মতামত ও বিশ্লেষণ

পান পাতায় জীবন: পর্যটনের কবলে উচ্ছেদ আতঙ্কে খাসিপুঞ্জি

আইপিনিউজ ডেস্ক:

ডিসেম্বরের সকাল। রাস্তার দুপাশ জুড়ে সারি সারি চায়ের বাগান পেরিয়ে এগিয়ে চলে আমাদের চাঁন্দের গাড়ি। ক্ষণিক পর পর দেখা মিলে দু-পাতা, একটি কুঁড়ি’র চায়ের পাতা বোঝা মাথায় নিয়ে চলা চা শ্রমিক। তাদের রোদপোড়া লিকলিকে দেহের গড়ন জানান দেয় দৈনিক ১৮৭ টাকা বেতনের অমানবিক পরিশ্রমের কথা। চা বাগান পেরিয়ে দেখা মিলে চা শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্য বাগান কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তৈরী করা ছোট্ট একটি স্কুলের। কিছুদূর যেতেই দেখা মিলে দুইরুম বিশিষ্ট একই ডিজাইনের সারি সারি বাড়ি। বুঝা যায়, চা কোম্পানি কর্তৃক শ্রমিকদের জন্য বানানো ঘর। অন্যদিকে বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ দালানকোঠা। যেন উঁচু গলায় জানান দেই মালিক-শ্রমিকের বিস্তর ব্যবধানের কথা।

চা বাগানের সরু পথ ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের চার চাকার বাহন। উদ্দেশ্য খাসিপুঞ্জি পরিদর্পশন। পথ যত এগোয় সবুজ তত ঘাঢ় হতে থাকে। চা বাগানের সরু পাকা রাস্তা মিলে যায় পাহাড়ী এবড়ো থেবড়ো কাঁচা রাস্তায়। কচি চায়ের পাতার সতেজ গন্ধ মিশে যায় পানপাতার বুনো ঘ্রাণে। পাহাড়ী এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে মিষ্টি পান বেষ্টিত গগনচুম্বী গাছের সারি খাসিপুঞ্জিতে আমাদের স্বাগত জানায়। দুপুর ১২ ঘটিকার দিকে আমরা পৌঁছে যায় আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্য নাহার-১ (আসলম) খাসিপুঞ্জিতে। পাহাড়ের উপড় গড়ে ওঠা পরিচ্ছন্ন এ পুঞ্জিতে ৩০ টি পরিবারের বসবাস। প্রজন্ম ধরে বসবাস করা আদিবাসী খাসিদের এ পুঞ্জি দখলে নিতে চায় চা বাগান কর্তৃপক্ষ। ভূমি দখল করতে করা হয়েছে মামলা। এখনো তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদের আতংকে দিন কাটাচ্ছেন পুঞ্জিবাসী।

পানগাছ

নাহার-১ শেষে আমাদের গন্তব্য নাহার-২ (কাইলিন) পুঞ্জির উদ্দেশ্যে। এবার আর চার চাকার বাহনে নয়। দু-পায়ের উপড় ভরসা। আমরা হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। নাহার-১ থেকে নাহার-২ যাওয়ার দূরত্ব ৪ কিলোমিটারের কাছাকাছি। পাহাড়ী ঝিরি-ঝর্ণা আর গিরিখাদ পেরিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টার পর আমরা পৌঁছে গেলাম নাহার-২ পুঞ্জিতে। পানজুম বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে পরিমন্ডিত এ পুঞ্জিতে ৪৫ টির অধিক খাসি পরিবারের বসবাস। ঐতিহ্যবাহী পানজুম-ই তাদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম। আমরা যখন পুঞ্জিতে পৌঁছায় তখন বেশ বেলা হয়ে আসছিলো। পুঞ্জিবাসী পানজুম থেকে পান সংগ্রহ ও বাঁধার কাজ করছিলো। অনেকেই পানজুমের আগাছা পরিস্কার করছিলেন। এই ব্যস্ততার মধ্যেও পুঞ্জিবাসী আমাদের অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে অভ্যর্থনা জানায়। দুই পুঞ্জিবাসীয়ই মিলিত হয় আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য।

