থাকো আনন্দে নিন্দা অপমানেঃ সঞ্জীব দ্রং
নিন্দা ও অপমানের মধ্যে কিভাবে ভালো থাকা যায়, আনন্দে থাকা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা আমাদের বলে গেছেন। তিনি লিখেছেন, “সদা থাকো আনন্দে, জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে, সংকটে সম্পদে থাকো কল্যাণে, থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে।” কিভাবে সম্ভব ভালো থাকা নিন্দা ও অপমানের মধ্যে? আমি অনেক বছর ধরে লিখছি। আমরা নিজেরা না হোক, আগামী প্রজন্ম যেন একটু ভালো থাকে, মান-সম্মান-মর্যাদা নিয়ে আমাদের সন্তানেরা যেন বেঁচে থাকে। একটু বড় স্বপ্ন যেন তারা দেখে পৃথিবীর উন্নত সব দেশের নাগরিকের মতো। দেশের বাইরে গেলে, বিশেষ করে ইউরোপ গেলে, পথ চলতে চলতে জন্মভূমিতে সন্তানদের কথা মনে পড়ে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার পিছু ছাড়ে না। তবু আনন্দে থাকার চেষ্টা করতে হয়। কবি গুরু বলেছেন।
১.
দেশে আত্ম-পরিচয়ের অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদিবাসীরা এখন কঠিন সংকটে আছে। এই বিতর্ককে রাষ্ট্র এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, সে নিজেই উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়, এই চারটি শব্দের বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের পরে এই সংকট গুরুতর হয়েছে। ছেলেবেলা নানা দুঃখে-কষ্টে দিন গেলে বড়দের মুখে শুনতাম, এই দুঃখগুলো চিরদিন রবে না। আদিবাসী প্রবাদ আছে, রাত যত গভীর হয়, ভোর তত নিকটবর্তী হয়। তাই আশায় থাকি, একদিন কোনো মানুষ অন্য মানুষকে অপমান করে আনন্দ পাবে না। বরং মানুষের ব্যথায় সমব্যথী হবে সকল মানুষ।
২.
আমি গত মে মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সভায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখান থেকে চলে গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে কানাডা। যাত্রা পথে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখলাম। মান্না দের বিখ্যাত গান “যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ একদিন গলেও যায়, তবুও তুমি আমার” গানটি শোনার পর থেকে নায়াগ্রা হৃদয়ে গেঁথে ছিল। নায়াগ্রা থেকে টরন্টো গেলাম। এবারের যাত্রায় অনেকের মুখে কানাডার বর্তমান তরুণ প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা শুনেছি। নিউইয়র্কে অবশ্য কানাডার আইন মন্ত্রী মিস্ জুডি উইলসন রেবল্ডের কথা আমার কথা হয়েছিল জাতিসংঘ সভায়। তিনি চমৎকার বক্তৃতা করেছিলেন। কানাডার গিয়ে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর রেভেন্যান্ট ছবিটির কথা মনে পড়েছিল। এই ছবিটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় অনেকগুলো পুরষ্কার পাওয়ার কারণে। আমার কাছে এর বিশেষ গুরুত্ব ছিল পুরষ্কার গ্রহণের সময় নায়ক লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর কয়েক মিনিটের বক্তৃতা যা ছিল আদিবাসীদের নিয়ে। তার রেভেন্যান্ট ছবিটি গোল্ডেন গ্লোব পুরষ্কার জিতেছে এবং অস্কারও জিতেছে। তার চেয়ে বড় কথা, পুরষ্কার জেতার সময় অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে দুই মিনিটে তার বক্তৃতা। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও বলেছেন, “আমি এই পুরষ্কার বিশ্বের সকল আদিবাসী এবং ফার্স্ট ন্যাশন জনগণের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি যাদের এই ছবিতে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখন সময় এসেছে আদিবাসীদের ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেয়ার এবং আদিবাসীদের ভূমিকে কর্পোরেট আগ্রাসন ও বহিরাগতদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করার।”
