মতামত ও বিশ্লেষণ

দলিত-হরিজনদের উচ্ছেদ আতঙ্কের শেষ কোথায়?-শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ

‘আমরা কোথায় গেলে একটু সাহায্য পাবো, কোথায় গেলে আমাদের ঘর বাঁচাতে পারবো, কোনো দিশা পাচ্ছি না। সবখানে কুকুর-বিড়ালের মতো আমরা যাচ্ছি।’- কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মিরনজিল্লা সিটি কলোনীর ঘর হারানো ভুক্তভোগী পূজা রানী দাস।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পুরান ঢাকার বংশালের আগাসাদেক রোডের পাশে মিরনজিল্লা হরিজন কলোনীতে উচ্ছেদের ঘটনা সবারই কম-বেশি জানা। বুলডোজারের সামনে স্কুল ড্রেস পরিহিত শিক্ষার্থীদের অবস্থান সত্যিই মনকে নাড়িয়ে দেয়। গত সপ্তাহখানেক হলো ভুক্তভোগী হরিজন হাজারো নারী-পুরুষ,আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার আহাজারিতে মিরনজিল্লার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। হাতজোড় করে সরকারের নিকট মাথা গোঁজার ঠাঁই চাওয়ার দৃশ্যটি বিশ্ব মানবতাকে এক অসহায়ত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়। কম কষ্টে একজন মানুষ বলে না যে, ‘আমাদেরকে চিড়িয়াখানায় ভরে রাখেন। অন্তত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে মানুষ আমাদের দেখতে আসবে।’ এই আবেগগুলোকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সারা বিশ্ব যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে সেই সময়টাতে আমাদের দেখতে হচ্ছে, মানবিকতা কতটা ভূলুণ্ঠিত। মানুষ কতটা অসহায় আর জীবন কতটা সংকটাপন্ন।

ভারতের নানা অঞ্চল থেকে আনা হয়েছিল এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন, চা বাগান, রেলের কাজসহ বিভিন্ন কাজের জন্য। বলা হয়েছিল তাদের চাকুরীর নিশ্চয়তা থাকবে, সাথে মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু কালক্রমে এখন বাংলাদেশের দলিত জনগোষ্ঠীর বিশেষত হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ এমন একটি সংকটপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিশ্রæতি পূরণের লেশমাত্র নেই। ভালোভাবে বেঁচে থাকাটা তাদের জন্য দুঃস্বপ্নের আরেক নাম। আর জাতপাত বৈষম্যের কথা নাই বা বললাম। তারা সমাজের নিচু তলার মানুষ, অচ্ছ্যুৎ, অস্পৃশ্য।

জাতপাতের নির্মমতা বুঝতে হলে হরিজন জীবন বুঝতে হবে। এখনও পরিচয় জানলে কেউ তাঁদের ঘরভাড়া দেয় না। এমনকি রেস্তোরাঁ-হোটেলেও তাঁদের প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলধারার সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসবে হরিজনদের নিমন্ত্রন করা হয় না। এভাবেই মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চরম নির্মমতা আর অবজ্ঞা মেনে নিয়েই তারা জীবন চক্রে ঘুরপাঁক খায়। অনেকটা বাধ্য হয়েই বংশ পরম্পরায় পরিচ্ছন্নতার কাজের সাথে যুক্ত এই সম্প্রদায়। পেশা পরিবর্তনের চিন্তা অনেকটাই বিলাসিতা। হরিজনের সন্তান হরিজনের কাজ করে জীবন কাটিয়ে দিবে, যেন এমনটাই অলিখিত নিয়ম। এই সমাজ এখনও তাদের সেই দৃষ্টিতে দেখতে ব্যর্থ, সাম্য আর মানবিক হওয়ার জন্য যেটি আবশ্যিক। হরিজনদের চাকরীতে এখন আউটসোর্সিং শুরু হয়ে গেছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যখন নিয়োগ হবে তখন তারা আর সিটি করপোরেশন কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কর্মচারী থাকবে না। ফলে তাদের আবাসন ও আনুসাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে শুভঙ্করের ফাঁকি থেকেই যাবে। আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে শুধু হরিজনরাই কাজ করত। কিন্তু গত কয়েক বছরে মুসলমানসহ অহরিজনরাও এই পেশায় যুক্ত হয়েছে। মজার বিষয় হলো, অহরিজনরা তাদের চাকরী মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিলেও কাজটা করিয়ে নেয় কোনও এক জাত-হরিজনকে দিয়েই। পরিচ্ছন্নতা কাজের বিনিময়ে নামমাত্র অর্থ হরিজনকে দিয়ে মোটা অংকের বেতন নিজের পকেটে ভরার উদাহরণ ভরি ভরি।

