জাতীয়

পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩১৫ জন জুম্ম মানবাধিকার লংঘনের শিকার- পিসিজেএসএস

আইপিনিউজ ডেস্ক (ঢাকা): পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
আজ ১ জুলাই ২০২৫, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর অর্ধ-বার্ষিক (জানুয়ারি-জুন ২০২৫) এ রিপোর্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংগঠনটির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সহ-সম্পাদক সজীব চাকমা স্বাক্ষরিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ১১ মাসেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতির মৌলিক কোনো পরিবর্তন বা অগ্রগতি সাধিত হয়নি। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকেও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এসব ঘটনায় ৩১৫ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়,  “ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ১১ মাসেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতির মৌলিক কোনো পরিবর্তন বা অগ্রগতি সাধিত হয়নি। জুম্মদের উপর বিদ্যমান মানবাধিকার লংঘন, নিপীড়ন ও বঞ্চনা অবসান করার যেমন কোনো উদ্যোগ নেই, তেমনি এসব অন্যায়-অবিচার অবসান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কার্যকর ও আশাব্যঞ্জক কোনো উদ্যোগ নেই।
দীর্ঘ ২৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তির কোনো মৌলিক বিষয়সহ চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমান সরকারও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ পুনর্গঠন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন করলেও বাস্তবে চুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাসমূহ বাস্তবায়নে সরকারের তরফে আন্তরিক কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। গত ১২ জানুয়ারি ২০২৫ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠনের পর প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও উক্ত কমিটির কোন বৈঠক এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিকায়ণের মাধ্যমে ফ্যাসীবাদী কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের নীতি অব্যাহত রয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়টি সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত রয়েছে। ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে সেনাবাহিনী সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচারকার্য, উন্নয়ন কার্যক্রমসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকেও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বানচাল, সর্বোপরি জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের উদ্দেশ্যে শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার, সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, ভূমিদস্যু বহিরাগত বিভিন্ন কোম্পানী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি সকল পথ ও অপশক্তিকে ব্যবহার করে চলেছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যুদের দ্বারা ১০৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এসব ঘটনায় ৩১৫ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। এতে ৪৯ জনকে গ্রেফতার এবং ৩০ জন ম্রো শিশু ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বহিরাগত কোম্পানী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সেটেলার কর্তৃক কমপক্ষে ৩০০ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে।”
উল্লেখ্য যে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত সংঘটিত ১০৩টি ঘটনার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৪৮টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে কমপক্ষে ১২৫ জন লোক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে এবং ৩৪টি গ্রামে টহল অভিযান চালানো হয়। তার মধ্যে ১৯ জনকে সাময়িক আটকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৯ জনকে, মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে ৯ জন।
একই সময়ে সেনা-সৃষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক ১৯টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ৩ জনকে হত্যাসহ ৯৫ জন ব্যক্তি ও ৫টি গ্রামের অধিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মারধর, হত্যা, গুলিতে আহত, তল্লাসী, হত্যার হুমকি, টাকা ও মোবাইল ছিনতাই, চাঁদা দাবি ইত্যাদি ঘটনার ছিল।
একই সময়ে মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক ২১টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ৩০ জন ম্রো শিশু ধর্মান্তরসহ ৭৯ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে এবং কমপক্ষে ৩০০ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদকে উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হুমকির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে ঢাকায় আদিবাসী ছাত্র-জনতার উপর বর্বরোচিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা অন্যতম।
অপরদিকে, সেটেলার বাঙালি, বহিরাগত বাঙালি শ্রমিক ও ব্যক্তি কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা সহ ১৫টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৬ জন নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে।

Back to top button