জাতীয়

নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান উদযাপন না করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ । আজ ৬ অক্টোবর, রবিবার, রাঙামাটির মৈত্রী বিহারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ।

সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ, বাংলাদেশ এর সভাপতি ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথেরো।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়- “সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ ও ভিক্ষুসংঘের পক্ষ থেকে পার্বত্যবাসীসহ বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিকামী সকল দেশবাসীকে যথাযোগ্য সম্মান, শ্রদ্ধা ও মৈত্রীপূর্ণ শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, গত ১৮ই সেপ্টেম্বর জনৈক ব্যক্তি মোটরসাইকেল চুরি করতে এসে জনতার হাতে ধৃত হয়ে গণপিটুনির শিকার হন, পরে পালানোর সময় বৈদ্যুতিক খাম্বার সাথে ধাক্কা লেগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তথ্যটি খাগরাছড়ি সদর থানার ওসি মহোদয়ের বয়ানে উঠে এসেছে। পরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিঃ তারিখে দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি সদরে সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। সেদিন রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ধনরঞ্জন চাকমা, জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরাসহ তিনজন নিহত ও অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। শতাধিক দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এর পরের দিন অর্থাৎ ২০ সেপ্টেম্বর উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে ”সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” ব্যানারে রাঙামাটি শহরে মিছিল করা হয়। ঐ মিছিলের উপর সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে দুর্বৃত্তদের সাথে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে। একপর্যায়ে সেটা আবার সহিংস হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় রূপ নেয় এবং তা গোটা রাঙামাটি শহরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রূপে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা রাঙামাটির পাহাড়ি আদিবাসীদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এমনকি রাঙামাটি ক্যান্টনমেন্ট-এর নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকির আনুমানিক ১০০ গজ দূরত্বে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের পাশাপাশি রাঙামাটি সদরস্থ ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মৈত্রী বিহারে ও ব্যাপক হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পবিত্র ত্রিপিটক গ্রন্থ ছিঁড়ে ফেলে ও পবিত্র বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করে। ছোট ও মাঝারি আকারের দশটি পিতলের বুদ্ধমূর্তি ও দানবাক্স লুট করে নিয়ে যায়। এছাড়া তবলছড়িস্থ আনন্দ বিহারেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বুদ্ধমূর্তিতে মোড়ানো গ্লাস ভেঙে সেখানকার পবিত্র বুদ্ধমূর্তির উপর আঘাত করা হয়। শুধু তাই নয় উক্ত ঘটনায় অনিক কুমার চাকমা (১৮) নামক এক কলেজ ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি আদিবাসীদের উপর এভাবে বিনাবাধায় সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পবিত্র বৌদ্ধ বিহারে আক্রমণ ও বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। এ ধরণের ঘটনা বার বার সংঘটিত হয়ে আসছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় এসব সহিংস ঘটনা সংগঠিত হয় এবং তাদের নিষ্ক্রিয়তা অথবা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে সহিংস ঘটনার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। তারা জানমালের রক্ষা করার পরিবর্তে পাহাড়ি আদিবাসীদের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ির উপর হামলা চালাতে সহযোগিতা করে অথবা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে বলে বার বার অভিযোগ রয়েছে। ফলে তুলনামূলক বিচারে প্রতিবারই পাহাড়ি আদিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উপরিল্লোখিত খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১ অক্টোবর ২০২৪ খ্রি. তারিখে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের জনৈক শিক্ষক সোহেল রানা কর্তৃক ৭ম শ্রেণির এক আদিবাসী ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়। অভিযুক্ত জনৈক শিক্ষককে উত্তেজিত জনতা গণপিটুনি দেয়, পরে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা ভিক্ষুসংঘ বিচারবহির্ভূত হত্যা বা মব কিলিং সহ যাবতীয় হত্যাকাণ্ডকে কখনও সমর্থন করি না। উক্ত ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারো আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় প্রশাসন সেদিন ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা জারি থাকা অবস্থায়ও বেছে বেছে পাহাড়ি আদিবাসীদের বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়দের অভিযোগ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই এসব হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাস চালানো হয়েছে। কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে সেটা স্থানীয় প্রশাসনের জানা থাকার কথা।
বক্তব্যে আরো যোগ করা হয়, অতীব দুঃখের সাথে বলতে হয়, এ যাবত পার্বত্য অঞ্চলে যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে তার কোনোটারই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। কখনো কখনো সরকার লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বটে কিন্তু এ যাবত কোনো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। এ ধরণের লোকদেখানো তদন্ত কমিটি করে ঘটনাগুলোকে বার বার ধামাচাপা দেওয়া হয়।
পাহাড়ের চলমান সহিংসতা এবং সহিংসতা থামানোর লক্ষ্যে প্রশাসনের তরফ থেকে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ না দেখা এবং আইন শৃংখলার চরম অব্যবস্থাপনা ও অবনতি দেখে আমরা সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ ও ভিক্ষুসংঘ বর্তমানে খুবই উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হওয়ায় চরম নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রশাসনের উপর আস্থাহীনতা বোধ করছি। এরকম চরম অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ ও ভিক্ষুসংঘ আসন্ন পবিত্র ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ বোধ করছে না।
এ অবস্থায়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শ্রদ্ধাবান দায়িক-দায়িক ও পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের মধ্যে আলোচনাক্রমে চলতি বছরে কঠিন চীবর অনুষ্ঠান না করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি।
সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।”
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে যৌথভাবে স্বাক্ষর করেন যথাক্রমে:
১. ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের, সভাপতি, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ
২. ভদন্ত সৌরজগৎ মহাথের, সহ-সভাপতি, বনভান্তে শিষ্য সংঘ, বাংলাদেশ
৩. ভদন্ত তেজপ্রিয় মহাথের, সা.সম্পাদক, পার্বত্য ভিক্ষু পরিষদ, বান্দরবান
৪. ভদন্ত জ্ঞানবংশ মহাথের, সহ-সভাপতি, রাজ নিকায় মার্গ, চিংম্রং, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি
৫. ভদন্ত আগ্গাশ্রী মহাথের, সভাপতি, ত্রিরত্ন ভিক্ষু এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ
৬. ভদন্ত সুমনা মহাথের, সভাপতি, খাগড়াছড়ি শাসনা রাক্ষিতা ভিক্ষু সংঘ
৭. ভদন্ত সুরিয়েন্টা মহাথের, সভাপতি, বৌদ্ধ শাসনা ভিক্ষু কল্যাণ পরিষদ, খাগড়াছড়ি
৮. ভদন্ত আগাসারা থের, সা.সম্পাদক, খাগড়াছড়ি ভিক্ষু এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ
৯. ভদন্ত কেসারা মহাথের, সভাপতি, মং সার্কেল, সাংঘারাক্ষিতা ভিক্ষু সংঘ, গুইমারা, খাগড়াছড়ি
১০. ভদন্ত উত্তমা মহাথের, সভাপতি, মানিকছড়ি, ভিক্ষু সংঘ, খাগড়াছড়ি
১১. ভদন্ত সুমনা মহাথের, সভাপতি, ওয়ার্ল্ড পীস ভিক্ষু সংঘ, খাগড়াছড়ি
১২. ভদন্ত কেসারা মহাথের, সভাপতি, রামগড় ভিক্ষু সংঘ, খাগড়াছড়ি
১৩. ভদন্ত ওইমালা মহাথের, সভাপতি, গুইমারা সংঘরাজ ওয়েনা মহাথেরো ভিক্ষু সংঘ, খাগড়াছড়ি
১৪. ভদন্ত নাইন্দাওয়াইংসা মহাথের, সদস্য, বাংলাদেশ মার্মা ভিক্ষু কল্যাণ এসোসিয়েশন
১৫. ভদন্ত নন্দিয়া ভিক্ষু, সহ-সভাপতি, পার্বত্য ইয়ং ভিক্ষু এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ

Back to top button