মিরনজিল্লা হরিজন কলোনীর প্রবেশপথেই একটি স্মৃতিফলক চোখে পড়ে। যেটি মূলত ১০ হরিজন শহীদের নামে করা। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর এখানকার দশজন হরিজনকে রাজাকারদের ইন্ধনে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার কারণে। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরেও কেন তাদের স্বীকৃতি মিলেনি তা এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। তবুও প্রতিবছর পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় অগ্রজদের স্মরণ করেন স্থানীয় হরিজনসহ মুক্তিকামী মানুষেরা। হরিজন সূর্যসন্তান মহাবীর লাল সামুন্দ, নান্দু লাল, আনোয়ার লাল, ঈশ্বর লাল, খালবাল দাস, ঘাশিটা দাস, শংকর দাস হেলা, লালু দাস ও রামচরণরা এই দেশকে নিজের মনে করে জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হন নি। কিন্তু তাদের উত্তরসূরীদের সাথে এমন বিমাতা সুলভ আচরণ কতটা শোভনীয়? জানিনা এর উত্তর কি আর কেইবা দিবেন?

মিরন বাই নামে একজন নামকরা বাঈজী মূলত এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তিনিই এটা হরিজনদের দিয়ে যান। মূলত এটিই ‘মিরনজিল্লা’ নামকরণের প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর এ কলোনীর নিয়ন্ত্রণ যায় সিটি করপোরেশনের হাতে। বর্তমান মিরনজিল্লায় প্রায় ৪০০ বছর আগে হরিজনদের পূর্বপুরুষদের পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য আনা হয়। তারপর থেকেই তারা এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। তাদের বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, এমনকি ভোটার আইডি, পাসপোর্ট নম্বরসহ যাবতীয় নথিপত্রে উল্লেখমতে এই কলোনীই তাদের ঠিকানা। তারপরেও কিভাবে তাদের অবৈধ বলা যায়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

মিরনজিল্লা হরিজন কলোনীর শেকর খুঁজতে গেলে অনেক আগে থেকেই শুরু করতে হবে। এর সাথে ‘হরিজন সেবক সমিতি’ অতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা একটি সামাজিক সংগঠন। ১৯৪১ সালে এই মিরনজিল্লাতেই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা পায়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব থেকেই জাত-হরিজনদের বাস এখানে। ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা পায় ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি। চেয়ারম্যানের সাথে সাথে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হবার পদ্ধতি চালু হয় ১৯৭৭ সালের পৌরসভা অধ্যাদেশ জারি হবার পর হতেই। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে পরিবর্তিত হয়। সেই সময় থেকে এইসব জনগোষ্ঠী সিটি করপোরেশনের সাথে ওতপ্রোতভাবে পরিচ্ছন্নতা কাজের সাথে জড়িত হয়ে পরে। যারা যুগের পর যুগ শহর সাফ (পরিষ্কার) করেছেন, আজ তাদেরই সাফ (নিশ্চিহ্ন) করে দেওয়া হচ্ছে।

এই কলোনীর পরিবার সংখ্যা প্রায় ৭ শ’য়ের উপরে। ১০ বাই ১০ ছোট্ট ঘরে তিন প্রজন্মের গাদাগাদি বাস। পুত্র, কন্যা, পুত্রবধু এমনকি নাতি-নাতনী নিয়ে একটি কক্ষে কিভাবে বাস করা সম্ভব? এই অসম্ভবকে সম্ভব করেই চলছে হরিজনদের জীবন। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা এদের কাছে ঐভাবে পৌঁছায় না। পাঁচ শতাধিক পরিবারের সদস্য সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত। বাদবাকি দুই শতাধিক পরিবারের সদস্যের সবাই কোনো না কোনো সময়ে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

হরিজন সেবক সমিতি গত ৬ মে ২০২২ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়রের বরাবর একটি দরখাস্ত করেন। তাতে কলোনীর মানুষের কষ্টের কথা উল্লেখপূর্বক টিনের ঘরগুলো ভেঙ্গে ১০তলা বিশিষ্ট ৫টি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করা হয়। সেই আবেদনে মেয়র ফজলে নূর তাপস ‘পর্যালোচনা করে পেশ করুন’ বলে স্বাক্ষর করেন। প্রশ্ন হলো, বিগত ২ বছরে সিটি করপোরেশন কি পর্যালোচনা করল যে আজকে এই উচ্ছেদের নোটিশ দিতে হয়েছে। এই উচ্ছেদ করার মূল উদ্দেশ্যই হল কলোনীর পাশে থাকা কাঁচাবাজার সম্প্রসারণ করা। যাতে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, কাউন্সিলর ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে ।

প্রথমত মিরনজিল্লা কলোনীর ঘর ভাঙ্গার আদেশ মৌখিকভাবে দেওয়া হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারেন, মৌখিক আদেশকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। মিরনজিল্লা হরিজন সেবক সমিতিসহ অনেকেই এবিষয়ে সিটি করপোরেশনে কর্মকর্তাদের কাছে জানতে যান। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, এসব মেয়র সাহেব জানেন। মেয়র আদেশ দিয়ে বিদেশে গেছে ৮ জুন ফিরে ৯ জুন তিনি নতুন বিল্ডিংয়ে যারা চাকুরী করে তাদের ঘর বুঝিয়ে দেবে। ১০ জুন মিরনজিল্লা টিনসেডের ঘরগুলো উচ্ছেদের কাজ পরিচালনা করবেন। এমন খবরে মিরনজিল্লা কলোনীবাসীর চোখে ঘুম আর স্বস্তি উধাও হয়ে যায়। পাশাপাশি কলোনীতে কিশোর গ্যাং এবং মাদকের আখড়া গড়ে ওঠার মিথ্যে অজুহাতে হরিজনদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়।

মিরনজিল্লা কলোনীর পাঁচ শতাধিক পরিবারের মধ্যে ৬৬ জনকে পুনর্বাসন করা হবে বলে জানায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। কারণ এই ৬৬ জন বর্তমানে ডিএসসিসি’র পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত। বাদবাকি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে জমিতে বহুতল ভবন বাণিজ্যিক ও কাঁচাবাজার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অথচ সকল পরিবারের সদস্যই কোনো না কোনো সময় সিটি করপোরেশনের কর্মী ছিল। তাদের অনেকেই ছাঁটাই হয়েছে। কারও মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া এখানে বসবাস করা সবার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা এই কলোনী। কলোনীতে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা মাত্র ৪০ জন। অথচ সেখানে প্রায় পাঁচ শ’ পরিবার বাস করে। যারা ঘর পেয়েছেন, তারা কেউ চাবি নেননি। তাদের দাবি, সবাইকে ঘর দিতে হবে। না হলে তারাও নতুন ঘরে উঠবে না।

ডিএসসিসি এ পর্যন্ত নগরবাসীকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কোনোটাই পুরণ করতে পারেননি। যানজট সমস্যার নিরসন, অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, মশক নিধনসহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনও সমাধান দিতে পারেনি সিটি করপারেশন। অথচ অসহায় হরিজনদের উচ্ছেদের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। দূর্বলের উপর সবলের অত্যচার। যারা ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, তাদের প্রতি এই নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ কেন? তাঁরা তো এই শহরেরই বাসিন্দা, সিটি করপোরেশনেরই ভোটার, এ দেশেরই নাগরিক। বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা না করে কাউকে উচ্ছেদ করা কেবল অমানবিক নয়, বেআইনিও। কিন্তু ডিএসসিসি গরিব হরিজনদের উচ্ছেদ করেই উন্নয়ন করতে চায়। এমনকি শত শত বছর ধরে যাঁরা সেখানে আছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করেন না। যাঁরা এই দেড় কোটি জনঅধ্যুষিত ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, সেই মানুষগুলোর প্রতি কেন এই নিষ্ঠুর আচরণ? সিটি করপোরেশন মার্কেট করতেই পারেন। কিন্তু হরিজনদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে কেন? ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলেই হরিজন স¤প্রদায়ের মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও তারা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য আমরা সমঅধিকার চাই। পুনর্বাসন না করে কাউকে উচ্ছেদ করা আইনবিরুদ্ধ। হরিজনরা একদিন নগর বা অফিস পরিষ্কার না করলে পরিস্থিতি কতটা দুঃসহ হবে, একবারের জন্যও কি ভেবে দেখেছেন?

গত ৩ ও ৪ জুুন বস্তি উচ্ছেদে চার প্লাটুন পুলিশ চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর প্রথম চিঠি দেওয়া হয় সিটি করপোরেশন থেকে। ৬ জুন ‘মিরনজিল্লা উচ্ছেদ, চলবে না, চলবে না’ -স্লোগানে উত্তাল হয় নগর ভবনের চারপাশ। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে হরিজন সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। কর্মসূচি শেষে মিছিল নিয়ে নগর ভবন ঘেরাও করেন তারা। পরে উপস্থিত পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল মেয়র দেশের বাইরে থাকায় সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। এ সময় তাদের দাবি-দাওয়া ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হয়।

৯ জুন আবারও বস্তি খালি করে দিতে ১২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। ১০ জুন চালানো হয় অভিযান। ভবন নির্মাণের জন্য ২০টি ঘরের কথা বলে ৮০টি বসতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ হওয়া লোকজন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও ৯ জুন হরিজন স¤প্রদায়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে ডিএসসিসি মেয়র হরিজন কলোনী উচ্ছেদ না করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বৈঠকে মেয়র বলেন, ভবন নির্মাণের জন্য বস্তির অল্প জায়গা ভাঙা হবে; বাইরে পুরো বস্তি থাকবে।

কলোনি উচ্ছেদের প্রথম দিনে (১০ জুন) উচ্ছেদে ভীত হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হওয়া লক্ষি রানীর পরিবারে এখনো চলছে শোকের মাতম। অন্যদিকে ঘর উচ্ছেদ করায় মনের কষ্টে মঙ্গলবার প্রকাশ্যে নিম গাছে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় শাম্মী দাস। তিনি এখনো ঢাকা মেডিকেলের ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। আত্মহত্যার চেষ্টাকারী শাম্মী দাসের চোখের সামনে তার ঘরবাড়ি সবই গেছে। সে এখন কোথায় থাকবেÑএই ভাবনা থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। লক্ষী রানীসহ নিহত ও আহতদের দায় সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কিভাবে এড়াতে পারেন? কলোনীর পরীক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যহত হবার দায় কে নিবেন?

আধুনিক কাঁচাবাজার নির্মাণের জন্য জায়গা খালি করতে ১১ জুন সকালে শতাধিক পুলিশ ও উচ্ছেদ পরিচালনার জন্য যানযন্ত্র (এক্সকাভেটর ও পেলোডার) নিয়ে কলোনিতে গিয়েছিলেন ডিএসসিসি কর্মকর্তারা। এসব দেখে বসতির কোমলমতি শিশুদের কেউ স্কুলে যায়নি। তারা প্রত্যেকেই স্কুলের পোশাকে প্রতিবাদে শামিল হয়। চোখে কালো কাপড় বাঁধা। কারও হাতে পোস্টার। অনেকেই বসে পড়ে রাস্তায়। কেউবা মাটিতে শুয়ে। হাত জোড় করে তারা মিনতি করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবার একটাই আকুতি, তাদের শেষ আশ্রয়টুকু যেন ভেঙে ফেলা না হয়। ফলে হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দা ও তাঁদের স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেদিন রাত নয়টা পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারেননি তাঁরা।

১২ জুন রাতে ডিএসসিসি মেয়রের সঙ্গে হরিজন স¤প্রদায়ের একটি প্রতিনিধি দলের অনলাইন বৈঠক হয়। এতে ডিএসসিসি’র উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। পরদিন ১৩ জুন ৪৮ ঘণ্টার সময় বেধে দেয় কর্তৃপক্ষ। সিটি করপোরেশন থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জায়গা খালি করে দিতে বলা হয়।

ভূক্তভোগীদের মতে, মেয়র সাহেব আমাদের পঞ্চায়েতের সঙ্গে বসে বলেছিলেন, ‘২০টার বেশি ঘর ভাঙা হবে না। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকেন। আমরা এখান থেকে লোক পাঠাবো তারা মাপ নেবে।’ কিন্তু তারা মাপ নিতে আসার সময় সঙ্গে বুলডোজার নিয়ে এসেছে। তারা বলেছিলেন ২০টি ঘর ভাঙবে। কিন্তু তারা তিনটি ঘরকে একটি এবং চারটি ঘরকে দুটি ধরে গণনা করে। সে সময় তারা আবার বলেছে, আমাদের একটা ওয়াল ভাঙতেই হবে, আমাদের দেখাতে হবে। ওই সময় হরিজন বাসিসন্দারা ঘর খালি করতেও পারিনি। দুশ্চিন্তায় কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েন সেখানে। তখন এমন এক অবস্থা যে তারা আহতদের সামলাবে নাকি ঘরের জিনিসপত্র।

হরিজনরা ভাবতেও পারেনি যে তাদের সঙ্গে কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ করা হবে। উপায় না পেয়ে নারীরা মিলে বুলডোজারের সামনে শুয়ে-বসে পড়েন। তাদের কথা- হয় আমাদের এখানে মাটি দেন, না হয় মৃত্যু দেন। পরেরদিন আবার উচ্ছেদ করতে আসলে বাধ্য হয়ে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বুলডোজারের সামনে শুইয়ে দেয় তারা। এরই মধ্যে সিটি করপোরেশন শতশত লোকের চাকুরী থেকে অব্যহত দিয়েছে নানান অজুহাতে। ডিএসসিসি কী তামাসা শুরু করেছে ঢাকায় বসবাসরত পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সাথে? গণকটুলি, ওয়ারী, ধলপুর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য নির্মিত নতুন ভবনে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ঘর বরাদ্দ দিতে নানান ছলচাতুরী করে চলছে। নতুন নতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে দীর্ঘায়িত করছে এর কারণ টা কী?

সর্বশেষ উচ্ছেদপ্রক্রিয়ার ওপর ৩০ দিনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেয় হাইকোর্ট। ১৩ জুন এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আগামী ২১ জুলাই এ বিষয়ে পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, আদালত স্থিতাবস্থা দেওয়ায় আপাতত হরিজনদের উচ্ছেদ করা যাবে না। পুনর্বাসন বা তাঁদের জন্য অন্যত্র জায়গার ব্যবস্থা করার পরই তাঁদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। ‘প্রতিবাদ করে উচ্ছেদ ঠেকাল শিক্ষার্থীরা, আতঙ্কে বাসিন্দারা’ শিরোনামে গতকাল প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি যুক্ত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক, উৎপল বিশ্বাস ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা এই রিট করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তাঁরা শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে হরিজন স¤প্রদায়ের বাসিন্দাদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়া কেন অবৈধ হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। খানিকটা স্বস্তি মিললেও এক অজানা আশঙ্কার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে ভূক্তভোগী হরিজনরা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া হরিজনদের আন্দোলন ছাড়া আর বিকল্প নেই।

 

সরকারি দল এবার যে নির্বাচনী ইশতেহার করেছে, সেখানে যেসব অঙ্গীকার তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, অনগ্রসর হরিজন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও তাঁদের বাসস্থানের মতো বিষয়ের উন্নতিতে সরকার অগ্রগণ্য ভ‚মিকা পালন করবে। তাহলে হরিজনদের বসতি কেন উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অনাকাক্সিক্ষত সবকিছুর দায় মেয়রকে নিতে হবে। যাদের উচ্ছেদ করতে চাচ্ছেন তাদের ভোটেই ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হয়েছেন। জনগণের করের টাকায় কেনা এই বুলডোজার বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কতটা লজ্জ্বার, কেউ কি ভেবে দেখেছেন?

 

মিরনজিল্লা উচ্ছেদের ঘটনা এখন আর স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। রাজধানী ঢাকার গন্ডি পেরিয়ে সারাদেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মানবিক সংগঠক এবং সংগঠনসমূহ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে স্মারকলিপি দিয়েছেন ‘ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ’। কেবলমাত্র দলিত-হরিজন ঘরানার সংগঠনই নয়, বরং মূলধারার রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবাধিকার ভিত্তিক এবং সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো প্রায় প্রতিদিনই এমন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকাশ করছেন হরিজনদের প্রতি সহমর্মিতা ও সংহতি। উচ্ছেদের ঘটনায় ৫৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। উচ্ছেদের আগে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু। আমরা মনে করি চট্টগ্রামের ব্যাটারী গলির রবিদাসপল্লী, রাজধানীর গোপীবাগ, ধলপুর, গোবিন্দগঞ্জের বাগদাফার্মসহ অগণিত উচ্ছেদ প্রক্রিয়াই একই সূত্রে গাঁথা। সঙ্গত কারনেই সবারই এগিয়ে আসা উচিত। কেবলমাত্র হরিজনদের সমস্যা নয়, বরং দেশের জাতীয় সমস্যা বিবেচনায় স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সময়ের দাবী।

বস্তি উচ্ছেদ মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে যে পুনর্বাসন ছাড়া কোনো বস্তি বা কলোনি উচ্ছেদ করা যাবে না। কারণ, সংবিধানে জনগণের বাসস্থানের অধিকার রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। মার্কেট নির্মাণ করার নামে মিরনজিল্লা কলোনীতে বসবাসরত হরিজনদের অধিকার খর্ব করা, ভূমি দখল করার অপচেষ্টা মূলত ভ‚মিদস্যুতার শামিল। দেশের নানা প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে হরিজন সম্প্রদায় বৈষম্যের শিকার। মিরনজিল্লা কলোনি উচ্ছেদ করার পেছনে রাষ্ট্রের এই বর্ণবৈষম্যমূলক এবং ঘৃণার মনস্তত্ত¡কে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।

আমরা দেখেছি, ২০১৯ সালে রেলের জমি স¤প্রসারণের উদ্দেশ্যে গোপীবাগের টিটিপাড়া ও ধলপুরের তেলেগু কলোনি উচ্ছেদ করা হয়। তবে সেখানে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করা হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে মিরনজিল্লাতে, এমন আশঙ্কা হওয়া অমূলক নয়। গত দেড় দশকে উন্নয়নের নাম করে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই উচ্ছেদগুলোর অভিজ্ঞতা জানান দেয়, এই জনস্বার্থবিরোধী গোষ্ঠীভিত্তিক উন্নয়ন উচ্ছেদকৃত জনগণকে কেবল নিঃস্ব করেছে। মিরনজিল্লা সুইপার কলোনিতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষকে বসবাসরত জমির মালিকানা দলিল প্রদান করতে হবে। আর উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে নগদ ৫০ লাখ টাকা প্রদান করতে হবে। পরিশেষে ভূক্তভোগী হরিজনদের সাথে সুর মিলিয়েই বলতে চাই, ‘হরিজনরা কি মানুষ না? এদেশের নাগরিক না? রোহিঙ্গাদের যদি জায়গা হয়, তবে ৪০০ বছর ধরে সেবা দিয়েও হরিজনরা কেন উচ্ছেদের শিকার হবে?’

লেখক: সংগঠক ও মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মী।

Back to top button