মতবিনিময় সভা

পুঞ্জির সার্বিক পরিস্থিতিসহ শ্রীমঙ্গলের খাসিয়া আদিবাসীদের বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানায়, চা-বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক খাসিপুঞ্জির ভূমি বেদখল করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। পুঞ্জিবাসীদের নামে হয়রানিমূলক বিভিন্ন মামলা দেওয়া হয়েছে যার অনেকগুলোই এখনো চলমান। এগুলোর মধ্যে ২০১৪ সালে চা-বাগান সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বত্ব দখলিয় মামলা পুঞ্জিবাসীর বিরুদ্ধে দেওয়া হয়। যেই মামলা এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে। এছাড়াও একটি এক্সিডেন্টে এক চা-শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাসিপুঞ্জির আদিবাসীদের সাথে চা-শ্রমিকদের মধ্যে একটি দ্বন্ধ তৈরী করে দেওয়ার চেষ্টা চালায় বাগান কর্তৃপক্ষ। সেই মিথ্যে মামলার ভারও বহন করছেন পুঞ্জিবাসীরা।

অন্যদিকে পানের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবেও খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছেন তারা। এমনতর অবস্থায় সম্প্রতি তারা জানতে পারেন স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক পুঞ্জির নিকটস্থ ঝিড়িতে পর্যটন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে ফলাও করে খবর প্রচার করা হয়েছে। যার কারণে পর্যটকের আনাগোনাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে। পুঞ্জিবাসীরা জানান, পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় তারা নিরপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিশেষ করে খাসি নারীরা নানান সমস্যার সম্মূখীন হচ্ছেন। পর্যটকরা অনুমতি না নিয়ে যত্রতত্র ছবি তোলেন, ভিডিও করেন, বিভিন্ন ধরণের এলোমেলো প্রশ্ন করেন যার কারণে তারা পুঞ্জিতে অবাধ চলাচল করতে পারছেন না। ঝিড়ি-ঝর্ণা থেকে পানি তুলতে পারছেন না।

ঝিড়ি

অন্যদিকে পানজুমের সাথে খাসি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বিশ্বাস নিবিড়ভাবে জড়িত। পানজুমকে তারা একটি পবিত্র স্বত্বা হিসেবে মনে করেন। পবিত্র মন এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়েই তারা পানজুমে প্রবেশ করেন। তারা মনে করেন, পানজুমে অপরিচ্ছন্ন হয়ে ঢুকলে, অপরিচত কারোর পানজুমে অনুপ্রবেশ পানজুমকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে। পানে বিভিন্ন ধরণের রোগ ছড়ায়। যার ফলে পানগাছ মরে যায়। কিন্তু পর্যটকরা মানা করা সত্ত্বেও যত্রতত্র পানজুমে প্রবেশ করেন, পান ছিঁড়েন, যার ফলে পানজুমের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এছাড়াও পর্যটকদের হৈ হুল্লোড়, সাউন্ড বক্সে বাজানো গান পুঞ্জির শান্ত-কোমল পরিবেশকে নষ্ট করছে।

ঝিড়িতে প্লাস্টিক

পর্যটক বেড়ে যাওয়ায় ঝিড়ি-ঝর্ণার প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরও মারাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ঝিড়ি-ঝর্ণার বিভিন্ন জায়গায় প্লাস্টিকের বোতল, কাপ, চিপসের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট পলিথিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এতে করে প্রাকৃতিক ঝিড়ি, ঝর্ণা ও ছড়ার বাস্তুসংস্থান এবং জীববৈচিত্রের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়াও পুঞ্জিবাসীর সুপেয় পানির একমাত্র উৎস হিসেবে রয়েছে এই ছড়াটি। এই ঝিড়ি-ঝর্ণা দূষিত হলে তারা মারাত্মক পানি সমস্যায় ভুগবেন। শুধু তাই নয়, আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে এই প্রাকৃতিক ঝিড়ি-ঝর্ণাগুলো থেকেই মাছ, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন ধরণের আমিষের উপাদান সংগ্রহ করে থাকে।

ঝিড়িপথ

পর্যটন হলে, পর্যটক বেড়ে গেলে শান্ত-সবুজ এ প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবে বলেই আমাদের ধারণা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক, ঙাফাখুঙসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা পর্যটনগুলো কিভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করেছে এবং এতে করে স্থানীয় আদিবাসীরা কি ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন আমরা তা দেখতে পেয়েছি। পুঞ্জিবাসীর সাথে তাই আমরাও চাই, পর্যটনের মত কড়ালগ্রাসী উদ্যোগ যেন নাহার আসলম এবং নাহার কাইলিন এলাকায় নেওয়া না হয়। এতে করে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির সাথে মিতালী করে বসবাস করা খাসি আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার ক্ষতি সাধনসহ তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

লেখক:
অমর শান্তি চাকমা
আদিবাসী অধিকার কর্মী

Back to top button