টরন্টোতে বন্ধু কর্ণেলের বাসায় ছিলাম। সেখানে নর্থ আমেরিকার একটি উৎসবে আমরা গিয়েছি। রঙিন এক উৎসব। ধনী দেশের আদিবাসীদের অবস্থা অন্যরকম। তারচেয়ে বড় কথা হলো নতুন প্রধানমন্ত্রী আদিবাসীদের কথা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নির্বাচনে জেতার পর ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখে ফার্স্ট ন্যাশনস্ বা আদিবাসীদের সম্মেলনে কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বক্তৃতা ছিল অসাধারণ, অনুপ্রেরণামূলক। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া এই তরুণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, “প্রথমেই আমি এই ভূমির আদিবাসী আলনকুইন জাতির প্রতি স্বীকৃতি জানাই যাদের ঐতিহ্যগত ভূমিতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি স্বীকার করি তারাই এই ভূমির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যত্ন ও লালনকারী।” তিনি আরো বলেছেন, “আমি যখন গত জুলাই মাসে আপনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম, তখনি আশা করেছিলাম, জয় পরাজয় যাই হোক, আপনারা আমাকে আবার আমন্ত্রণ জানাবেন। আমি কৃতজ্ঞ যে, আপনারা আমাকে ডেকেছেন।” জাস্টিন বলেন, “এখন নতুন করে জাতিতে-জাতিতে আদিবাসীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সময় এসেছে। এর অর্থ হলো, সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা অধিকার বাস্তবায়ন করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। এটির ভিত্তি হবে অধিকারের স্বীকৃতি, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব।” তিনি বলেন, “আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পদক্ষেপ উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে বলছি, এটি আমাদের একান্ত ইচ্ছা যা আমরা একসাথে কাজ করলে অর্জন করতে পারবো। আমি এই দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে নিলাম এবং আমি আমার সরকারকে এই লক্ষ্যে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছি।” জাস্টিন আরো বলেন, “আমার চিঠিতে মন্ত্রীদের আমি বলেছি, আদিবাসী ফার্স্ট ন্যাশনস্, মেটিস ন্যাশন ও ইনুইটদের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে কোনো সম্পর্ক আমার এবং কানাডার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।” পরের কথাগুলো আরো গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় হওয়া উচিত সকলের জন্য। জাস্টিন বলছেন, “আজ আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আমরা আমাদের সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তুলবো এবং এই সম্পর্ককে সম্মান করবো। আমরা আপনাদের সাথে বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের জন্য একত্রে কাজ করবো। আমরা সত্য কথা বলবো।” এরপরের কথাগুলো আমাদের দেশের শাসকদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। তরুণ এই প্রধানমন্ত্রী বলছেন, “আমরা যদি ভুল করি, সব সরকার যেমন ভুল করে, আমরা আমাদের ভুল স্বীকার করবো এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেব। আর আমরা আদিবাসীদের সাথে পূর্ণ অংশীদার হয়ে একযোগে কাজ করবো যার মূল ভিত্তি হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহভাগিতা ও যত্নশীলতা।” জাস্টিন বলেছেন, “আপনারা জানেন, আমাদের শেষ সাক্ষাতের পর এ পর্যন্ত সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। আমি আপনাদের গল্প শুনেছি, শুনেছি আপনারা কিসের মধ্য দিয়ে চলেছেন। কেউ কার্যকর সংসদ সদস্য হতে পারেন না যদি তিনি প্রতিদিন ও প্রতিনিয়ত মানুষের জন্য কাজ না করেন। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এই কথাটি প্রযোজ্য।” তিনি বলেন, “এখন সময় হয়েছে প্রকৃত পরিবর্তন আনার। আমরা আদিবাসী জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য অগ্রাধিকার এজেন্ডা গ্রহণ করবো যাতে তাদের কথা রাজধানী অটোয়াতে উচ্চারিত হয়।” জাস্টিন বলেন, “আমি দুইজন আদিবাসী এমপিকে কেবিনেট মিনিস্টার নিয়োগ দিয়েছি।” এর বাইরে শিক্ষা, চাকুরি ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ সুবিধা প্রদানের বাজেট বৃদ্ধিসহ আদিবাসী কল্যাণে বিনিয়োগের কথা তিনি বলেছেন তার দীর্ঘ বক্তৃতায় যা এখানে জায়গায় অভাবে উল্লেখ করা হলো না। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের কথা তিনি বলেছেন।
জাস্টিন ট্রুডো আরো বলেছেন, “শ্রদ্ধাভরা ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক স’াপন শুধু সম্ভবই নয়, এটি আমাদের পবিত্র অঙ্গীকার। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আগামী দিনে আপনারা আমাকে আপনাদের সহকর্মী হিসেবে পাবেন, আর আমিও আপনাদের পাশে পাবো।” তিনি ইতিহাসের দিকে উদাহরণ টেনে বলেন, “ইতিহাস স্বাক্ষী যে, বৈপরিত্য ও বিরোধাত্মক পদক্ষেপ শুধু অকার্যকরই হয় না, বড় ক্ষতি স্বাধন করে।”
৩.
তাই আমরা প্রতিদিন আশায় পথ চেয়ে থাকি, আমাদের দেশ গরিব হলেও ধনে-মানে-সম্মানে বড় হবে একদিন। সংখ্যালঘু ও আদিবাসী মানুষ এখানে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেবে না। ভবিষ্যতে এমন এক পরিবেশ আমরা পাবো যেখানে আদিবাসী ও বাঙালী শিশু হাতে হাত রেখে পথ চলবে, এক সুরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমার সঙ্গে শংখ-মাইনী-সীমসাং নদীর সেতু বন্ধনের গান গাইবে। জাতিতে জাতিতে মানুষে মানুষে শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মানের সংস্কৃতি বিকশিত হবে। আত্ম-পরিচয় নিয়ে কেউ কাউকে অপমান ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে না। ভুল ভ্রান্তি হলে তা স্বীকার করে শুদ্ধতার পথে এগিয়ে যাবে দেশ। নিশ্চয় একটা রিকনসিলেশন আসবে মানুষের মনে। আমাদের রাষ্ট্র প্রধানদের কাছ থেকে আমরা এমনি কথা শুনতে অপেক্ষায় চেয়ে আছি, যে বক্তৃতা ইতিহাসে ঠাঁই পাবে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আদিবাসীদের মানবাধিকার, সাংবিধানিক স্বীকৃতি চেয়ে আমরা কি ভুল করছি? কোথায় কার কাছে এই দাবি করছি? হুমায়ূন আজাদের ভাষায়, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? তাই হয়তো ভূমি ও পরিচয়ের অধিকার চাওয়ায় কোথাও ভুল হচ্ছে। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া রেফারেন্ডামের দিকে চলেছে। লারাকিয়া আদিবাসীদের জমি ফেরত দিয়েছে। সরকার ও বিরোধীদল উভয়ে জনগণের মনে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে এগুচ্ছেন। ক্লজিং দ্য গ্যাপ বলে প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রকল্প আছে যেখানে প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী রিপোর্ট প্রদান করেন। দেশে দেশে অনেক ভালো কাজ হচ্ছে। এখানে আমরা আর কিভাবে অধিকার চাইলে তা সম্মানীয় ও গৃহিত হবে আমি জানি না? কেউ কি বলে দেবেন দয়া করে? মান্না দে’র বিখ্যাত একটি গান আছে, “রাত্রির কাছে সূর্য চেয়েছি, লেখা স্বরলিপি আশা করে গেছি, স্বপ্ন বীণার কাছে, হায় রে হৃদয় চেয়েছি তোমার মতো হৃদয়হীনার কাছে।”
হায়, কেন এমন হবে?
সঞ্জীব দ্রংঃ সাধারণ সম্পাদক; বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম