গারো সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব ‘ঢাকা ওয়ানগালা-২০২৪’ গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে উদযাপিত হয়েছে। উৎসবে ফুটে ওঠেগারো সংস্কৃতির বৈশিষ্ট। প্রায় সকল নারীর গায়ে শোভা পায় দকমান্দাসহ ঐতিহ্যবাহী পোষাক । দশ হাজারের বেশি মানুষের অংশগ্রহণে উৎসবটি বার্ষিক মিলনমেলায় রূপ নেয়। মনের অজান্তেই নিজেদের সংস্কৃতির অতি পরিচিত গানের তালে তালে নাচতে থাকে তারা। বছরে একদিন নিজেদের পোশাক পরার এবং সকলের সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ পায় তারা। দিনব্যাপী পুজো-অর্চনা,নাচে-গানে এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ে উৎসবমুখর দিন পার করে রাজধানীতে বসবাসরত গারোরা।
‘ঢাকা ওয়ানগালা-২০২৪’ এর নকমা প্রকৌশলী অন্ত ঘাগ্রা গণমাধ্যমকে বলেন, গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ফসল উৎসব ‘ওয়ানগালা’ মূলত ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার উৎসব, যা এখন ঢাকাবাসী গারোরা প্রতীকী রূপে পালন করে আসছে।
“ঢাকা ওয়ানগালা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি আমাদের গারো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের প্রতীক। পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম এবং ঐতিহ্যের ধারাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এই উৎসব আমাদের শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একতার প্রতীক। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও গারোরা আদি ফসল উৎসব ওয়ানগালার স্মৃতি এবং ঐতিহ্য আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন।
অন্ত ঘাগ্রা আরও জানান, অতীতে গারোদের জীবন ও জীবিকা ছিল মূলত কৃষিনির্ভর, যা ছিল জুমচাষ ভিত্তিক। তারা তাদের কৃষি বর্ষের শেষের দিকে ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলার সময় নকমা(গ্রাম প্রধান) এর নেতৃত্বে গ্রামের সবাইকে নিয়ে ‘ওয়ানগালা’ উৎসব উদযাপন করতো। ওয়ানগালা ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। আদিবাসী গারোরা বিশ্বাস করে, শস্য দেবতা ‘মিশি সালজং’ পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারাবছর পরিমাণ মতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ভাল শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। তাই নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় ‘মিশি সালজং’কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করতো তারা। শস্য দেবতাকে উৎসর্গ না করে তারা কোন খাদ্য ভোগ করতো না। দেড় এক যুগ ধরে প্রতিবছর নবেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় বসবাসরত গারোরা এ উৎসব পালন করছে। যুগ যুগ ধরে গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এভাবেই ফসল উৎসর্গ করে আসছে বলে জানান অন্ত ঘাগ্রা।
ঢাকা ওয়ানগালা-২০২৪ উদযাপন কমিটির সেক্রেটারী অটুট আরেং সাংবাদিকদের জানান, শুক্রবার সকালে দেবতা পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় ‘ওয়ানগালা উৎসব’। ‘আমুয়া’, ‘রুগালা’র মতো ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। তারপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শুভেচ্ছা বিনিময়। এতে নিজস্ব ভাষায় গান গেয়ে শোনান গারো শিল্পীরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল গারোদের ঐতিহ্যবাহী জুম নাচ।
অটুট আরেং আরও জানান, শহুরে জীবনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দিনভর তারা নিজেদের মতো করে আনন্দে মেতে থাকে। স্কুল মাঠে গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন পণ্যের অস্থায়ী স্টল। সব স্টলে স্থান পায় গারো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পোশাক, খাবার, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। খাবারের দোকানে ঘুরে ঘুরে তারা স্বাদ নেয় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবারের। কেউ কেউ বাসায় খাওয়ার জন্য কিনে নেন জুমের আলু, কুমড়া শামুক, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন আদিবাসী খাদ্যপণ্য।
সমাপনী অনুষ্ঠানে আগামী বছরের জন্য ব্রেঞ্জন চাম্বুগংকে নকমা ঘোষণা করা হয়।