
৩. আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদকে যথাযথ ক্ষমতায়ন।
৪. ভূমি অধিকার ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করা।
৫. টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন।
৬. সমতলভূমির আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা।
৭. সমতল এলাকার আদিবাসীদের স্থানীয় সরকারে বিশেষ আসন সংরক্ষণ।
চিঠিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আরও পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে:
১. পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির পুনর্গঠন।
২. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সক্রিয়করণ।
৩. আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সংলাপ।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন, এবং
৫. সমতলের আদিবাসীদের ভূমি ও মানবাধিকার সুরক্ষায় কমিশন গঠন।
চিঠির শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করেছে যে এই দাবিগুলো অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শান্তি, ন্যায়বিচার এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাংলাদেশের আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা ও অগ্রগতির অভাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন আশা প্রকাশ করেছে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।